৫৯ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৭ মে, ২০২২ / ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
নিদারুণ শোষণের শিকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মহিলা
শংকর মুখার্জি
মহারাষ্ট্রের মারাঠাওয়াডা অঞ্চলের বিদ জেলা। রুক্ষ অঞ্চল। ফিবছর খরা লেগেই আছে। সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, এই জেলার ৫০ শতাংশ মহিলার জরায়ু নেই। অস্ত্রচিকিৎসার দ্বারা তা অপসারণ করা হয়েছে।
কোভিডের প্রথম ওয়েভের সময় খবরটা প্রকাশ্যে আসে। কাজের সন্ধানে এই জেলার লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষকে যেতে হয় রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে। পশ্চিমাঞ্চল মহারাষ্ট্রের সুগার বেল্ট। রাজ্যের প্রধান আখ উৎপাদক অঞ্চল। স্বাভাবিকভাবেই চিনিকলগুলোও এখানেই। মাঠ থেকে আখ কাটার কাজে যোগ দিতেই এই নারী-পুরুষদের রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে অভিবাসী হওয়া। কাজে নিয়োগ করা হয় স্বামী-স্ত্রী-কে একসঙ্গে। তবে এই কাজে নিয়মের খুব কড়াকড়ি। কড়াকড়ি বললে বীভৎসতাকে লঘু করা হবে। বলা যায় এই কাজের শর্ত অমানবিক বর্বর। বিশেষকরে মহিলাদের ক্ষেত্রে। কী সেই শর্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
কোনো মহিলা বা পুরুষ যদি কাজে কামাই করে তাহলে সেই স্বামী-স্ত্রী-কে দিনপ্রতি ৫০০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে তাদের, যে নিয়োগ করেছে সেই ঠিকাদারকে। প্রাকৃতিক নিয়মেই মহিলাদের রজস্বলাজনিত কারণে প্রতি মাসের বিশেষ বিশেষ দিনে অনুপস্থিত থাকার সম্ভাবনা বেশি। কাজের শর্তকে আরও কুৎসিত স্তরে উন্নীত করেছে ওই ঠিকাদাররা। যেসব মহিলার এধরনের সম্ভাবনা রয়েছে তাদের কাজেই নেয় না ঠিকাদাররা। ফলে কাজ পাবে না তাদের স্বামীরাও।
মার্চ থেকে মে-জুন এই কাজের সময়। তিন-চার মাসের কাজে যা রোজগার তাই সারা বছরের জীবনযাপনের রসদ। বিদ জেলায় অন্য কোনো কাজের সেরকম সুযোগ নেই। তাই খেত থেকে আখ কাটার কাজ অনেকটাই বাঁচা-মরার সংগ্রাম। তাই কাজ হারানো কোনোমতেই চলবে না। আর তার জন্য দরকার মহিলাদের রজস্বলা থেকে মুক্তি। এটা একমাত্র সম্ভব অস্ত্রোপচারের দ্বারা জরায়ুর বাদ দেওয়াতেই। ঠিকাদাররাই মহিলাদের অগ্রিম দেয় এই অস্ত্রোপচার জন্য। একে কেন্দ্র করেই এই জেলাতে গড়ে উঠেছে একশ্রেণির বেসরকারি ডাক্তার এবং ঠিকাদারদের কুচক্র। সামান্য পেটে ব্যাথা কিংবা শ্বেতস্রাবের সমস্যা নিয়ে মহিলারা ওই সব ডাক্তারের কাছে গেলে তারাই পরামর্শ দেন জরায়ু বাদ দেওয়ার। বিদ জেলায় ২০-২৫ বছর বয়সের বহু মহিলার হদিস মিলেছে যাদের ইতিমধ্যেই জরায়ু বাদ দেওয়া হয়ে গেছে। মহিলাদের ওপর এই নিপীড়ন নিঃশব্দে বছরের পর বছর হয়ে চলেছে। বিদ জেলায় বিষয়টা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। কোনো হেলদোল নেই রাজ্য প্রশাসনের। আর যেখানে ওই মহিলারা আখ কাটতে যায় সেখানে শ্রমিকদের কোনো বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই। নেই শৌচালয়। মহিলাদের ওপর যৌন হেনস্তার ঘটনাও আকছার ঘটে।
তামিলনাডুর পোশাক শিল্পের মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটে। পোশাক শিল্পে মহিলা শ্রমিকরাই প্রধান শ্রমশক্তি। কারখানাগুলিতে নেই মহিলাদের পৃথক শৌচালয়। রজস্বলার সময় মহিলাদের জন্য যা খুবই জরুরি। এই প্রতিবন্ধকতা এবং ওই বিশেষ সময়ে শারীরিক কারণে মহিলাদের কাজে অনুপস্থিত থাকার সম্ভাবনা রয়েই যায়। তাতে ব্যাঘাত পাবে উৎপাদন। যা প্রভাব ফেলবে মুনাফাতেও।
এখানে মালিকরা বিদ জেলার মতো পথে যায়নি। অন্য পথ অবলম্বন করেছে। তারা মহিলা শ্রমিকদের অজান্তেই তাদের পিল খাইয়ে দিচ্ছে। যার ফলে মহিলাদের রজস্বলাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মহিলারা জানতেও পারছে না এসব কেন হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে এই প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতিকে বন্ধ করে দেবার ফলে মহিলাদের শরীরের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আর এটা একেবারেই অপরাধমূলক কাজ। এখানেও রাজ্য প্রশাসন নিশ্চুপ। তারা বকলমে মালিকদের পক্ষেই কাজ করছে।
● ● ●
মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাডুর এই ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। সারাদেশে শ্রমজীবী মহিলাদের ওপর এরকম হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। যার সিংহভাগই জানা যায় না। কোনো খবর হয় না। কোভিড মহামারীর পরিস্থিতিতে কাজের বাজারের অবস্থা ভয়াবহ। আর্থিক সংকট, মন্দাকে হাতিয়ার করে শ্রমিকদের ওপর চলছে মধ্যযুগীয় শোষণ। অনুকূল সময়তেই শ্রমজীবী মহিলাদের ওপর শোষণ এমনিতে বেশি, বর্তমান মহামারীর পরিস্থিতিতে তা বর্বরতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে ছাঁটাইয়ের কোপ মহিলাদের ওপরই প্রথম আসে। তাই কাজ হারানোর ভয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের নিপীড়নের কথা তারা জানাতেই চান না।
কোভিডের সময় দেশে কর্মচ্যুতি যে কী ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছেছিল তার ছবি বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারেরই হিসাব অনুযায়ী কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে ২ কোটি ২০ লক্ষ হয়। যাদের বেশিরভাগই দৈনিক মজুরিতে কাজ করতেন। এই সময়টা হলো কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ যখন দেশে দেখা গেল। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এমপ্লয়মেন্টের রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর, অর্থাৎ দ্বিতীয় ওয়েভের আগে শ্রমজীবী মহিলাদের ৪৭ শতাংশই স্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছিলেন। যেখানে পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে এই হার ৭ শতাংশ। এদের অনেকেই পুরনো পেশায় ফিরতে পারেননি। অনেকে বেকারই রয়ে গেছেন। কিছু স্বনির্ভর পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্যে অন্য একটি দিক উঠে এসেছে। সেটাও সমানভাবে আমাদের ভাবায়। তা হলো, দেশের শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমছে। কোভিডের সময় তা সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছিল। ওই তথ্য বলছে, এই হার ছিল ২০২০-র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ১৫.৫ শতাংশ এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ১৬.১ শতাংশ। যেটা মাত্র এর একবছর আগে ২০১৯ সালে ছিল ২০.৩ শতাংশ আর ২০০৫ সালে ২৬ শতাংশ। এই বিচারে আমরা প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা থেকে অনেকটা পিছিয়ে। এই দুদেশে এই হার যথাক্রমে ৩০.৫ শতাংশ এবং ৩৩.৭ শতাংশ।
● ● ●
কাজে সক্ষম দেশের বাকি মহিলারা কী তাহলে অলসভাবে সময় কাটান! দেশের এই কোটি কোটি মহিলারা সমাজ ও পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সারা বছর নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। তার জন্য তারা কোনো মজুরি পান না, এমনকী সমাজ কিংবা সরকার একাজকে স্বীকৃতিও দেয় না। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক উচ্চ স্তরের কমিটি হিসাব কষে দেখিয়েছে, ভারতের মহিলারা যে কাজ করেন তার ৫১ শতাংশই বিনা পারিশ্রমিকে। জাতীয় পরিসংখ্যানেও এর কোনো হিসাব থাকে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার অভিমত অনুযায়ী, বিনা পারিশ্রমিকে সেবামূলক এবং গৃহকর্মে মহিলাদের এই অবদান আসলে সেবার কাজে ব্যয়তে ভরতুকি হিসেবে কাজ করে। এবং তা জাতীয় অর্থনীতিতে ভীষণভাবে সহায়তা করে। অর্থমূল্যে মহিলাদের এই কাজের বিচার করলে তার পরিমাণে আমাদের অবাক হতে হবে। হিসেব কষে দেখা গেছে এর পরিমাণ দেশের উৎপাদন, বাণিজ্য ও পরিবহণ অর্থনীতির সম্মিলিত পরিমাণের চেয়ে বেশি। অর্থনীতিতে মহিলাদের এই বিশাল অবদানের কোনো স্বীকৃতি নেই।
আমাদের দেশের সরকারও মহিলাদের সামাজিক অবস্থানকে ব্যবহার করে সেবামূলক কাজে মহিলাদের নিয়োগ করে প্রত্যক্ষভাবে শোষণ করছে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা এবং মিড-ডে মিলের মতো প্রকল্পে যে কোটি কোটি মহিলা যুক্ত রয়েছেন তাদের কথা এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এরা নিরলসভাবে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পুষ্টির কাজ করে চলেছেন। আশা’র কর্মীরা সমাজের সব অংশের মানুষের কাছেই প্রথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেবার কাজ করেন। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিডের সময় পীড়িত মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে আশা কর্মীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এদের অবদানের কথা কোনোদিনই আলোচনাতেই আনে না; এমনকী এই মহিলাদের শ্রমিক বা কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও তারা নারাজ। ৪৫ তম ভারতীয় শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ ছিল এদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার, ন্যূনতম মজুরি প্রদান এবং সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার। কোনো সুপারিশেই কেন্দ্রীয় সরকার আমল দেয়নি।
মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রেও শ্রমজীবী মহিলারা বিরাট বৈষম্যের শিকার। একই কাজে একজন পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে একজন মহিলা শ্রমিক গ্রামে ৩৪ শতাংশ এবং শহরে ১৯ শতাংশ কম মজুরি পান। কিন্তু দেশে আইন রয়েছে সম কাজে সম মজুরি প্রদানের। এসবের দিকে দেশের শ্রম মন্ত্রকেরও নজর নেই। মহিলাদের প্রতি এই বৈষম্য শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রের পেশাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তা প্রসারিত তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বেতন প্রদানে, উচ্চ মেধার চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও। এইসবের জন্যই বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে ভারতের ক্রমঅবনমন ঘটে চলেছে। ২০২১ সালে এই সূচকে ভারতের স্থান ২৮ ধাপ নেমে ১৫৬ দেশের মধ্য ১৪০ হয়েছে। এই সূচকই দেখিয়ে দিচ্ছে বিজেপি শাসনে নারীদের ওপর নিপীডন নির্যাতন বৈষম্য কী ভয়ংকরভাবে দেশে বিরাজমান।
● ● ●
দেশের অর্থনীতিতে মহিলাদের এই বিশাল অবদানকে জিডিপি’তে অন্তর্ভুক্ত করা, প্রকল্প শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, তাদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান; কর্মস্থলে মহিলাদের যৌন হেনস্তা বন্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ, সম কাজে সম বেতন, মহিলাদের ওপর সামাজিক নিপীডন বন্ধ প্রভৃতি দাবিতে সংগঠিত বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে রাস্তায় রয়েছে। তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস বা সিআইটিইউ।
সিআইটিইউ’র অল ইন্ডিয়া কো অর্ডিনেশন কমিটি অব ওয়ার্কিং ওমেন’র ১২ তম কনভেনশন ২০-২২ মে কলকাতার পোস্তায় অনুষ্ঠিত হলো। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবী মহিলারা এই কনভেনশনে যোগ দেন। কনভেনশনে পেশ করা রিপোর্টে দেশের শ্রমজীবী মহিলাদের ওপর শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যের এক জীবন্ত ছবি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিনিধিদের আলোচনাতেও তা ধরা পড়েছে। এর বিরুদ্ধে জানপণ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান করেছেন তারা কনভেনশনে। এই আলোচনায় নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছেন, সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ করেছেন দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে।
মাওয়ের কথায় ‘অর্ধেক আকাশ’ কিংবা নজরুলের ভাষায় “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি/ চির- কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,/ অর্ধেক তার নর।” - সেই অর্ধেক আকাশ কিংবা উৎপাদনের অর্ধেক অবদানকারীদের উপেক্ষা করে, অস্বীকার করে কোনো সমাজ, কোনো দেশ কখনো এগোতে পারে না। এই লড়াই শ্রমজীবী মহিলাদের বা মহিলাদের একার লড়াই নয়। তাই তাদের আন্দোলন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন কিংবা বৃহৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে পৃথক নয়। এই আন্দোলনেরই অংশ। শ্রমজীবী মহিলা এবং সামগ্রিকভাবে মহিলাদের বিষয়গুলিকে এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বিষয় করে নিয়েই এই অচলায়তন ভাঙার লড়াইয়ে এগিয়ে যেতে হবে।