E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৫শ সংখ্যা / ২৭ নভেম্বর ২০২০ / ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

২৬ নভেম্বর গ্রাম থেকে শহর ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট

শ্রমজীবী জনতার শানিত চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ


কর্ণাটকের গুলবর্গায় ধর্মঘটীদের পিকেটিং।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ক্ষুধা-বঞ্চনা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অধিকার রক্ষা আর দেশ বাঁচানোর শপথে শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে স্তব্ধ হলো গোটা দেশ। ২৬ নভেম্বর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-প্রতিবাদের জ্বলন্ত রূপ যেন বাঙ্ময় হলো এদিনের ধর্মঘটে। দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনগুলি কেন্দ্রের দেশ বিরোধীনীতির বিরুদ্ধে যে দেশজোড়া সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছিল, তাকে সমর্থন জানিয়ে ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। তাদের আহ্বানে এদিন গ্রাম ভারত বন্‌ধ, বিক্ষোভ-অবরোধ ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে। এদিন এই ধর্মঘটের জেরে ১৫টি রাজ্যে বন্‌ধ বা বন্‌ধের মতো অবস্থা তৈরি হয়। দেশের শিল্পক্ষেত্রগুলি স্তব্ধ হয়ে যায়, খনি-বন্দরের কাজ বন্ধ থাকে, বিভিন্ন রাজ্যে পরিবহণ ব্যবস্থা অচল হয়। সড়ক-রেল অবরোধ চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয়তা বিরোধী ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের লড়াকু মনোভাবকে অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। এদিন ধর্মঘটে আহ্বানকারী ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে দেশের শ্রমিক-কৃষকদের অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে, নিপীড়নের পথ নিয়ে সরকার প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে না।

সাধারণ ধর্মঘটে শুনশান আগরতলার রাজপথ।

এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যেই কৃষকদের সংগ্রামের সম্মিলিত মঞ্চের ডাকে ২৭ নভেম্বর দিল্লি অভিযানকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, কেরালা প্রভৃতি রাজ্য উত্তাল হয়ে ওঠে। এসব রাজ্য থেকে হাজার হাজার কৃষক ট্রাক, ট্রাক্টর প্রভৃতি যানবাহনের সাহায্যে দিল্লি রওনা হন। তাঁরা দিল্লি সংলগ্ন অঞ্চল থেকে দিল্লি অভিমুখে মিছিল শুরু করেন। কৃষকদের এই অনমনীয় লড়াকু মেজাজে বিক্ষোভ-লড়াই প্রত্যক্ষ করে বেপেরোয়া হয়ে ওঠে মোদী সরকার। কৃষকদের এই বিপুল স্রোত ঠেকাতে দিল্লি সীমান্তে বহুস্তরীয় ব্যারিকেড গড়ে ব্যাপক সংখ্যায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করলেও সংগ্রামী কৃষকেরা সমস্ত বাধা বিপত্তিকে প্রতিহত করেই এগোতে থাকে সামনের দিকে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক মিছিলে পুরুষদের সঙ্গে অংশ নেয় অসংখ্য মহিলা ও শিশু। কেন্দ্র দাবি না মানলে কৃষক আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এমন ভাবনা নিয়ে আন্দোলনকারীরা লরি-ট্রাকে অন্তত ছ’ মাসের খাদ্যসামগ্রী মজুত করে আন্দোলনে যোগ দেন। দিল্লিমুখী কৃষকের স্রোত আটাকাতে ২৫ নভেম্বর থেকেই আম্বালা, ভিওয়ানি, কার্নাল, বাহাদুরগড়, ঝাজ্জর, সোনপতের মতো অসংখ্য জায়গায় কংক্রিট এবং লোহার ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল হরিয়ানা পুলিশ। কিন্তু এই ব্যারিকেডগুলি ভেঙে কৃষকেরা এগোতে থাকেন। তাঁদের ওপর জলকামান ছোঁড়ে পুলিশ। দিল্লিমুখী কৃষকের স্রোতকে হরিয়ানায় ঢোকা রুখতে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে একটি ব্রিজের কাছে কৃষকদের লোহার ব্যরিকেড করে আটকানো হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা সেইসব লোহার ব্যারিকেড ছুঁড়ে ফেলে দেয় নদীর জলে। পুলিশ জলকামান দিয়ে আন্দোলনকারীদের ভিজিয়ে দিলেও তাদের রোখা যায়নি।

কাশ্মীরে অনন্তনাগে সোচ্চার ধর্মঘটী প্রকল্প শ্রমিকরা।


তামিলনাড়ুতে অনড় ধর্মঘটে শামিল অটোচালকরা।

এদিন শ্রমিক-কৃষক সহ মেহনতি মানুষের অভূতপূর্ব লড়াকু মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছে গোটা দেশ। এদিন প্রায় ২৫ কোটি মানুষ অংশ নেন এই ধর্মঘটে। পুলিশের বেপরোয়া আক্রমণ, এসমা-এনএসএ জারি, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো রাজ্যে শাসকদল ও পুলিশের যৌথ হামলা মোকাবিলা করেও ধর্মঘটকে সফল করেছেন মানুষ।

দেশের অধিকাংশ শিল্পাঞ্চলে এদিন মেশিনের চাকা ঘোরেনি। কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, দিল্লির শিল্প এলাকায় ধর্মঘট হয়েছে সর্বাত্মক। হিন্দুস্তান অ্যারোনেটিকস, ভেল, বি ই এল বন্ধ ছিল। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ কয়লাখনিতে কোনো কাজ হয়নি। লৌহ আকরিক খনিতেও এবার কাজ বন্ধ থেকেছে।

জরুরি বিভাগ ছাড়া বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শ্রমিকরা কাজে যোগ দেননি। টেলিক‍‌মে ধর্মঘট ছিল প্রায় সর্বাত্মক। অচল ছিল ডাক ব্যবস্থা, প্রায় সমস্ত রাজ্যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন। দেশের আর্থিক ক্ষেত্রে ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিমা ক্ষেত্র বন্ধ ছিল, ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রের প্রায় ৮০ শতাংশ বন্ধ ছিল।

সংগঠিত শিল্পের পাশাপাশি অসংগঠিত ক্ষেত্রেও এদিনের ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। খুবই কঠিন সঙ্কটে থাকা সত্ত্বেও নয়ডা, ফরিদাবাদ, গাজিয়াবাদের মতো শিল্প এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে ৭০০-র বেশি নির্মাণ শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিন গোটা দেশে ২৫ লক্ষ ৬৩ হাজারের মতো নির্মাণ শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন। বিড়ি শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করেননি। সড়ক পরিবহণের সরকারি ক্ষেত্রেও ধর্মঘট হয়েছে। চলেনি অটো, ট্যাক্সি। চা-বাগিচা সহ কয়ার শ্রমিকরা সংগঠিতভাবেই ধর্মঘটে যোগ দেন। আইসিডিএস, আশাকর্মীদের মতো প্রকল্প শ্রমিকরাও দলে দলে ধর্মঘট করেছেন, আইন অমান্যে যোগ দিয়েছেন। দেশজুড়ে ছোটো দোকানদারদের বিরাট অংশ এই ধর্মঘটকে সমর্থন করায় বাজার এলাকা শুনশান হয়ে যায়। মুটিয়া মজুররা ধর্মঘটে ‍‌যোগ দেওয়ায় বড়োবাজার, পাইকারি বাজার, মান্ডি ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যায়।

এদিন ধর্মঘটের এই ব্যাপকতা এবং মানুষের লড়াকু মনোভাব দেখে সরকারও বেপরোয়া হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘট ভাঙতে নামে। দিল্লির যন্তর মন্তরে সমাবেশে এসে আক্রমণ করে পুলিশ। সেখানে ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গণসংঠনের নেতৃবৃন্দ সমবেত হয়েছিলেন। এখানে পুলিশ কৃষকসভার নেতা কৃষ্ণ প্রসাদ, এস এফ আই নেতা ময়ূখ বিশ্বাস, ঐশী ঘোষদের গ্রেপ্তার করে। ওডিশা, অন্দ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মঘটীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাস্তা ও রেল অবরোধের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার অবরোধকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে সাধারণ ধর্মঘটে মানুষের ব্যাপক সাড়া লক্ষ করে ত্রিপুরায় শাসকদল হামলা, আক্রমণ চালায়। এরা সিপিআই(এম), সিপিআই, এসইউসিআই’র পাশাপাশি সিআইটিইউ এবং কর্মচারী সংগঠনের অফিস ভাঙচুর ও আগুন লাগায়। বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘটের ছবি তোলায় আক্রান্ত হন চিত্র সাংবাদিকরা। সিপিআই রাজ্য দপ্তরে বিজেপি বাহিনী হামলা চালায়, জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এছাড়া সিআইটিইউ’র বাজ্য দপ্তরও এদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য এবং বিরোধীদল নেতা মানিক সরকার এই সমস্ত হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেন, ভীতি থেকেই শাসক দল আক্রমণের পথে গেছে।

এদিন দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণি, কৃষক এবং খেতমজুরদের অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। এদিন এক বিবৃতিতে বলেছে, বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ, জাতীয় সম্পদ লুট, শ্রমআইনের অবলুপ্তি এবং নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতায় সারা দেশেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে চালানো হয়েছে নিপীড়ন, দেওয়া হয়েছে হুমকি, বিরাট সংখ্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সর্বত্র সাফল্যের সঙ্গে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। এদিন কৃষক ও খেতমজুরদের প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল সংসদের সামনে। তাঁরা যাতে সংসদের ধারে কাছে পৌঁছাতে না পারে, সেজন্য দিল্লিতে ঢোকার সবক’টি রাস্তায় ব্যাপক ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ। কিন্তু এই ঠান্ডার মধ্যেও যেখানেই কৃষক-খেতমজুরদের ওপর কাদানে গ্যাস ও জলকামান প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানেই তাঁরা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।

পলিট্যব্যুরো বিবৃতিতে আরও বলেছে, ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা এদিনের সাধারণ ধর্মঘট সারা দেশেই বিপুল সাড়া ফেলেছে। আগের থেকেও অনেক বেশি তীব্রতার সঙ্গে ধর্মঘট হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মঘটের প্রভাব বাড়ার কথা উল্লেখ করে পলিট ব্যুরো বলেছে, কেরালায় এদিন কার্যত বন্‌ধের চেহারা নিয়েছিল। ওই রাজ্যে প্রায় ১ কোটি ৬ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশের হামলা সত্ত্বেও এই ধর্মঘট সফল হয়েছে। ত্রিপুরায় শাসক বিজেপি’র দুষ্কৃতীদের আক্রমণ এবং সবকিছু খোলা রাখার ফতোয়ার সামনে প্রতিরোধ গড়ে এদিনের প্রতিবাদ কার্যত বন্‌ধের চেহারা নিয়েছিল। পাশাপাশি বিজেপি-শাসিত আসাম-কর্ণাটক-বিহার এবং অন্যান্য রাজ্যেও বিরাট মাত্রায় প্রতিবাদ কর্মসূচি সফল হয়েছে।

পলিট ব্যুরো বলেছে, ভারতের শ্রমজীবী মানুষ, অন্নদাতা, খেতমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের এত ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখে অবশ্যই নিজেদের জাতীয়তা-বিরোধী ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী নীতিগুলিকে পরিবর্তন করা উচিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর। এই নীতিগুলিই দেশের কোটি কোটি জনগণের জীবনযাত্রাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাঁদের জীবনে ব্যাপক দুর্দশা চাপিয়ে দিচ্ছে। কৃষক ও খেতমজুরদের বি‍‌ক্ষোভে দমননীতি প্রয়োগেরও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে পলিটব্যুরো।