৫৮ বর্ষ ১৫শ সংখ্যা / ২৭ নভেম্বর ২০২০ / ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
রাজ্যে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে সফল ধর্মঘট
কলকাতায় সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে শ্রমিক সংগঠনগুলির মহামিছিল।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ পুলিশ এবং শাসকদলের হামলা, আক্রমণ, গ্রেপ্তার ইত্যাদি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘট সফল হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ‘ধর্মঘট সমর্থন করি না, কিন্তু দাবিগুলিকে নৈতিকভাবে সমর্থন করি’ - এমন দ্বিচারিতামূলক ও হাস্যকর মন্তব্য আসলে যে নরেন্দ্র মোদীকে পরোক্ষে সমর্থন, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। এদিন ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতা এবং জেলায় জেলায় অসংখ্য মিছিল হয়েছে। এন্টালি থেকে মল্লিকবাজার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মিছিলে অংশ নেন বিমান বসু, সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, কার্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী, পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড, সিপিআই (এম) নেতা কল্লোল মজুমদার, সিআইটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু সহ ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ।
এদিন সূর্য মিশ্র ধর্মঘটের ব্যাপকতা সম্পর্কে বলেন, সাম্প্রতিককালে রাজ্যে যতগুলি ধর্মঘট হয়েছে, তার মধ্যে আজ সর্বোচ্চ জনসমর্থন পাওয়া গেছে। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সর্বত্র ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। তিনি বলেন, এই ধর্মঘট শেষ নয়, আন্দোলনের শুরু। বিমান বসুও বলেছেন, ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাবের মধ্যেই স্পষ্ট - মানুষের সমর্থন।
এদিন সকাল থেকে জেলায় জেলায় রাস্তায় নেমে ধর্মঘটীরা মিছিল করেছেন, রাস্তা এবং রেল অবরোধ করেছেন। এদিন উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতেও ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিঙ জেলার অসংখ্য চা বাগানে এদিন ধর্মঘটের সমর্থনে চলে মিছিল, পিকেটিং।
পশ্চিম বর্ধমানে শিল্প শ্রমিকরা এদিন ভোর থেকেই রাস্তায় ছিলেন। রাজ্যের কয়লা শিল্পেও ধর্মঘটের বিরাট প্রভাব পড়ে। আসানসোল, রানিগঞ্জ, দুর্গাপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পথে নেমে ধর্মঘট সফল করেন। জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি লৌহ ইস্পাত কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, সিরামিক, রিফ্যাক্টারিতেও ধর্মঘটে বিরাট প্রভাব পড়েছে। এদিন হলদিয়া থেকে মহেশতলা, কোচবিহারের চকচকা থেকে নৈহাটি, চাঁপদানি থেকে ডানলপ, সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটে প্রতিবাদের সাক্ষর রাখের শ্রমিকরা।
২৬ নভেম্বর রাজ্যের প্রায় চারশো জায়গায় কৃষক, খেতমজুরদের অবরোধ-বিক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে যায় গ্রামবাংলা। শ্রমিক সংগঠনগুলির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষক সংগঠনগুলি শামিল হন ধর্মঘটে। গ্রামে বন্ধ ছিল দোকানপাটও।
লালগড়ে ধর্মঘট ভাঙতে আসা পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ।
দুর্গাপুরে ধর্মঘটীদের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ।
এদিন মেদিনীপুর থেকে ঝাড়গ্রাম যাবার পথে লালগড় থানার বালিশিরাতে ধর্মঘটের সমর্থনে পিকেটিং করেছিলেন গ্রামবাসীরা। লালগড় থানার পুলিশ হঠাৎ করে এসে হামলা চালায় এবং লাল পতাকা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভের সাথে তৈরি হয় জনরোষ। পুলিশের মারে আহত মহিলা সহ একদল যুবক পুলিশবাহিনীকে ঘিরে ধরে। মহিলারা ঝাঁটা-লাঠি নিয়ে প্রতিরোধে শামিল হন। শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদকারীদের চাপে পুলিশ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় এবং যথাস্থানে লালঝান্ডা লাগিয়ে দেয়।
পুলিশের হুমকি, শাসকদলের বাধা ইত্যাদিকে অগ্রাহ্য করেই এদিন ধর্মঘটীরা। কলকাতার রাস্তায় নেমে ধর্মঘটকে সফল করেন। শ্রমিক-কর্মচারীদের একটা বড়ো অংশ কাজ বন্ধ রেখে ধর্মঘটে যোগ দেন।
এদিকে রাজ্য প্রশাসন ধর্মঘটকে বানচাল করার জন্য কর্মচারীদের অফিসে হাজিরা দিতে বাধ্য করতে কালা আদেশনামা জারি করে। কিন্তু সেই আদেশনামা উপেক্ষা করেই অধিকাংশ কর্মচারী এদিনের ধর্মঘটকে সফল করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরগুলিতেও ধর্মঘটের অভূতপূর্ব প্রভাব পড়েছে।
পাণ্ডুয়া স্টেশনে স্বতঃস্ফূর্ত রেল অবরোধ।
এদিন কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মানুষকে ধর্মঘটে শামিল হবার জন্য গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘটে মমতা ব্যানার্জির গাত্রদাহ কেন হলো - এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ধর্মঘটীদের আন্দোলন ভাঙতে রাজ্য সরকার ভয় দেখানোর সার্কুলার জারি করে, পুলিশ দিয়ে লাঠি পেটা করে। গ্রেপ্তার করে। ধর্মঘট থেকে গণ-আন্দোলনের যে নতুন উজ্জ্বল সম্ভাবনা জেগে উঠেছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, নতুন প্রজন্মের হাজার হাজার ছাত্র-যুব আজকের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আজকের ধর্মঘট আন্দোলনের নতুন সম্ভাবনার সূত্রপাত ঘটাবে।
রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মক রূপ দেবার জন্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনগুলির পক্ষ থেকে শ্রমজীবী এবং সাধারণ মানুষকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। তাঁরা বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক-কৃষকদের দাবি না মানলে আগামী দিনে আরও ব্যাপক আন্দোলনের পথে যাবে শ্রমিক-কৃষকরা।