৫৮ বর্ষ ১৫শ সংখ্যা / ২৭ নভেম্বর ২০২০ / ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশত জন্মবর্ষ
মার্কসবাদের সঙ্গে অচ্ছেদ্য এঙ্গেলস
মৃদুল দে
একই জার্মানির রাইনল্যান্ড প্রদেশের দুই ছোট শহরে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের জন্ম, এঙ্গেলসের চেয়ে মার্কস আড়াই বছরের বড়। জার্মানির মধ্যে তখন রাইনল্যান্ডই একমাত্র শিল্পোন্নত, এর একটা পটভূমি আছে। কয়লা লোহা খনিজ সম্পদও এখানে আছে। ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯-১৭৯৯ গোটা ইয়োরোপকে নাড়িয়ে দেয়। আড়াই কোটি মানুষের দেশ ফ্রান্স দারিদ্র্য, বেকারি, আর্থিক সংকটে জর্জরিত, পুরনো সামন্ত রাজতন্ত্র জরাজীর্ণ, উদীয়মান পুঁজিপতিশ্রেণির আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। ‘স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের’ স্লোগান-এ সফল বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণতন্ত্র। রাইনের বামপ্রান্ত দখল করে ফ্রান্স, নেপোলিয়ন ১৮০১ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত করে, দক্ষিণ অংশও ফ্রান্সের প্রভাবিত। ১৮১৫ সালে ফ্রান্সের প্রভাবমুক্ত হলেও রাইনল্যান্ডে ঘটে যায় বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন। জার্মানি ও ফ্রান্স উভয় সংস্কৃতি ভাষা ইত্যাদি প্রভাব পড়ে এখানে। জার্মানির মধ্যে এখানেই সামন্তপ্রথা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। অন্যদিকে আধুনিক শিল্পের পুঁজিপতিশ্রেণি ও নতুন শ্রমিকশ্রেণির দ্বন্দ্বও তীব্রতর হতে থাকে। জার্মানি জুড়ে তখন দার্শনিক বিতর্কেও আলোড়িত যুবসমাজ ও বিদ্বৎমহল। আবার ফরাসি বিপ্লবে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বিকাশের প্রভাব পড়ে এখানে। এই পরিবেশেই মার্কস ও এঙ্গেলসের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা। মহান ব্যক্তিদের আবির্ভাব হয় যেখানে এবং যখন তাঁদের মহৎ কাজের জন্য পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়। মার্কসবাদের স্রষ্টাদের নতুন আবিষ্কারের এটা আদর্শ ক্ষেত্র।
দার্শনিক জগতে কান্ট থেকে হেগেল চিন্তার জগতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। হেগেলের যখন মৃত্যু হয়, তখন মার্কস ১৩ বছর বয়সের এবং এঙ্গেলস ১১ বছর বয়সের ছাত্র। কোনো কিছুই শাশ্বত বা স্থায়ী নয়, সবই পরিবর্তনশীল, দ্বন্দ্বের মধ্যেই বিকাশ - এই দার্শনিক তত্ত্বই দু’প্রান্তে আকৃষ্ট করে ছাত্র মার্কস ও এঙ্গেলসকে। মার্কস সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্ত পরিবারের, পিতা পেশায় আইনজীবী, সাধারণ ধার্মিক। এঙ্গেলসের পিতা ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি এবং ধর্মে গোঁড়া, বুদ্ধিমতী মা পর্যন্ত এই গোঁড়ামির ভয়ে কাঁপে। এঙ্গেলস ছাড়া বাকি তিন পুত্র নেয় ব্যবসার পথ, চার কন্যারও বিয়ে হয় ব্যবসায়ী পরিবারে। এঙ্গেলস কেবল ব্যতিক্রম। তর্ক ও যুক্তির যুদ্ধ শৈশব থেকে তাঁর মধ্যে গভীর। ১৫ বছরের পুত্র এঙ্গেলসের কথাবার্তা, ভাবগতিক দেখে বাবা শঙ্কিত। দুর্লভ গুণের অধিকারী এঙ্গেলস ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, ভাষা, সঙ্গীত, কবিতা, কার্টুন, ক্রীড়া ইত্যাদি দিয়েই পড়ে থাকে, অন্য কোনদিকে মন নেই। ক্ষিপ্ত বাবা ১৭ বছর বয়সের এঙ্গেলসের স্কুলশিক্ষা সমাপ্ত করার আগে জ্যৈষ্ঠ পুত্রকে বড় ব্যবসায়ী করার জন্য ব্যবসাবাণিজ্য শিখতে সমুদ্রবন্দর ব্রেমেন-এ বড় এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন; ব্যবসাও শিখবে, এলাকায় সঙ্গীসাথীদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হবে।
এঙ্গেলস ব্রেমেন-এ গিয়ে অফিসে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে বাকি সময়ে পড়াশোনা, শ্রমিকদের সঙ্গে মেলামেশায় নিমগ্ন হন, জার্মানিতে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল বই-ও জোগাড় করেন। এ সময়ে ইয়োরোপের বিভিন্ন ভাষা শিখতে পড়তে নিজেকে সর্বক্ষণ নিযুক্ত করেন। দ্রুত ল্যাটিন, গ্রিক, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ইংরেজি, পর্তুগিজ ও ডাচ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে ওসব ভাষায় পত্রিকা ও রাজনৈতিক সাহিত্য পড়তে শুরু করেন তীব্র আগ্রহ ও নতুন নতুন জানার তৃষ্ণা নিয়ে।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মার্কসও বন ও পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বামপন্থী হেগেলিয়ান গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে লড়াই করে সবাইকে মাতিয়ে তুলছেন। ইতিহাস ও দর্শনেই তাঁর মনোযোগ বেশি, তার ভিত্তিতে হেগেলের দর্শন থেকে বিপ্লবী উপাদান খুঁজতেই মগ্ন। ধর্মতত্ত্ব ও ‘পরমের অভিমুখে সবকিছুই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিবর্তিত’ হেগেলীয় দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লুদবিগ ফয়েরবাখ দার্শনিক লড়াই করছেন। এত প্রগতিশীল পদ্ধতি ও গভীর জ্ঞান সত্ত্বেও হেগেলের মত হলো পৃথিবী সৃষ্টির আগেই এক ‘পরম ভাবধারা’ নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতি ও সমাজের বিকাশ। ফয়েরবাখ তাঁর দর্শন ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন অতিপ্রাকৃতিক কোনো ভাবধারা নয়, প্রকৃতিই প্রাথমিক এবং, ভগবান মানুষ সৃষ্টি করেনি, মানুষই তার কল্পচিত্র দিয়ে ভগবান সৃষ্টি করেছে। এঙ্গেলস এসম্পর্কে পরে লিখেছেন, ‘তখন মার্কসসহ আমরা বামপন্থী হেগেলবাদীরা ফয়েরবাখিয়ান হয়ে গেলাম।’ এজন্য ফয়েরবাখ অধ্যাপক পদ খোয়ালেন। বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী মার্কসসহ বামপন্থী সকলেই ব্রাত্য। রাইনল্যান্ডের কলোন শহর থেকে প্রকাশিত হয় কিছু উদারনৈতিক বুর্জোয়ার একটি পত্রিকা যারা বামপন্থী হেগেলবাদীদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে একমত। ১৮৪২ সালে মার্কস হলেন তার প্রধান সম্পাদক, এঙ্গেলসও লিখেছেন। পত্রিকার ধারালো লেখা সর্বত্র সাড়া জাগায়। তিনমাসের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের সেন্সরশিপ ও এর পরপরই বন্ধ করে দেবার ফতোয়া। মার্কস চলে যান প্যারিসে একটি প্রগতিশীল পত্রিকা প্রকাশ করতে। দর্শন, ইতিহাস, সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে মার্কস অসাধারণ লেখা লিখে চলেছেন।
তরুণ এঙ্গেলসের রাজনৈতিক বিবর্তনের সময়টা পশ্চিম ইয়োরোপে, ১৮৩০’র দশকে পশ্চিম ইয়োরোপে শ্রমিকদের তীব্র শ্রেণিসংগ্রামের পর্বে। প্রথম ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লব দিয়ে সূত্রপাত। এই প্রথম ‘সমাজবাদ’ শব্দটি উচ্চারিত ও প্রচলিত হয়। ইতালি, স্পেন, পোল্যান্ড, বেলজিয়ামে অভ্যুত্থান। ইংলন্ডে নির্বাচনী ও সংসদীয় সংস্কারের জন্য শ্রমিকদের দাবিকে বুর্জোয়াশ্রেণির একটা বড়ো অংশ সমর্থন পরে পিছিয়ে যায়, এখান থেকে প্রথম জন্ম নেয় শ্রমিকশ্রেণির স্বাধীন আন্দোলন - চার্টিজম। ১৮৪১ সালে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে এঙ্গেলস যান বার্লিনে, তখন মতাদর্শগত বিতর্কে উত্তপ্ত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও বিতর্কে যোগ দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন তিনি। সামরিক আর্ট তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর সারাজীবন সামরিক বিজ্ঞান তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। মার্কস তখন বার্লিনে মেধা ও প্রজ্ঞায় অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছেন, কিন্তু এঙ্গেলস বার্লিন পৌঁছানোর আগেই মার্কস বার্লিন ছেড়ে চলে যান। বিতর্কে ছদ্মনামে এঙ্গেলস অনেক তত্ত্বগত বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেন। দেড় বছরে সামরিক কাজের পর্ব ছেড়ে বাড়ি এলে তাঁর বাবা তাঁকে পরিবারের ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাণিজ্যিক দক্ষতা অর্জনের জন্য ইংলন্ড পাঠিয়ে দেন। ছদ্মনামে লেখা লিখলেও তাতে এঙ্গেলসের বিপ্লবী অভিমত বাবার নজর এড়ায়নি, তাছাড়া জার্মানিতে ১৮৩০’র গোড়া থেকে বিপ্লবী পরিস্থিতি ঘনীভূত হচ্ছিল। এই প্রস্তাবে এঙ্গেলস আপত্তি করেছিলেন বলে জানা যায় না। তবে এই প্রস্তাব ইংলন্ড নিয়ে তাঁর আগ্রহের সঙ্গে খাপ খায়। কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শিল্পবিপ্লব সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয় ইংলন্ডকে, সে দেশই একমাত্র পুঁজিবাদের ও বৃহদায়ন আধুনিক যন্ত্রশিল্পের জন্মস্থান।
দেখা যায়, ইংলন্ডে তাঁর অবস্থান এই যুবকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ম্যাঞ্চেস্টার আবার ব্রিটেনের প্রধান শিল্পকেন্দ্র। একদিকে শ্রমিকদের কষ্ট ও দুর্দশা, অন্যদিকে সম্পত্তিবান শ্রেণির বিরাট আর্থিক ঐশ্বর্যবৃদ্ধি ও রাজকীয় বিলাস - এই বৈপরীত্য এবং বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব ব্রিটেন ছাড়া অন্য কোথাও এত প্রকট ছিল না। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা এঙ্গেলসকে টেনে নিয়ে যায় বিপ্লবী ভাবনার জগতে নতুন নতুন সৃষ্টির কাজে। বই, পুঁথি, পত্রিকা, সরকারি দলিল ও পরিকল্পনা ইত্যাদির চেয়ে বেশি সক্রিয়ভাবে শ্রমিকদের জীবন, মানসিকতা, তাঁদের লড়াইয়ের পদ্ধতি ইত্যাদিতে তিনি মনোনিবেশ করেন। কোনমতে অফিসের কাজ চুকিয়ে লন্ডন, ম্যাঞ্চেস্টার, লিডস-এর ঘিঞ্জি রাস্তায়, শ্রমিক বস্তিতে, ভাঙাচোরা শ্রমিকদের কোয়ার্টারে তাঁর উৎসাহী বিচরণ। ম্যাঞ্চেস্টারে কখনও সঙ্গী হতেন আইরিশ মহিলা শ্রমিক মেরি বার্নস, যিনি হন পরে জীবনসঙ্গিনী। ইংলন্ডে তিনি যুক্ত হয়ে যান শ্রমিকদের শক্তিশালী চার্টিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে - প্রথম বৃহৎ ব্যাপক সত্যিকারের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলন। তাদের মুখপত্রেও তিনি ইয়োরোপে শ্রমিক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখতে থাকেন। সমস্ত গবেষণা থেকে ব্রিটেনে সামাজিক সম্পর্ক এবং শ্রমিকশ্রেণির জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে বিখ্যাত বই লেখেন, ‘ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’। ১৮৪৪ সালে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে বাড়ি যাবার পথে তিনি প্যারিসে যান। সেখানে মার্কসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দশদিন একসঙ্গে কাটান। এই দশদিন অনন্য সাধারণ বন্ধুত্ব এবং জীবনভর দুই সেরা চিন্তাবিদের অন্তরঙ্গ অচ্ছেদ্য বন্ধনের প্রারম্ভ - যা পরিণামে দুনিয়াকে দেয় মানবমুক্তির অমোঘ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং বিপ্লবী আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশলের ভিত্তি। মার্কসের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই ১৮৪৫ সালে জার্মানিতে বইটি প্রকাশিত হয়।
বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের অভিমুখে প্রথম লেখাগুলির মধ্যে এটি প্রধান একটি। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের উৎস চিহ্নিত করা যায় জার্মান চিরায়ত দর্শন থেকে - সমাজবিকাশে অর্থনৈতিক উপাদান সম্পর্কে উপলব্ধি অর্থাৎ ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই গবেষণাপত্রে উন্মোচিত হয়ঃ আধুনিক বৃহদায়ন যন্ত্রশিল্প ও সর্বহারার উদ্ভব, পুঁজিবাদী উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সূত্র, পর্যায়ে পর্যায়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট, বিরাট বেকারবাহিনী, পুঁজিবাদী উৎপাদনের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী জনসাধারণের ওপর আরও বেশি শোষণ, শ্রমিকদের দুর্দশা, শোচনীয় মজুরি, দিনের দীর্ঘসময় ধরে কারখানার কাজ, বাসঅযোগ্য ঘরবাড়ি, মহিলা ও শিশু শ্রমিকদের ওপর নির্মম শোষণ; বুর্জোয়া ও সর্বহারাশ্রেণির স্বার্থ পরস্পরবিরোধী ও চিরকালীন সমাধান-অসাধ্য সম্পর্ক। আধুনিক মজুরিপ্রাপক শ্রমিকের সঙ্গে অতীতের ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের মধ্যে মৌলিক যে পার্থক্য এঙ্গেলস বর্ণনা করেছেন, একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়েও তা সমান অর্থবহঃ ‘‘দাসমালিকরা তাদের ব্যক্তিস্বার্থেই দাসদের জন্য যৎসামান্য জীবননির্বাহের খোরাক নিশ্চিত করে; ভূমিদাসদের বাঁচার জন্য কমপক্ষে এক টুকরো জমি থাকে; অত্যন্ত শোচনীয় হলেও প্রত্যেকের জীবনরক্ষার জন্য একটা গ্যারান্টি আছে। কিন্তু সর্বহারাদের কেবল নিজেদের ওপরই নির্ভর করতে হবে, এবং তবুও, নিজেদের ওপর নির্ভর করার জন্য তার দক্ষতা প্রয়োগ থেকে সে বঞ্চিত হয়।’’ একইভাবে, এঙ্গেলসও দেখিয়েছেন শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে অন্যান্য নিপীড়িত ও শোষিত শ্রেণিগুলির পার্থক্য - কেবলমাত্র তার চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতা ও ভবিষ্যতের নিরন্তর অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রেই নয়। শ্রেণি হিসেবে তিনি তুলে ধরেন সর্বহারাদের ঐক্য ও সংগঠনের শক্তিকে যা পুঁজিবাদের অবসানে ঐতিহাসিক লক্ষ্যপূরণের প্রয়োজনীয় শর্ত। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সমাজবাদকে সম্পৃক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার তিনি তুলে ধরেছেন।
এই অসাধারণ বই প্রকাশের আগে ‘গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমজীবী শ্রেণিগুলির উদ্দেশ্যে’ তিনি যা লিখেছেন, সেটাই তাঁর এই বই-এর উপক্রমণিকাঃ ‘‘তোমাদের বাড়িতেই আমি তোমাদের দেখতে চাই, তোমাদের প্রাত্যহিক জীবন পর্যবেক্ষণ করতে চাই, চাই তোমাদের অবস্থা তোমাদের ক্ষোভ নিয়ে আলোচনা করতে, তোমাদের অত্যাচারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে তোমাদের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করতে চাই।’’ কোম্পানির নৈশভোজ, আমোদপ্রমোদ বর্জন করে অফিস কাজের বাইরে প্রায় সমস্ত সময় সাধারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যই শুধু সময় ও এনার্জি ব্যয় করার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘‘একাজের মধ্য দিয়ে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।’’
অসাম্য ও শোষণের অবসানের কথা গ্রিক দার্শনিক থেকে যুগে যুগে অনেক মনীষী ও দার্শনিক তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে নিপীড়িত মানুষের দুঃখকষ্ট ও জীবনসংগ্রামের যোগ ছিল না। শোষণমুক্তির পথ সম্পর্কে তাঁরা তাঁদের কল্পনা দিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন। তাঁরা দেখেননি আধুনিক পুঁজিবাদ ও আধুনিক শিল্প, এই পুঁজিবাদের সৃষ্ট আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির ওপর নতুন শোষণ পদ্ধতি। তাঁদের মূল্যবান অবদানকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তাঁদের চিন্তার এই সীমাবদ্ধতা পরিষ্কার করে মুক্তির নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবী তত্ত্বের আবিষ্কারক মার্কস এবং এঙ্গেলস। একমাত্র যোগ্য ও বাছাই করা ব্যক্তিত্বই ইতিহাস তৈরি করে, এরকম তত্ত্ব ও বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে ১৮৪৫ সালে মার্কস-এঙ্গেলস ‘দি হোলি ফ্যামিলি’ বইতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের একটি মৌলিক সূত্র তুলে ধরেছেন, যেমন, ‘মহান ব্যক্তিরা’ নন, জনগণই ইতিহাসের আসল স্রষ্টা।
১৯৪৫ সালে মার্কসের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের পর এঙ্গেলস দেখলেন, মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে তৈরি করেছেন। তাঁরা তাঁদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি একজায়গায় সন্নিবিষ্ট করার কাজে হাত দেন যার নাম ‘দি জার্মান আইডিয়োলজি’। বইটির জন্য কোনো প্রকাশক পাওয়া যায়নি। মার্কস লিখেছিলেন, ‘ওই পাণ্ডুলিপি আমরা পোকার জন্য ফেলে দিয়েছি, কারণ আমাদের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে - আত্ম-ব্যাখ্যা।’ ১৯৩২ সালে এই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে জার্মান ভাষায় বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইতে বর্ণিত এই আবিষ্কারই ইতিহাসকে খাঁটি বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করে; বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভিত্তি - দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ - নির্মাণ করে এই গ্রন্থই। এই ভাবনাচিন্তাই সংক্ষিপ্ত, সহজসরল ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় ১৮৪৫ সালে মার্কসের বিখ্যাত লেখা ‘ফয়েরবাখ সম্পর্কে গবেষণাপত্র’-এঃ ‘‘দার্শনিকরা কেবলমাত্র দুনিয়াটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন; আসল কথা অবশ্য তাকে পরিবর্তন করা।’’
মার্কস ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে এঙ্গেলস।
মার্কস-এঙ্গেলসের দশদিনের সাক্ষাৎ ও পরবর্তী মতবিনিময় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দু’দিক থেকে চিন্তায় ভাবনায় ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর, মানবমুক্তির বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দার্শনিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সমাজতান্ত্রিক সবদিক থেকেই তাঁরা এক বিন্দুতে এসে পৌঁছান। মতাদর্শগত বিতর্কের মধ্যে তাঁরা শানিত লড়াই পরিচালনা করেন একসঙ্গে। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের মধ্যে জার্মান কমিউনিস্ট লিগ ছাড়াও সমাজতন্ত্রের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রামরত নানা গোষ্ঠীকে তাঁরা এক সুরে নিয়ে আসার জন্য ১৮৪৫-৪৭ সালে সর্বাত্মক চেষ্টা করে সফল হন। এখান থেকে ১৮৪৮ সালে তাঁদের অমর সৃষ্টি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। এঙ্গেলসেরই দেওয়া নাম যা মার্কস গ্রহণ করেন। ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি যেন কয়েক খণ্ড রচনার ঘনীভূত সারপদার্থ। পৃথিবীর সব ভাষাতে এবং সব দেশে প্রচারিত এই ইশ্তিহার। তার বার্তা সঞ্চারিত হয়ে চলেছে ১৭০ বছর ধরে।
১৮৪৮-৫০ আবার বিপ্লবী অভ্যুত্থান। প্রথমে ফ্রান্সে, পরে ছড়িয়ে যায় পশ্চিম ইয়োরোপের সব দেশে। মার্কস-এঙ্গেলস ছুটে যান জার্মানিতে। প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁরা শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। মার্কস আগেই প্রুশিয়ার নাগরিকত্ব হারান, এবার তাঁকে বিতাড়িত করা হলো। তিনটি ক্ষেত্রে সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে এবং বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর আটকের চেষ্টা ব্যর্থ করে এঙ্গেলস সুইৎজারল্যান্ড হয়ে পালিয়ে যান লন্ডনে। মার্কসও লন্ডনে। উভয়ের আর্থিক সামর্থ্য নিঃশেষ। পৃথিবীর বিরল প্রতিভাধর বন্ধু মার্কসকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে বহু আবিষ্কারের কাজ বাকি। এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে ফিরে গেলেন পুরনো কাজে, মার্কসকে আর্থিক সহায়তা করতে। মার্কস ডুবে গেলেন গবেষণায়, ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে। লেনিন এ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘এঙ্গেলসের একটানা নিঃস্বার্থ আর্থিক সাহায্য যদি না থাকতো, মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ বা ‘পুঁজি’ গ্রন্থের কাজ সম্পূর্ণ করতেই শুধু অক্ষম হতেন না, অভাবের জন্য অনিবার্যভাবেই ধ্বংস হয়ে যেতেন।’ লেনিনের কথায়, পৌরাণিক রূপকথার গল্পের অসাধারণ বন্ধুত্বের চেয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের এই বন্ধুত্ব ছিল অনেক বেশি মহান। দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে সহকর্মী অনেকেই কুৎসার বন্যা বইয়ে দিয়েছে, উভয়েই ‘কোণঠাসা, পরিত্যক্ত’ বলে এবং এঙ্গেলসকে ‘ব্যবসায়ী’ বলে গালমন্দ করতে থাকে। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস তাতে আমলই দেননি। উন্নত তাত্ত্বিক গবেষণায় ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁরা আচ্ছন্ন, সেখানে অন্য কিছু তাঁদের বিচলিত করে না। মার্কসের কন্যা ইলিয়েনর পরে এঙ্গেলস সম্পর্কে বলেছেন, কুড়িটা বছর এভাবে একটা মানুষ মহৎ লক্ষ্য নিয়ে হাসিমুখে কাটিয়ে দিতে পারেন ভাবাই যায় না।
কিন্তু এঙ্গেলসের পাঠানো সামান্য অর্থে মার্কসের দারিদ্র্য ঘোচার নয়। দারিদ্র্য কেড়ে নিয়ে গেল তাঁর দুই সন্তানের প্রাণ। আট বছরের পুত্র এডগার ছিল বিস্ময়বালক, অসম্ভব প্রতিভাবান, এঙ্গেলসের সর্বসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও তারও মৃত্যু হয়। অবশেষে ‘নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ থেকে মার্কসের পরিচিত সম্পাদিকার মাধ্যমে লেখার আবেদন আসে। কিন্তু মার্কস তখনও ইংরাজিতে দক্ষ নন। মার্কসের আবেদনে এঙ্গেলসই মার্কসের নামে, নামহীন বা সম্পাদকীয় আকারে অনেক লেখা পাঠালেন পরে যার একটা অংশ ‘জার্মানিতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’ শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। অফিসের কাজের বাইরে এঙ্গেলস বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষতঃ সামরিক বিষয়ে অসংখ্য লেখা লেখেন। তার মধ্যে আছে ১৮৫৭-৫৮ সালে চীনকে দখল করার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আফিম যুদ্ধ, পারস্য, ভারত, আফগানিস্তান, আফ্রিকার পরাধীনতার বিরুদ্ধে জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধ ও সামরিক আর্ট এবং বিভিন্ন বিষয়ে মার্কসের প্রবন্ধ রচনায় প্রভূত সাহায্যও তিনি করেছেন। ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ বইতে যুদ্ধ ও সামরিক আর্ট নিয়ে মার্কসীয় ধারণা তিনি সূত্রায়িত করেন।
১৮৫০-১৮৭০ পর্যন্ত এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টারে অতিবাহিত করার পর চলে আসেন লন্ডনে। ১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের যৌথ বৌদ্ধিক ও বিপ্লবী জীবনের বিশাল কর্মকাণ্ড বিপ্লবী ইতিহাসে অপরিসীম ও অক্ষয় অবদান রেখে গেছে। মার্কসের দিক থেকে তার সেরা ফসল এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ‘ক্যাপিটাল’, এসময়ে এঙ্গেলসও ছোটোবড়ো অনেক গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন। ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের বিশাল কাজ মার্কস সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের খসড়া রেখে যান, সঙ্গে আরও অনেক অবিন্যস্ত লেখা ও নোট। দিনরাত পরিশ্রম করে ভগ্ন স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করে এঙ্গেলসের নিঁখুত সম্পাদনায় দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৮৫ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। চতুর্থ খণ্ডের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। মার্কসের হাতের লেখা, নোট, অসংখ্য কাব্যিক ব্যঞ্জনা, বিভিন্ন ভাষার প্রবাদ, নানা ভাষা ও সাহিত্যের মণিমুক্তোর প্রয়োগ উদ্ধার করে এঙ্গেলস ছাড়া কারও পক্ষে সম্পাদনা করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে প্রথম খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদ ভাষা বিশেষজ্ঞরা করলেও এঙ্গেলসকেই শেষ পর্যন্ত এই অনুবাদ করতে হয়েছে। কার্যত, লেনিনের কথায় ‘ক্যাপিটাল’-র দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড মার্কস এবং এঙ্গেলসেরই। এঙ্গেলস সবসময়েই এবং যথার্থভাবেই নিজেকে বিবেচনা করতেন মার্কসের পরে, কখনই ভুলেও সমকক্ষ বিবেচনা করতেন না। এঙ্গেলস পুরনো এক বন্ধুর কাছে লিখেছিলেন, ‘মার্কসের জীবদ্দশায় আমি তাঁর অধীনের ভূমিকা পালন করেছি’।
১৮৪৮-৪৯ আন্দোলনের পর প্রবাসে তাঁরা কেবল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গবেষণা নিয়ে আবদ্ধ ছিলেন না। ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজেও তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তীব্র মতাদর্শগত লড়াই পরিচালনা করে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেছেন। ১৮৭০ দশকের গোড়ায় এই ‘আন্তর্জাতিক’ বন্ধ করে দিতে হলেও বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ করার ভূমিকায় তাঁরা অবিচলিত ও সচেষ্ট ছিলেন। আন্তর্জাতিক ‘মে দিবস’ এঙ্গেলসের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের উজ্জ্বল ঐতিহাসিক অধ্যায়। মার্কসের মৃত্যুর পর সব দেশের সমাজতন্ত্রীরা এঙ্গেলসের প্রতিভা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে মূল্যবান পরামর্শ নিয়ে চলতেন। মার্কস-এঙ্গেলস শেষদিকে রাশিয়ায় বিপ্লবী পরিস্থিতির সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি দেন এবং রুশ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, তাঁরা রাশিয়ান ভাষা পড়তে ও বলতে পারতেন। রাশিয়ায় রাজনৈতিক বিপ্লব গোটা ইয়োরোপের শ্রমিক আন্দোলনে প্রচণ্ড অনুপ্রেরণা জোগাবে - এই বার্তা তাঁরা দিয়ে যান। এঙ্গেলস শেষ সময় পর্যন্ত রুশ বিপ্লবীদের সহায়তা দেন।
শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তিও দুর্বল হয়ে আসে এঙ্গেলসের। তবুও সজাগ ছিলেন বিশ্বের পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীতে, লক্ষ্য করেন পুঁজিবাদের সংকট ও একচেটিয়া পুঁজির উদ্ভবের উষা। একসময় লুঠ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিভিন্ন দেশের পুঁজিপতিশ্রেণি যে যুদ্ধেও লিপ্ত হতে পারে, এ সম্ভাবনাও এঙ্গেলসের দৃষ্টি এড়ায়নি। লেনিনের ভাষায়, এই বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎবাণী কতটা সার্থক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধই তার প্রমাণ।
২০টি ভাষা জানা ও পড়তে পারা এবং ১২টি ভাষায় সাবলীলভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে লেখা, পড়া, বলা - এঙ্গেলসের ছিল বিরল প্রতিভা। ভাষার উদ্ভব নিয়ে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক সংক্ষিপ্তসার তাঁর অসমাপ্ত প্রবন্ধে দেখা যায় - ‘বানর থেকে মানুষে রূপান্তরে শ্রমের ভূমিকা’। বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার নিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’’।
মার্কসের মৃত্যুর পর ১২ বছর সময়ে এঙ্গেলস মার্কসের অসাধারণ অবদান রক্ষা করতেই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। নিজের সেরা দুই অবদানের মধ্যে একটি হলো ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’। এঙ্গেলস বলেছেন, এটি হলো মার্কসের ‘একটি উত্তরাধিকারের’ পূর্ণতাদান। মার্কস লুই মর্গানের ‘প্রাচীন সমাজ’ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যের নোট রেখে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় এ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে মার্কসের নোট এবং মর্গানের বই পড়ে এঙ্গেলস এই বইয়ের কাজ সম্পূর্ণ করেন। লেনিন এই অবদানকে বর্ণনা করেন ‘আধুনিক সমাজবাদের অন্যতম এক মৌলিক কাজ’ এবং ‘এর প্রতিটি বাক্য ... নিঃসংশয়ে গ্রহণ করা যায় এই আস্থায় যে খাপছাড়া কোনো কিছু এখানে বলা হয়নি, বিরাট ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে এই মৌলিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে।’’ ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণাকে এঙ্গেলস এর মধ্য দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যান। শ্রেণিচরিত্রের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্র - এই মিথ্যা বুর্জোয়া তত্ত্বের মুখোশ খুলে দিয়ে এঙ্গেলস ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম দিয়ে দেখান শ্রেণিবিভক্ত সমাজ শ্রেণিদ্বন্দ্ব সমাধানেরই অতীত এবং এ ধরনের সমাজে রাষ্ট্র হলো নিপীড়িত শ্রেণিগুলিকে শাসকশ্রেণির হাতে দমন ও শোষণের জন্য অস্ত্রমাত্র। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা তাতে রয়েছে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ - ‘লুদবিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত দর্শনের অবলুপ্তি’, যেখানে তিনি দেখান মার্কসবাদের সঙ্গে তার পূর্ববর্তী সব দার্শনিক তত্ত্বের মৌলিক পার্থক্য। মার্কসবাদকে রক্ষা করতে সংস্কারবাদী, পেটি-বুর্জোয়া অতিবিপ্লবী এবং অন্যান্য সব ঝোঁক ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে মার্কসের পর আমৃত্যু তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। রুশ বিপ্লবীদেরও এ সম্পর্কে তিনি সতর্ক করে দেন। ১৮৯৩ সালে লন্ডনে এঙ্গেলসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের কথা বর্ণনা করে রুশ লেখক ও বিপ্লবী আলেক্সি ভোদেন লিখেছেন, এঙ্গেলসের বক্তব্য - ‘‘রাশিয়ানরা, শুধু রাশিয়ানরা নয়, সকলেই যেন মার্কস এবং তাঁর (এঙ্গেলস) কাছ থেকে উদ্ধৃতি কুড়িয়ে না নেন, মার্কস তাঁদের জায়গায় থাকলে কী ভাবতেন, সেটাই যেন তারা চিন্তা করে এবং এই অর্থেই একমাত্র ‘মার্কসবাদী’ শব্দ অর্থবহ।’’ মার্কসবাদ কোনো ধরাবাঁধা সূত্র নয়, এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের হাতিয়ার মার্কসবাদ ও তার বিজ্ঞান। মার্কসের মৃত্যুর পর কার্ল মার্কসের শ্রেষ্ঠ দুই আবিষ্কার নিয়ে এঙ্গেলস বলেছেনঃ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতায় এঙ্গেলস খুব সাবধান থাকতেন আগন্তুক ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সম্পর্কে। মার্কস-এঙ্গেলসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মার্কসের কন্যা ইলিয়েনর মার্কস লিখেছেন, ‘‘একটা জিনিসকে এঙ্গেলস কখনই ক্ষমা করতেন না - সেটি হলো চাতুরি। যে লোক নিজের সঙ্গে চালাকি করে এবং তার পার্টির সঙ্গে আরও বেশি চালাকি করে তাকে কখনই এঙ্গেলস ক্ষমা করতেন না।’’
মার্কসকে বাদ দিয়ে এঙ্গেলস হয় না, এঙ্গেলসকে বাদ দিয়েও মার্কস অসম্পূর্ণ। অবদানের অফুরন্ত ভাণ্ডার ছাড়াও তাঁদের চিঠিপত্রে আলোচিত হতে দেখা যায় দর্শন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবাদ, রাজনৈতিক অর্থনীতি, ভাষাতত্ত্ব, অঙ্কশাস্ত্র, প্রযুক্তি, সাহিত্য, কাব্য, সামরিক বিষয় - এককথায় - ‘দ্বান্দ্বিকতা’। মতের এই আদানপ্রদানের বিশাল ভাণ্ডারকে বলা যায় এক ‘সৃজনশীল পরীক্ষাগার’, যা ২০০ বছরে আরও দেদীপ্যমান।