৫৯ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৭ মে, ২০২২ / ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
চটকল শ্রমিকদের রাজ্য কনভেনশন
ত্রিপাক্ষিক আলোচনা সহ ২৭ দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান
চটকল শ্রমিকদের রাজ্য কনভেনশনে বলছেন শ্রমিক নেতা দীপক দাশগুপ্ত। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গভীর সংকটে রাজ্যের চটশিল্প। বন্ধ ১৪টি চটকল। প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে প্রায় ৫০ হাজার চট শ্রমিক এবং প্রায় ৫০ লক্ষ পাটচাষি। এই পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানে ২৩ মে কলকাতার শ্রমিক ভবনে আয়োজিত চটকল শ্রমিকদের রাজ্য কনভেনশনে সিআইটিইউ-সহ ২১টি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যৌথভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হলো। কাঁচাপাটের বেআইনি মজুত উদ্ধার, বন্ধ চটকল খোলা, দাবিসনদ নিয়ে অবিলম্বে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা, ২৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মাসিক মজুরি নির্ধারণ, সর্বত্র ৯০-২০ অনুপাতে স্থায়ীকরণ সহ অন্যান্য ন্যায্য দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে কনভেনশনে একমত হলেন চটকল শ্রমিকরা। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয় এদিনের কনভেনশন থেকে। ২৭ দফা দাবিতে আগামী জুন মাস জুড়ে জেলায় জেলায় কনভেনশন এবং রাজ্যের প্রতিটি জুটমিলের গেটে সভা অনুষ্ঠিত হবে। ১৩ জুন হাওড়া, ১৭ জুন উত্তর ২৪ পরগনা এবং ২৪ জুন হুগলি জেলায় এই কনভেনশন সংগঠিত হবে।
এদিন কনভেনশনের শুরুতে প্রস্তাব পেশ করেন সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। তিনি বলেন, দেশে চটের বস্তার চাহিদা রয়েছে যথেষ্ট। রাজ্যে এবার যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচাপাটের উৎপাদন হয়েছে। একশ্রেণির পাট ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকের চক্রান্তে কাঁচামালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা। মজুরির প্রশ্নেও শ্রমিকদের সঙ্গে বঞ্চনা করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালে স্থায়ী শ্রমিকদের মাত্র ২টাকা দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি হয়েছিল। এখন ৩৭০ টাকা দৈনিক মজুরির বিনিময়ে স্থায়ী শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১ হাজার টাকা ও ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২৬ হাজার টাকা করার দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বহু চটকলে পিএফ, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই’র বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে। অবসরের এমনকি দশ বছর পরেও বহু শ্রমিক গ্র্যাচুইটির টাকা পাননি। এসবের বিরুদ্ধেও আমরা আন্দোলন গড়ে তোলার পথে এগোবো।
ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণ, বহু জুটমিলেই কিছু নেতা মালিকপক্ষ এবং তৃণমূলের সঙ্গে আঁতাত বজায় রাখে। ফলে কেন্দ্রীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলেও, ভূমিস্তরে সার্বিক ঐক্য গড়ে ওঠে না। এর সুযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের শোষণ চালিয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এর ফলে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ এবং ভরসা হারিয়ে ফেলেন সাধারণ শ্রমিকরা। এই সমস্যার মোকাবিলায় ইউনিট স্তরে নজরদারির প্রয়োজন। তাই সমস্ত ইউনিয়নকে একত্রিত হয়ে দাবি আদায়ের জন্য লড়তে হবে। দিল্লির কৃষক আন্দোলন দেখিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমেই একমাত্র দাবি আদায় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ‘বড়ো-ছোটো’ বাছবিচার করলে চলবে না।
এদিন শ্রমিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে উঠে আসে চটশিল্পের বর্তমান সংকটের পেছনে মালিকপক্ষ, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যসরকারের মদতের প্রেক্ষাপট। রাজ্যে এই মুহুর্তে বন্ধ প্রায় ১৪টি চটকল। ছোটো বড়ো মিলিয়ে বন্ধ থাকা এই চটকলগুলির প্রায় ৫০ হাজারেও বেশি শ্রমিক কর্মহীন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে শ্রমিক পরিবারগুলি চূড়ান্ত অভাবে ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এই চটকল বন্ধ করার কারণ হিসেবে মালিকরা বলছেন বাজারে নায্যদামে কাঁচা পাটের অভাবের কথা। কিন্তু এই অভিযোগ মানছেন না শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে নেতৃত্ব। তাঁরা স্পষ্টতই আঙুল তুলছেন গুজরাটের সিন্থেটিক লবির দিকে। বলা হচ্ছে, চক্রান্ত রয়েছে এই পরিস্থিতি তৈরির নেপথ্যে। কারণ, স্বাধীনতার আগে থেকে দেশে সে সমস্ত চটকল রয়েছে সেখানে কখনই ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাটের জোগানের অভাব দেখা যায়নি। এবারও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই বাজারে কাঁচা পাট এসে গেছে। আর এবছর তো রাজ্যে পাটের যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে। তাই এ সময় কাঁচা পাটের অমিল হবার বাস্তবতা নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পাট বেআইনি মজুদ করেছে। সিন্থেটিক বস্তা উৎপাদকরা এই পরিস্থিতির পুরোদমে সুযোগ নিচ্ছে বলেও অভিযোগ। তারা আইনি সংস্থান অনুযায়ী পাটের ব্যাগ উৎপাদনের মূলে কুঠারাঘাত করতে চাইছে। অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে তারা প্রভাব বিস্তার করে বিকল্প হিসেবে সিন্থেটিক বস্তা জুগিয়ে খাদ্যপণ্য সহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের বাজার কব্জা করতে চাইছে।
রাজ্যের চটকলগুলিতে মালিকপক্ষ কাঁচাপাটের জোগানের অভাবের অজুহাতকে ব্যবহার করে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিশ ঝোলানোর পরে শিল্প এবং রুজি বাঁচানোর তাগিদে আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। এই চক্রান্তের আঁচ পেয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে ১৩ জানুয়ারি কেন্দ্রের বস্ত্রমন্ত্রী এবং এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেওয়া হয় দ্রুত হস্তক্ষেপ করার জন্য। কিন্তু কেন্দ্রের পদ্মফুলের সরকার এবং এরাজ্যের ঘাসফুলের সরকার দুই সরকারের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়করভাবে এক। কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রী বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কেউই আজ পর্যন্ত চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে পদক্ষেপ করেননি।
রাজ্য সরকার এক্ষেত্রে দায়সারা ভাবে জুট কমিশনার, জেসিআই কর্তৃপক্ষ, ডিজি এনফোর্সমেন্ট, আইজেএমএ কর্তৃপক্ষ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিয়ে বৈঠক ডাকে। মজুদ কাঁচাপাট উদ্ধারের প্রশ্নে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি রাজ্যসরকার। টন প্রতি কাঁচাপাটের দাম জুট কমিশনার ৬ হাজার ৫০০ টাকা ধার্য করলেও আইজেএমএ এই ঘোষণার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে। হাইকোর্টের নির্দেশের পর দাম নির্ধারণের বিষয়ে গত ১৯ মে জুট কমিশনার নোটিফিকেশন দিয়ে কাঁচা পাটের দামের ঊর্ধ্বসীমা বাতিল করেছে।
আবার কাঁচা পাটের জোগান অব্যাহত রাখতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি জেসিআই’র চেয়ারম্যানের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া দাবি করা হয় যে, সরকারি দাম এবং বাজারদর যেটা বেশি হবে সেই দামে জেসিআই পাটচাষিদের কাছ থেকে সরাসরি কাঁচাপাট কেনার ব্যবস্থা করে তা চটকলগুলিতে সরবরাহ করুক। জেসিআই শ্রমিক সংগঠনগুলির এই দাবি মেনে আগামী মরসুম থেকে সরাসরি পাট কিনে তা সরবরাহ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ।
কনভেনশনে একইসঙ্গে শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি উঠে আসে শ্রমিক নেতৃত্বের বক্তব্যে। দক্ষ স্থায়ী শ্রমিক পর্যাপ্ত সংখ্যায় না থাকলে চটকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। প্রতিটি মিলে অস্থায়ী কন্ট্রাক্টর, ভাউচার, ভাগা, ডেইলিপেইড, এবং এজেন্সি’র মাধ্যমে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৭৫ শতাংশ যা বে-আইনিভাবে চলছে। আবার এছাড়াও রয়েছে শ্রমিক না পাওয়ার সমস্যা। কারণ দৈনিক ৩৭০ টাকা মজুরিতে বাজারে নতুন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কম মজুরি, দীর্ঘদিন কাজ করার পরেও স্থায়ীকরণ না করা, শ্রমিকদের দীর্ঘদিন ধরে বদলি বা স্পেশাল বদলি হিসাবে রেখে দেওয়া, গ্র্যাচুইটি, পিএফ বকেয়া ফেলে রাখা, মেশিনের সংখ্যার তুলনায় কম অনুপাতে শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে অমানবিক শ্রমের বোঝা চাপিয়ে কাজ করতে বাধ্য করা - এসব অনিয়ম চলছেই। কম রোজের বিনিময়ে মহিলাদের নিয়োগ করা হলেও তাদের জন্য পৃথক শৌচালয় সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়নি। অথচ মালিক পক্ষ মিলের প্রতিটি প্রান্তে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাচ্ছে, গুন্ডাবাহিনী পুষছে। যারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দাবি আাদায়ের আন্দোলনে চড়াও হচ্ছে। এদের হাতেই গেট বাহারের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। লকডাউনের সময়কার মজুরির ও পাননি শ্রমিকরা।
শ্রমিক নেতৃত্বের পাশাপাশি গ্যাঞ্জেস জুট মিলের শ্রমিক মহম্মদ রাইস, জগদ্দল জুট মিলের শ্রমিক রঞ্জিত মণ্ডল, বালি জুটমিলের শ্রমিক মঙ্গল বেদবংশী, বাঁশবেড়িয়া জুট মিলের শ্রমিক রাজেন্দ্র চৌধুরি, রিলায়েন্স জুটমিলের শ্রমিক রাজেশ পাশোয়ান, অশোক ঠাকুর, সামশুল হুদা, চন্দ্রকান্ত রাই, বিশ্বনাথ সহ শ্রমিক প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
এদিনের কনভেনশন পরিচালনা করেন দীপক দাশগুপ্ত, গণেশ সরকার, দেবাশিস দত্ত, অতনু চক্রবর্তী, অমল সেন, দেবদাস চ্যাটার্জি, রামসুরত গিরি, সঞ্জয় রায়, রামনারায়ণ ঝা ও দীপক সাহাকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। সভায় সিআইটিইউ অনুমোদিত বিসিএমইউ’র তরফে বক্তব্য রাখেন দীপক দাশগুপ্ত, আইএনটিইউসি অনুমোদিত এনইউজেডব্লিউ’র তরফে বক্তব্য রাখেন মাস্টার নিজাম, টিইউসিসি অনুমোদিত পিবিসিএমএফ’র তরফে বক্তব্য রাখেন আশিস পান্ডে, ইউটিইউসি অনুমোদিত বিপিসিএমইউ’র তরফে বক্তব্য রাখেন মুজিবর রহমান, এআইইউটিইউসি অনুমোদিত বিজেএমডাব্লিউইউ’র তরফে বক্তব্য রাখেন অমল সেন, এআইটিইউসি’র তরফে বক্তব্য রাখেন দেবাশিস দত্ত, বিএমএস’র তরফে বক্তব্য রাখেন রামসুরত গিরি এবং ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জুট ওয়ার্কার্সের তরফে বক্তব্য রাখেন সেখ সামাদ।
কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবে উল্লিখিত বিষয়গুলিঃ
● সমস্ত বন্ধ চটকল খুলতে হবে।
● কাঁচা পাটের বেআইনি মজুদ উদ্ধার করতে হবে।
● ২৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মাসিক মজুরি (দৈনিক ১ হাজার টাকা হিসেবে) দিতে হবে।
● ২৭ দফা দাবির মীমাংসার জন্য ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করতে হবে।
● দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
● দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের বকেয়া গ্র্যাচুইটি, পিএফ, ইএসআই-সহ অন্যান্য পাওনা টাকা অবিলম্বে দিতে হবে।
● ত্রিপাক্ষিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ৯০:২০ অনুপাতে স্থায়ীকরণ কার্যকর করার ক্ষেত্রে টালবাহানা চলবে না। অবিলম্বে চালু করতে হবে।
● মেশিন পিছু শ্রমিকের সংখ্যার অনুপাত নির্দিষ্ট না করে কাজের বোঝা বৃদ্ধি করা চলবে না।
● ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সম্পন্ন হওয়া ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
● স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ডেইলি পেইড ওয়ার্কার, ঠিকা কর্মী, চুক্তি শ্রমিকদের নাম মাস্টার রোলে অন্তর্ভুক্ত করে স্থায়ীকরণ করতে হবে।
● ১০ হাজার টাকা ন্যূনতম মাসিক পেনশন চালু করতে হবে।
● প্রতি পয়েন্ট ২ টাকা ৫০ পয়সা হারে ডিএ দিতে হবে।
● সব শ্রমিকদের সামগ্রিক সু্রক্ষা, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে হবে।