৫৮ বর্ষ ১৫শ সংখ্যা / ২৭ নভেম্বর ২০২০ / ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
দ্বিশতবর্ষে এঙ্গেলস
সীতারাম ইয়েচুরি
২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর মহান দার্শনিক এবং বিপ্লবী ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী দিবস। বর্তমানে প্রবল অতিমারী পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং লকডাউনজনিত কারণে বিধিনিষেধসমূহ যদি না থাকত, তাহলে ২০১৮-১৯ সালে যেভাবে আমরা কার্ল মার্কসের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করেছিলাম সেইরকমই যথাযোগ্যভাবে আমরা ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসেরও দ্বিশত জন্মবার্ষিকী দিবস উদ্যাপন করতে পারতাম।
মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার বিবর্ধন এবং সম্প্রসারণে এঙ্গেলসের তত্ত্বগত অবদান অতীব তাৎপর্যপূর্ণ; দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির বিকাশ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে, বিশ্বের বস্তুগত বিকাশ যে নিয়মাবলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তার প্রত্যেকটির দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে, প্রাণের বিকাশ, তার বিবর্তন এবং মানবসমাজের বিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়মাবলি উপলব্ধির ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের তত্ত্বগত অবদান মহামূল্য সম্পদ। তাঁর জীবন এবং সৃষ্টির বিষয়গুলি স্মরণ করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই বহুবিধ অবদানগুলিকে আমাদের চর্চায় নিয়ে আসতে হবে; একইসাথে মানবমনন, বুদ্ধিমত্তা এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁর অবদানগুলি যে সম্ভাবনাপূর্ণ প্রাথমিক প্রভাব সৃষ্টি করেছিল, সেগুলিকেও স্মরণ করতে হবে।
এঙ্গেলসের অবদানের এই বিশাল ব্যাপকতাকে মাত্র একটি প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। বর্তমান পরিস্থিতির সীমাবদ্ধ অবস্থায় আমাদের পার্টি সারাবছর ধরে এঙ্গেলসের অবদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা ও চর্চা চালিয়ে যাবে।
এই প্রবন্ধে আমি মাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই আলোচনা করব। তত্ত্ব এবং প্রয়োগকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে মিলিত করে যে চিন্তাধারার সৃষ্টি হয়েছে, কার্ল মার্কসের নামানুসারে তাকেই বলা হয় মার্কসবাদ; এক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যবশত প্রায়ই এঙ্গেলসের অবদানকে গৌণ বিবেচনা করা হয়। এইরকম সিদ্ধান্তে এলে সেটা হবে চরম ভুল এবং ভ্রান্তি। কারণ এঙ্গেলসের প্রতিটি কাজ ও সৃষ্টির দিক্ অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে বস্তুগত এবং সমাজজীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি কিভাবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও নিয়মাবলির সম্প্রসারণ ও বিবর্ধন ঘটিয়েছেন। মানবসভ্যতার অগ্রগতির বর্তমান সময়ে এবং অভূতপূর্ব নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কালে এঙ্গেলসের তত্ত্বগত অবদানের বিবিধ দিকগুলি নিয়ে সঠিক চর্চা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মার্কসবাদ যৌথভাবে সৃষ্ট
ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসকে অনেক সময়ে বিশ্বের প্রথম মার্কসবাদী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। আত্মপ্রচার বিমুখ, চারিত্রিকভাবে বিনয়ী এঙ্গেলস হয়তো গর্বের সাথেই এই মর্যাদা মেনে নিয়েছিলেন; একবার তিনি বলেছিলেনঃ ‘‘মার্কস যা সম্পূর্ণ বা সম্পাদন করেছেন, আমি তা অর্জন করতে পারতাম না। মার্কস ছিলেন আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রসর, বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সকলের চেয়ে বেশি স্বচ্ছ চিন্তা ও দ্রুততার সাথে তিনি একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে পৌঁছাতে পারতেন। মার্কস ছিলেন সহজাত প্রতিভাসম্পন্ন বাকি আমরা ছিলাম খুব বেশি হলে কর্মদক্ষতাসম্পন্ন। আজ আমরা যে তত্ত্ব পেয়েছি, মার্কস না থাকলে তা এখনও অনেক পিছিয়ে থাকত। সুতরাং, খুব সঠিকভাবেই এই তত্ত্বের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত হয়েছে।’’ এতদ্সত্ত্বেও মার্কস এঙ্গেলসের যে মূল্যায়ন করেছেন এবং মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার তাত্ত্বিক ভিত্তি বিকাশে এঙ্গেলসের যে বিশেষ স্থান নির্ধারিত করে গেছেন, তার প্রশংসা করতেই হবে।
মার্কস-এঙ্গেলসের যৌথ কাজ
মার্কস ‘Rheinnische zeitung’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৮৪৩ সালে প্রুশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮৪৪ সালের শুরুতেই মার্কস প্যারিস চলে যান। সেখানে তিনি একটি সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যুক্ত হন। সাময়িক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘Deutsche-Franzosische Jahrbucher’। এঙ্গেলস ছিলেন এই পত্রিকার তরুণতম লেখক। পরবর্তী সময়ে ওই প্রকাশনার সম্পাদনার কাজেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৪৪ সালে এঙ্গেলস ‘Outline of a Critique of Political Economy’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধে এঙ্গেলস বুর্জোয়া রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র’র সমালোচনার জন্য বুনিয়াদি নীতিসমূহ বিবৃত করেন। এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন, বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্র ব্যবস্থার মধ্যে যেসকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আমরা দেখতে পাই, তার প্রত্যেকটিরই উৎসে রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদনের উপায়সমূহের নিয়ম-নীতিগুলি। তাই দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ তখনই সম্ভব হবে, যখন উৎপাদনের উপায়সমূহ ব্যক্তিমালিকানামুক্ত হবে।এঙ্গেলসের এই পর্যবেক্ষণ মার্কসকে মুগ্ধ করেছিল। মার্কস সিদ্ধান্তে এসেছিলেন বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের সমালোচনার মাধ্যমে আরও একজন চিন্তাবিদ্, তাঁর স্বাধীন চিন্তাসূত্রেই সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন হেগেলীয় দর্শনের সমালোচনার সূত্রে যে সিদ্ধান্তে তিনিও উপনীত হয়েছেন। ওই ঘটনাই দুই মহান বৈজ্ঞানিক দার্শনিকের আজীবন সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, পারস্পরিক আস্থাকে সূদৃঢ় করে তুলেছিল এবং মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার বিবর্ধন এবং সম্প্রসারণে তাঁরা যুগ্মভাবে অবদান রেখেছেন। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব চলাকালীন শুরুর দিকে এঙ্গেলসের আলোড়ন সৃষ্টিকারী রচনা ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ মার্কসের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৪৪ সালের আগস্ট মাসে দশদিন ধরে তাঁরা দু’জন মিলিত হয়ে মতবিনিময় করেছিলেন; সেই সময়ই মার্কস এঙ্গেলসের প্রতি অতীব সপ্রশংস হয়ে ওঠেন। মার্কস এঙ্গেলসের সাহস, আত্মনিবেদন, একাগ্রতা ইত্যাদি গুণের ভূয়সী প্রশংসী হয়ে ওঠেন এবং লক্ষ করেন তৎকালীন সময়ের সমস্ত তত্ত্বগত প্রশ্নে তাঁরা দু’জনেই সহমত পোষণ করেন।
দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে’র উপর ভাববাদী মতধারার প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে মার্কস এবং এঙ্গেলস ১৮৪৪ সালে প্রথম যৌথভাবে ‘দ্য হোলি ফ্যামিলি’ রচনা করেন। এই রচনায় তাঁরা যুগ্মভাবে প্রমাণ করেন, কোনো অতি-প্রাকৃতিক শক্তি, মানবিক চেতনা বা বীরেরা ইতিহাস তৈরি করে না - ইতিহাস তৈরি করে একমাত্র শ্রমজীবী মানুষ, যাঁরা তাঁদের শ্রম এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। মার্কস-এঙ্গেলস যুগ্মভাবেই দেখিয়ে দেন, শ্রমজীবী মানুষরা চলতি জীবনযাপন অবস্থার বিলোপ না ঘটিয়ে - অর্থাৎ চলতি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিলুপ্তি না ঘটিয়ে নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন না। শ্রেণি হিসাবে শ্রমিকের মুক্তি অর্জনের ঐতিহাসিক দিশা তাঁরা দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু দার্শনিকস্তরে তখনও ভাববাদ ছিল প্রভাবশালী ভূমিকায়। তাই তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি মজবুত করা ছিল মার্কস-এঙ্গেলস উভয়ের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁরা উভয়ে একযোগে ১৮৪৫-৪৬ সালে বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি মজবুত করার কাজটি করলেন ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ রচনার মধ্য দিয়ে। এই সর্বপ্রথম অত্যন্ত বোধগম্য এবং সুসংবদ্ধ আকারে তাঁরা দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মৌল নীতিগুলিকে বিবৃত করলেন - উপস্থিত হলো শ্রমিকশ্রেণির বিশ্ববীক্ষা। প্রকৃতপক্ষে ১৮৪৩ সাল থেকে ১৮৪৫ সাল - এই কালপর্ব ছিল মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার বিবর্ধন এবং সম্প্রসারণের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ - বিপ্লবী গণতন্ত্র থেকে সর্বহারার বিপ্লবে, হেগেলীয় প্রভাব থেকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদে এবং দর্শন থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে উত্তরণের সময়কাল। এই ঐতিহাসিক কাজে মার্কস এবং এঙ্গেলস একযোগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হেগেলীয় দর্শনের সূত্রগুলি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে মার্কস সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, আইনি সম্পর্ক বা বিভিন্ন রাজনৈতিক গঠন ইত্যাদি নিজেরাই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বা মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না বরং মানুষের সামাজিক সত্তাই, বাস্তব জীবন অবস্থা তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আদর্শ সমাজব্যবস্থার প্রতিরূপ হিসাবে হেগেল ‘নাগরিক সমাজ’ শব্দটি বেছে নিয়েছিলেন; তিনি মনে করতেন, এই আদর্শ সমাজব্যবস্থা অতিপ্রাকৃত সর্বেসর্বাভাবে গড়ে উঠবে। মার্কস কিন্তু সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ‘‘এই ধরনের নাগরিক সমাজের গঠন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক, অর্থশাস্ত্রের মধ্যে খুঁজে দেখতে হবে।’’ এইখান থেকেই মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বুনিয়াদি ভিত্তিতে পৌঁছেছিলেন। তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ‘‘মানুষের চেতনা মানুষের সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে।’’
দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকে যুক্ত করেই মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের বিপ্লবী তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন; ১৮৪৮ সালে তাঁদের যুগ্মভাবে রচিত কমিউনিস্ট ইশ্তিহারে এবং প্রথম আন্তর্জাতিক গঠনের মধ্যে সেই বিপ্লবী তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা এবং মানবসমাজ জীবন
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতির বিশ্লেষণে মার্কস দীর্ঘদিন মনোনিবেশ করেছিলেন এবং দাস ক্যাপিটালের মধ্যে সেই বিশ্লেষণ চূড়ান্ত হয়। তিনি দেখান, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার দ্বারাই মানুষকে শোষণ করা হয়; সুতরাং, তাকে উচ্ছেদ করা কেবলমাত্র একটি নৈতিক কর্তব্য নয়, বরং মানুষের শোষণমুক্তির জন্য বৈজ্ঞানিক আবশ্যিকতা। এঙ্গেলসও মানব এবং সমাজবিকাশের বিভিন্ন ধারায় দ্বান্দ্বিকতার সূত্রের বিকাশ ঘটিয়ে গেছেন।
মানব এবং প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাঃ মানব এবং প্রকৃতির মধ্যে যে অবিরাম দ্বন্দ্ব চলছে, সেটাই হলো দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তি। অর্থাৎ মানুষ তার জীবন এবং বস্তুগত অবস্থার উন্নতি ঘটাবার জন্য অবিরাম প্রকৃতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় একদিকে মানুষ যেমন প্রকৃতিকে ব্যবহার ও তার পরিবর্তন ঘটায়, প্রকৃতিও সেইভাবে মানুষকে পরিবর্তন করে এবং মানবসমাজের বিবর্তনেও প্রভাব ফেলে। ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা’ প্রবন্ধে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, মানব-প্রকৃতির দ্বন্দ্ব কিভাবে বিবর্তিত হয়। তিনি দেখিয়েছেন - হাত, মানববোধ, কথা বলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রম কিভাবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের এই ক্রমবিবর্তন কোনো দৈবের দান নয়, মানুষের বস্তুগত জীবনই হলো এর ভিত্তি।
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাঃ প্রকৃতি এবং বৈজ্ঞানিক বিকাশে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কিভাবে কাজ করে এঙ্গেলস তাও বিশদভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, দ্বান্দ্বিকতা প্রকৃতি, মানবসমাজ এবং মননক্ষেত্রে গতিসূত্রাবলির বিজ্ঞান ছাড়া তার বেশি কিছু নয়।
দ্বান্দ্বিকতা এবং নৃতত্ত্ববিদ্যাঃ তাঁর সময়ে এবং মানবসমাজের প্রাথমিক অবস্থায় নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানের যেসব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল এঙ্গেলস সেগুলির বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূত্র প্রয়োগ করেছিলেন। আধুনিক শ্রেণিসমাজে যেসব কল্পকথা প্রচলিত ছিল এঙ্গেলস ‘পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের উদ্ভব’ গ্রন্থে সেইসব কল্পকথার জবাব দিয়েছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন সম্পত্তিভিত্তিক শ্রেণিসম্পর্ক কিভাবে পরিবার গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। এঙ্গেলস তাঁর ওই রচনায় আরও দেখিয়েছিলেন, নারীজাতির ঐতিহাসিক পরাজয়, এক বিবাহ, পিতৃতান্ত্রিকতা এবং তার পরিণতি কিভাবে স্ত্রীজাতির উপর অত্যাচার বৃদ্ধি করেছিল।
দ্বান্দ্বিকতা এবং ইতিহাসঃ এঙ্গেলসের ‘জার্মানিতে কৃষক সংগ্রাম (১৮৪৯-৫০)’ গ্রন্থে আমরা সর্বপ্রথম ইতিহাস বিশ্লেষণে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ দেখতে পাই।
দ্বান্দ্বিকতা এবং দর্শনঃ দার্শনিক ইউজেন ড্যুরিং মার্কসবাদকে খণ্ডন করে যে তত্ত্ব হাজির করেছিলেন এঙ্গেলস তাঁর ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ গ্রন্থে মুখের মতো জবাব দিয়েছিলেন। এঙ্গেলসের ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ গ্রন্থটি মার্কসবাদ এবং দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যথার্থতা প্রমাণে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।
সুতরাং, এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, মানবসমাজের কর্মকাণ্ডে এবং প্রচেষ্টার প্রতিটি ক্ষেত্রে এঙ্গেলস স্বাধীনভাবে ও মার্কসের সাথে যুক্তভাবে বহু ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনাপূর্ণ অবদান রেখেছেন। প্রকৃতি বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রের মাধ্যমে মানবপ্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, নৃতত্ত্ব বিদ্যা, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র এবং দর্শন - এই বিস্তৃত সমস্ত ক্ষেত্রে এঙ্গেলস তাঁর সুস্পষ্ট অবদান রেখেছেন, বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশ এবং তার তত্ত্বগত বুনিয়াদ বিকশিত করার ক্ষেত্রেও এঙ্গেলসের অবদান অপরিমেয়। এটাও লক্ষণীয় যে, মার্কস এবং এঙ্গেলস যুগ্মভাবে বা স্বাধীনভাবে যে কাজ করেছেন তা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমেই সমৃদ্ধতর হয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
মার্কস এবং এঙ্গেলস শুধু ইতিহাস সৃষ্টিকারী তত্ত্বের ভিত্তিই স্থাপন করেছিলেন তা নয়, এই দুই মহান ব্যক্তি শুধু গবেষক ছিলেন না, আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে এবং তাঁদের সময়কার শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও পথনির্দেশ করেছেন। মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠার এই দুই মহান মানুষ শ্রমিকশ্রেণির বিজয় অর্জন করে আনতে সক্ষম এমন বিপ্লবী সংগঠন গড়ার জন্যেও তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮৬৪ সালের শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সমিতি চলতি কথায় যা প্রথম আন্তর্জাতিক নামে পরিচিত বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠীকে একটি সাধারণ মঞ্চে সম্মিলিত করার সেটাই ছিল প্রথম প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আন্তর্জাতিক ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বৈজ্ঞানিক এবং বৈপ্লবিক
মার্কসের মৃত্যুর পর মূলত এঙ্গেলসের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণি এবং সমগ্র বিশ্ব মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার তত্ত্বগত বুনিয়াদ এবং সমৃদ্ধশালী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল। মার্কসের বিশাল বিশাল পাণ্ডুলিপিকে সুবিন্যস্ত ও সম্পাদন করেছিলেন এঙ্গেলস। সেই সমস্ত পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেই এঙ্গেলস ক্যাপিটাল গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রস্তুত করেছিলেন। মার্কসের মৃত্যুর পরও এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশ্তিহারের একাধিক মুখবন্ধ লিখেছিলেন। সমকালীন ঘটনা বিকাশের ভিত্তিতে এঙ্গেলস মার্কসের সাথে তাঁর যুগ্ম রচনাবলির নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে গেছেন, যার ফলে আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম এবং তার অগ্রগতি উপকৃত হয়েছে।
লেনিন বলেছিলেন, ‘এঙ্গেলস শ্রমিকশ্রেণি যাতে নিজেকে চিনতে পারে, নিজের সম্পর্কে সে যাতে সচেতন হয় সেই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। বিজ্ঞানকে তিনি স্বপ্নের জায়গায় স্থাপন করেছেন।’