৫৯ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৭ মে, ২০২২ / ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টিতে বিপ্লবী চেতনার দীপ্তি
সন্দীপ দে
বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে কাজি নজরুল ইসলাম (২৪ মে, ১৮৯৯-২৯ আগস্ট, ১৯৭৬) এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য ও বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বিরাজিত সাহিত্যজগতে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন মৃত্তিকা সংলগ্ন পুরুষ। যিনি কোনো সংশয় বা আড়াল না রেখে সরাসরি মুক্তকণ্ঠে সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনা, জীবন যন্ত্রণা, তাদের সামাজিক নিগ্রহ ও বঞ্চনার জীবনকথা সোচ্চারে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে মূর্ত করেছেন। তাই স্বভাবতই তাঁর বিস্তৃত ঘটনাবহুল বর্ণময় জীবন মসৃণ ছিলনা। জীবনের চলার পথে নিষ্ঠুর ঘাত প্রতিঘাত, দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত নিদারুণ অভিজ্ঞতা যেমন তাঁকে নিগূঢ় সমাজচেতনায় দীপ্ত করেছে, তেমনি তাঁকে সমাজের যাবতীয় অন্যায়ের আগল ভাঙতে বিদ্রোহী করে প্রতিকারের সন্ধানে, সাম্যবাদী চেতনায় চালিত করেছে। তিনি প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী কবি, একইসঙ্গে মানবপ্রেমিক স্রষ্টা। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই ছিল তাঁর সৃষ্টির অন্যতম উৎস। ব্রিটিশ আমলের ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় শাসনের নাগপাশ থেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন করে শোষণ-নিপীড়নহীন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে উজ্জ্বল সমৃদ্ধ স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে নজরুল ব্যক্তিজীবনে নানা কঠিন-বন্ধুর পথে আঘাতে জর্জরিত ও রক্তাক্ত হয়েছেন, ব্রিটিশ কারগারে বন্দিজীবনে অত্যাচার সয়েছেন। তবুও তিনি দুঃসহ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও সমস্ত সৃজন-শক্তি উজাড় করে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মগ্ন থেকেছেন। এইদিক দিয়ে তিনি ছিলেন এক অনন্য, প্রকৃত অর্থেই জনগণের কবি। তাই তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে এমনই পঙ্ক্তি -
‘‘আজ নিখিলের বেদনা - আর্ত পীড়িতের মাখি’খুন
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জাম-ধরা যত কবাট ভাঙ্গিয়া দাও
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও।’’
(কুলি-মজুর)
শৈশবের বিচিত্র অভিজ্ঞতা
নজরুল ইসলাম অলীক কল্পনা-বিলাসী, নিভৃত গৃহকোণের বাসিন্দা জীবন ও সমাজ বিমুখ সাহিত্য রচয়িতা ছিলেন না কোনোদিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি বাংলার সাহিত্যাকাশে ‘ধূমকেতু’র মতোই যেমন উদয় হয়েছিলেন, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই কণ্ঠরুদ্ধ (১৯৪২)হয়ে সাহিত্যাকাশ থেকে মিলিয়ে গিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় ছিলেন জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্ত। মাত্র ২২/২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে কবিতা, গান সহ অসামান্য সব সৃষ্টির মাধ্যমে, সেইসঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনমানসকে যেভাবে আলোড়িত করেছেন,তার নজির মেলা ভার। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নজরুলের যখন মাত্র ন-বছর তখন পিতা কাজি ফকির আহমেদের মৃত্যু হয়। তাঁর দুই স্ত্রীর একজন জাহেদা খাতুন,অপরজনের নাম জানা যায়না। দুই স্ত্রীর মোট সাত পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কাজি সাহেবজান। তার পর চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম। তাই সম্ভবত তাঁর ডাক নাম ছিল দুখু মিয়াঁ। মার স্নেহস্পর্শ নজরুলের বেশিদিন জোটেনি। পিতার মৃত্যুর সময় নজরুল সবে গ্রামের মক্তবের পাঠ শেষ করেছেন। পড়াশোনায় মেধা ছিল, কিন্তু প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তাই দুখু মিয়াঁকে উপার্জনের তাগিদে ওই মক্তবেই প্রায় সমবয়সিদের পাঠের তালিম দেবার দায়িত্ব নিতে হয় দশ বছর বয়সে। ১৯১১ সালে তিনি বর্ধমান জেলার মাথরুন গ্রামে নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ে ভরতি হন। তখন ওই স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। জানা যায়,কাছাকাছি সময়ে অন্ডালে এক রেলওয়ে গার্ডের পাল্লায় পড়ে খানসামাগিরিও করেছেন নজরুল। তারপর সংসারে নিদারুণ অর্থকষ্টের জন্য গৃহত্যাগ করেন নজরুল। যোগ দেন গ্রামীণ লোকশিল্প লেটো গানের দলে। তিনি আসানসোলে মাসিক একটাকা বেতনে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। সেখানে পুলিশ কর্তার বাড়িতে গৃহ সহায়কের কাজ করেছেন। সেই পুলিশ কর্তা স্নেহপরবশ হয়ে নজরুলকে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভরতি করে দেন (১৯১৪)। সেখানে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা সত্ত্বেও এক বছর পর ফিরে আসেন বর্ধমানে এবং ভরতি হন শিয়ারশোল রাজ স্কুলে। একই সময়ে রানিগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র, পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সেই শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গভীর সখ্য তৈরি হয় তাঁর।
বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ
১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৭ সাল শিয়ারশোল রাজ স্কুলে পড়াশোনা করেন নজরুল। তখন তিনি ক্লাস টেনের ছাত্র। স্কুলের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরিচিত সকলের আশা, মেধাবী ছাত্র নজরুল ম্যাট্রিকে ভালো ফল করে বৃত্তি পাবেন, কিন্তু হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দেন। চলে যান করাচির সেনা নিবাসে। বহির্মুখী স্বভাবের নজরুল ছিলেন সকলের প্রিয়। এখানে গানে, কবিতায়, গল্প, রসিকতায়, উচ্চকিত হাসিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। এখানে তিনি হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রসদ ভাণ্ডারের দায়িত্বে। মাঝে মাঝে নৌশেরায় ট্রেনিং-এ যাওয়া ও করাচি শহরে কেনাকাটা করতে যাওয়া ছাড়া কোয়ার্টারে সীমাবদ্ধ জীবন ছিল তাঁর। এই সেনা নিবাসে তাঁর পড়াশোনা, লেখালেখি, নানা বাদ্যযন্ত্র শেখা, ছাউনির এক পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে আরবি-ফারসির তালিম নেওয়া, স্বরলিপি দেখে রবীন্দ্রসংগীত শেখা, বিপ্লবী পত্র-পত্রিকা গোপনে পড়া, বেশকিছু বাংলা পত্রপত্রিকার চাঁদা দিয়ে গ্রাহক হয়ে নিয়ম করে আনানো ও পড়া - এই ছিল তাঁর নিবিড়-নিচ্ছিদ্র দিনলিপি। নজরুলের সাহিত্য চিন্তা, সমাজভাবনা ও আন্তর্জাতিক চেতনার আলোকে মুক্তিসংগ্রামী কবি হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্ব রচিত হয়েছিল এখানেই। লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে লাল ফৌজের বিজয় বার্তা শুনে উচ্ছ্বসিত নজরুল এখানেই এক সন্ধ্যায় সঙ্গী বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা, প্রবন্ধ পাঠ ও গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ উদ্যাপন করেছিলেন। আর এটাও সহজেই অনুমান করা যায় হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ-কলুষ ঘোচাবার দৃঢ় মনোভূমি তাঁর গড়ে উঠেছিল করাচির এই সেনা নিবাসেই। এখানে বসেই কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ও গল্প-কবিতা পাঠানোর সূত্রপাত। ১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় নজরুলের লেখা প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়। এই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার-সহ সম্পাদক মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে। শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবনের সন্ধিক্ষণে এই সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ নজরুলের কবিত্বশক্তি, সাহিত্যসৃজন, সংগীতপ্রতিভা থেকে শুরু করে তাঁর রাজনৈতিক ও বিপ্লবী চেতনা গড়তে সাহায্য করে। বিশেষ করে মুজফ্ফর আহ্মদের সান্নিধ্য এবং শিয়ারশোল রাজ স্কুলে বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটকের প্রভাব নজরুলকে সংগ্রামী চেতনায় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদ্ভুদ্ধ হবার ক্ষেত্রে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। এ ঘটনার সাক্ষ্য মেলে মুজফ্ফর আহ্মদের লেখায়।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা সৃষ্টির শতবর্ষ
নজরুলের কাব্যপ্রতিভা ও সৃষ্টির ভুবন প্রসঙ্গে একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি যদি শুধুমাত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার পর কাব্যজগৎ থেকে অবসর নিতেন, তবুও তিনি কবি খ্যাতির সুউচ্চ আসনে বিরাজ করতে পারতেন। একটি কবিতার মাধ্যমে যে সমস্ত কবি বিখ্যাত ও চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কাজি নজরুল ইসলাম। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যে আলোড়ন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং কবি হিসেবে তিনি অভিনন্দিত হয়েছিলেন, সেইসঙ্গে এই কবিতাকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা সম্ভবত কোনো কবির ক্ষেত্রে হয়নি। এছাড়া আরেকটি বিষয়ও উল্লেখনীয়, বিদ্রোহী কবিতা জনমানসে এতটাই আলোড়ন তুলেছিল যে, বিমুগ্ধ পাঠকেরা কবির নামের আগে তাঁরই রচিত কবিতার নাম সংযোজন করে নিয়েছিলেন। তিনি দেশে-দুই বাংলায়,বিশ্বের আঙিনায় নতুন করে পরিচিতি লাভ করেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। এছাড়া এই কবিতা নিয়ে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। ‘বিদ্রোহী‘ কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। সেই অনুযায়ী এ বছর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ।
বিদ্রোহী কবিতা যখন লিখেছিলেন কবি তখন তিনি থাকতেন ৩/৪সি, তালতলা লেনের বাড়িতে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে। এই কবিতা সৃষ্টির ঘটনা সম্পর্কে মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর বইয়ে লিখেছেনঃ
‘‘তখন নজরুল আর আমি নিচের তলার পুব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বললো,সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’’ (‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’)
'বিদ্রোহী'-তে বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি,ফারসি সহ হিন্দু কাব্য,পৌরাণিক উপকথা থেকে চমকপ্রদ শব্দ চয়ন, বিচিত্র ধ্বনি, উদ্দাম ছন্দ, দৃপ্ত ভাব,সুরের ঝংকারের সমন্বয়ে ও দুরন্ত বিপ্লবী প্রাণের আহ্বানে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হলো তাতে বাংলার মানুষ এই কবিতার মাধ্যমে বাঁধ ভাঙা যৌবনের স্পর্ধিত উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হতে শুনলেন -
‘‘বল বীর...
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর...
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রির!’’
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্র মাত্রা যেন সংযোজিত হয়েছিল এই কবিতায়। সেই সঙ্গে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মাথা তুলে দাঁড়াবার দুর্জয় সাহস ও নিরন্তর শ্রেণি সংগ্রামের বার্তা ঘোষিত হয়েছিল...
‘‘আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’’
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পুরাতনকে ভেঙে নতুনের আহ্বান, ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারমুক্ত চেতনা এবং নির্ভীক বিদ্রোহী- বিপ্লবী প্রাণের চিরন্তন ঘোষণা যেন বাঙ্ময় হয়েছে...
‘‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন।
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি চির-বিদ্রোহী বীর...
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।’’
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। সেদিন বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকাটির এত চাহিদা হয়েছিল যে সেই সপ্তাহে ‘বিজলী’ দু’বার ছাপতে হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি শুনে নজরুলকে আলিঙ্গন করেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আবার এই প্রশংসা, উচ্ছ্বাসের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার, সজনিকান্ত দাস প্রমুখের কদর্য সমালোচনা, কুৎসা, ব্যঙ্গ কবিতা রচনা এবং কবি গোলাম মোস্তাফা, আবদুল হাকিম, গোলাম হোসেনদের তীব্র মৌলবাদী আক্রমণ সত্ত্বেও তখন বিপুল অংশের তরুণ যুবশক্তি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত বিপ্লববাদীরা এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে পেয়েছিলেন অফুরান প্রাণশক্তি, সংগ্রামের প্রেরণা। যে কবিতা আজও সজীব ও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
কাব্যে শ্রেণি সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বাণী
বাংলা কাব্যে শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা প্রকাশে, শোষক আর শোষিতকে পরস্পর বিরোধী এবং সংগ্রামরত দুই শ্রেণি হিসেবে তুলে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম একজন অগ্রগণ্য কবি। তিনি লিখেছেন -
‘‘আজ জাগ্রে কৃষাণ, সব ত গেছে,কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
ঐ বিশ্বজয়ী দস্যুরাজার হয়-কে করব নয়,
ওরে দেখ্বে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল।’’
(‘কৃষাণের গান’)
তিনি অত্যাচারী শোষকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের রুখে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ে শামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছেন -
‘‘মোদের যা ছিল সব দিইছি ফুঁকে,
এইবার শেষ কপাল ঠুকে
পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকে রে!
আবার নতুন করে মল্লভূমে গর্জাবে ভাই দল-মাদল।
ধর্ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল।’’
(‘'শ্রমিকের গান’)
ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্য নজরুলকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, সর্বহারার শৃঙ্খলমোচনের সংগ্রামে ব্রতী হতে প্রাণিত করেছিল। তিনি নভেম্বর বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে 'প্রয়োল্লাস' কবিতায় আহ্বান জানিয়েছেন -
‘‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কাল-বোশেখীর ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!’’
নজরুল ইসলাম অস্পৃশ্যতা, ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার কেবল বিরোধিতাই করেন নি,এসবের বিরুদ্ধে কাব্যে-সাহিত্যে ধিক্কার ধ্বনিত করেছেন এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জাতের নামে বিদ্বেষ, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই কবিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি ‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছেন -
‘‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত- জালিয়াৎ খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাব্লি এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান!
এখন দেখি স্ভারত-জোড়া
প’চে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।’’
তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ‘হিন্দু-মুসলমান’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
‘‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন, দেখ, যে ন্যাজ বাইরের তাকে কাটা যায়,কিন্তু ভেতরের ন্যাজকে কাট্বে কে?
হিন্দু মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে ঐ গুরুদেবের কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে, এ ন্যাজ গজাল কি করে? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায় - তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক - তারাই হয়ে ওঠে পশু।’’
নজরুল ইসলামের জীবনদর্শন এবং জীবনযাপনের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলনা। ব্যক্তিজীবনে তিনি কোনো ধর্মাচরণ করেননি। প্রমীলা সেনগুপ্তকে বিয়ের সময় তাঁকে ধর্মান্তরিত করা বা মুসলিম প্রথা অনুসরণ করেননি। তিনি আন্তরিকভাবেই নানা জাতি-ধর্মের মিলনের প্রত্যাশী ছিলেন। ১৯২৯ সালে অ্যালবার্ট হলে (বর্তমানে কফি হাউস) তাঁর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অভিভাষণে তিনি অকপটে বলেছিলেনঃ
‘‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’’
কবির এই সম্প্রীতি ও মিলনের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাই মূর্ত হয়েছে তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায়। তিনি লিখেছেন -
‘‘গাহি সাম্যের গান -
যেখানে আসিয়া এক হ'য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’’
এই কবিতাতেই তিনি আরেক জায়গায় উচ্চারণ করেছেন -
‘‘গাহি সাম্যের গান -
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্’’
এমন অসংখ্য রচনা ছড়িয়ে আছে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারে।
আজকে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা ও তীব্র জাতিবিদ্বেষ-কলুষিত দেশে নজরুল ইসলামের মতো একজন দৃপ্ত চেতনাসম্পন্ন কবির ‘‘হায়দরি হাঁক’’-এর প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে অনুভূত হচ্ছে। তেমনি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তাঁর সৃষ্টির এই চিরন্তন সম্প্রীতির সুর -
‘‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম
হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন-মণি
হিন্দু তাহার প্রাণ।’’
তথ্যসূত্রঃ
● সঞ্চিতা - কাজী নজরুল ইসলাম, ডি এম লাইব্রেরি।
● রুদ্রমঙ্গল - কাজী নজরুল ইসলাম, গ্রন্থলোক।
● কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা - মুজফ্ফর আহ্মদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
● জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম - কল্পতরু সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।
● নজরুল জীবনী - অরুণ কুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।