E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৫শ সংখ্যা / ২৭ নভেম্বর ২০২০ / ১১ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসঃ অ্যান্টি ড্যুরিং

দেবেশ দাস


ইউজেন কার্ল ড্যুরিং ছিলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের গন্ডগোলে তিনি প্রফেসর পদ পাননি, যে পদে ছিলেন, সেটা রিডারের সমতুল্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের প্রথমদিকে অনেক বিপ্লবীও নতুন কথাবার্তা নিয়ে কিছু দর্শনের কথা বললেন যা জার্মানিতে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ড্যুরিংয়ের বইগুলি জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স পার্টির অনেক নেতার মধ্যেও সাড়া জাগায়। মার্কস প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিকের গাইডলাইন মেনেই ১৮৬৯ সালের আগস্ট মাসে এই পার্টি তৈরি হয়েছিল, যার ভিত্তি ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এই পার্টির মুখপত্রের নাম ছিল ‘ভোল্কসস্টাট’, তার সম্পাদক ছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলসের খুব ঘনিষ্ঠ উইলহেলম লিবনেখট। এই পত্রিকায় ড্যুরিং’কে ‘এক নতুন কমিউনিস্ট’ নামে অভিহিত করে লিখলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স পার্টির আরেক নেতা, মার্কস ও এঙ্গেলসের খুব ঘনিষ্ঠ অগাস্ট বেবেল। ড্যুরিং-র বইয়ের থেকে অনেক উদ্ধৃতিও ভোল্কসস্টাট পত্রিকায় ছাপা হয়। তারপরে ড্যুরিং যখন মার্কসকে অভদ্র ও নির্বিচারভাবে আক্রমণ করতে শুরু করলেন, লিবনেখট এঙ্গেলসকে ১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫ লিখলেন - “আমাদের লোকেদের অনেকে তার ভাল খপ্পরে পড়েছে ও এর ভালোভাবে একটা জবাব দেওয়া দরকার”।

এঙ্গেলস তখন বেশ ব্যস্ত। তিনি ১৮৭৩ সাল থেকে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও তার দ্বন্দ্বতত্ত্ব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। ১৮৭৬ সালের মে থেকে আগস্টে এঙ্গেলস তাঁর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে রামসগেট বলে সমুদ্রের ধারে একটা জায়গায় যান। সেখানে বসে ড্যুরিং-র বইগুলি পড়েন - এ কোর্স ইন ফিলসফি, এ কোর্স ইন পলিটিক্যাল আন্ড সোশ্যাল ইকনমি, এ ক্রিটিকাল হিস্টি অফ পলিটিক্যাল ইকনমি অ্যান্ড সোশ্যালিজম ও অন্যান্য বই। তখনি ভাবেন, এর জবাব দিতে হবে। সেই অনুযায়ী তাঁর পরপর তিনটি প্রবন্ধ বের হয় ১৮৭৭-র জানুয়ারিতে ভোরওয়ার্টস (ভোল্কসস্টাট পত্রিকার নতুন নাম) পত্রিকায়। কিন্তু তাতে অনেক আপত্তি ওঠে। কারণ ততদিনে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তখন আর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স পার্টি নেই, মার্কস ও এঙ্গেলসের আপত্তি সত্ত্বেও সেটা আরেকটি পার্টির সাথে মিশে নতুন পার্টি হয়েছে। যে পার্টির সাথে মিশেছে, তার নাম জেনারেল জার্মান ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন,এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফার্ডিনান্ড লাসালে। লাসালে প্রথমদিকে বিপ্লবী থাকলেও পরে সংশোধনবাদী হয়ে যান, মনে করতেন বিপ্লবের বদলে আইনগত পথে সাফল্য আসবে। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের সাথে তাঁর ছিল ভালোই যোগাযোগ। লাসালের মৃত্যুর পরেও এই পার্টি লাসালের আদর্শ নিয়েই চলেছিল। নতুন পার্টির মধ্যে লাসালেপন্থীরা পেটি-বুর্জোয়া ভাবনা চিন্তা নিয়ে আসে, তাতে পুরনো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাও বিভ্রান্ত হন। ভোরওয়ার্টস পত্রিকা তখন এই নতুন পার্টির মুখপত্র। ড্যুরিংপন্থীরা এঙ্গেলসের আর লেখা প্রকাশে বাধা দেয়। লিবনেখট আপত্তি করেন। তারপরে বেবেলের মধ্যস্থতায় ঠিক হয় পত্রিকার বিজ্ঞানের পাতায় লেখাগুলি ছাপা হবে। পরে এটা ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ নামে ১৮৭৮-র জুনে বই হিসাবে প্রথম প্রকাশ হয়।

বইয়ের মুখবন্ধে এঙ্গেলস লেখেনঃ “এক বছর আগে আমি ঠিক করি যে অন্য কাজ অবহেলা করে, আমি এই টক আপেলটায় কামড় বসাব। এটা এমন আপেল যে, একবার কামড়ালে পুরোটা খেতে হবে, আর শুধু খুব টক নয়, অনেক বড়োও।” মুখবন্ধর পরে দু’টি পরিচ্ছেদ ভূমিকার। এঙ্গেলস ভূমিকাতে বললেন যেঃ ড্যুরিং নিজের সম্বন্ধে দাবি করছেন ‘এ যুগে ও সুদূর ভবিষ্যতে একমাত্র প্রকৃত দার্শনিক’ যিনি দুনিয়াকে ‘চূড়ান্ত ও চরম সত্য অর্পণ করছেন’। অর্থাৎ এযাবৎকাল যত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক দুনিয়ায় এসেছেন তাঁরা বিশেষ কিছু জানেন না, একমাত্র তিনিই চূড়ান্ত ও চরম সত্য বলতে পারেন। ফলে তিনি মার্কসকে তো আক্রমণ করলেনই, ডারউইন সহ কেউই বাদ গেলেন না তাঁর আক্রমণ থেকে। এঙ্গেলস দেখালেন, বিভিন্ন মানুষকে আক্রমণ করতে গিয়ে শুধু তাদের বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা নয়, কোথাও কোথাও তাদের বক্তব্য বিকৃত করে বা অন্য মানে করে তিনি পরিবেশন করেছেন।

বইটিতে ভূমিকার পর তিনটি অংশ। বইটির প্রথম অংশ–দর্শন, মোট ১২টি পরিচ্ছেদ। ড্যুরিং বলছেন, কোনো বিষয়ে নীতি বা কোনো মতবাদ তৈরি হয় চিন্তা থেকে, তার সাথে বহির্বিশ্বের কোনো সম্পর্ক নেই। এঙ্গেলস লিখছেনঃ “কিন্তু চিন্তা কিভাবে নীতি ঠিক করে? নিজে নিজেই?... যদি আরও প্রশ্ন তোলা হয় যে চেতনা, চিন্তা আসলে কী, কোথা থেকে এরা এলো, এটা বাস্তব যে তারা মানুষের মস্তিষ্কের ফসল আর মানুষ নিজেই প্রকৃতির ফসল, প্রকৃতির মধ্যে, চারপাশের পরিবেশ থেকেই তার বিকাশ। ফলে শেষবিচারে এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের মস্তিষ্কের ফসলও প্রকৃতির ফসল।” ড্যুরিং-র বক্তব্য যে - ‘‘বিশ্বের মূল অবস্থা... বস্তুর অপরিবর্তনীয় অস্তিত্ব, সময়ের পরিবর্তনের ছাপ তাতে নেই”। ‘‘আমরা এখনো জানিনা, বাইরে থেকে, অর্থাৎ ঈশ্বর ছাড়া, চরম স্থিতাবস্থা থেকে গতি কিভাবে পাবো।’’ গতি যদি থাকেও কিন্তু তার পিছনে ঈশ্বরের ভূমিকার কথা বলছেন ড্যুরিং। বস্তুর এই অপরিবর্তনীয় অস্তিত্ব, চরম স্থিতাবস্থার ধারণা বিরোধিতা করে এঙ্গেলেস বললেনঃ “বস্তুর অস্তিত্বের প্রকাশ হচ্ছে গতি। গতি ছাড়া কোনো বস্তু কোনোদিন ছিল না, কোনোদিন হতেও পারে না... সমস্ত স্থির, সমস্ত স্থিতাবস্থা আপেক্ষিক মাত্র, শুধুমাত্র কোনো না কোনো গতির নির্দিষ্ট রূপের সাপেক্ষে তার অর্থ আছে।”

ডারউইন বলেছিলেন যে, ‘‘গাছপালা ও প্রাণী প্রজাতিরা অপরিবর্তনীয় নয়, তারা পরিবর্তন সাপেক্ষ’’। নানা পরিস্থিতিতে জীবজগৎ ও প্রাণীকুলের পরিবর্তন হতে থাকে। নানা পরিবর্তনেই তো এক প্রজাতির বানর থেকে মানুষ এসেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ‘অস্তিত্বের সংগ্রামে’ যারা টিকে যায় তারা থাকে। সকলকে এই অস্তিত্বের সংগ্রামে লড়তে হচ্ছে, তা ড্যুরিং বিশ্বাস করেন না। তিনি বললেন যে,‘অস্তিত্বের সংগ্রাম’ সত্যি শুধু ‘বর্বরতার রাজত্বে’। অর্থাৎ ড্যুরিংয়ের নিয়ম অনুযায়ী, সমগ্র জীবজগতের বড়োজোর অতি সামান্য কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এঙ্গেলস লিখলেন –“ড্যুরিং মহাশয় হচ্ছে একমাত্র লেখক যিনি নিজে সীমাবদ্ধ ধারণায় অস্তিত্বের সংগ্রামের কথা বললেন।”

মার্কসবাদের দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিরোধিতায় ড্যুরিং বলেছিলেন-“বস্তুর কোনো দ্বন্দ্ব ঘটে না। দ্বন্দ্বকে বাস্তব বলে গ্রহণ করাটা হচ্ছে অবাস্তবতার চূড়ান্ত।’’ এঙ্গেলস লিখলেনঃ ‘‘যতক্ষণ বস্তুদের স্থিতিশীল ধরব তখন দ্বন্দ্ব নেই, কিন্তু অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায় যখনই বস্তুরা গতির মধ্যে থাকে। গতি নিজেই একটা দ্বন্দ্ব।” (আসলে স্থিতিশীল বস্তুর মধ্যেও সবসময় গতি থাকে, পরমাণুর ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, কিন্তু বিজ্ঞানের সে আবিষ্কার তখনো হয়নি, ফলে এঙ্গেলসের তা জানা ছিল না)। প্রাণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার মধ্যে অবিরত দ্বন্দ্বের কথা বললেন এঙ্গেলস। ড্যুরিং বলেছিলেন, প্রাণ হচ্ছে একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এঙ্গেলস বললেন আরেকটু বাড়তি কথাঃ “প্রাণ হচ্ছে অ্যালবুমেন জাতীয় দ্রব্যগুলির অস্তিত্বের প্রকাশ ও এই অস্তিত্বের প্রকাশ অবশ্যই নিহিত থাকে এই দ্রব্যগুলির রাসায়নিক উপাদানের অবিরত স্ব-পুনর্নবীকরণের মধ্যে।” আরও স্পষ্টভাবে ‘‘প্রাণও বস্তুর মধ্যে থাকা একটা দ্বন্দ্ব, ...যার অবিরত জন্ম হচ্ছে ও নিজের মধ্যেই সমাধান হচ্ছে; যখন দ্বন্দ্ব শেষ, তখন প্রাণ শেষ, মৃত্যু প্রবেশ করে।” এরপর বস্তুর বিকাশে তিনি ‘পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন’ ও ‘নেতির নেতি’ ব্যাখ্যা করেন।

‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ বইয়ের দ্বিতীয় অংশ - রাজনৈতিক অর্থনীতি, মোট ১০টি পরিচ্ছেদ। এর দশম পরিচ্ছেদ মার্কস লিখেছেন। রাজনৈতিক অর্থনীতির মার্কসীয় সংজ্ঞা এই প্রথম দেওয়া হলো প্রথম পরিচ্ছেদেঃ “ব্যাপক অর্থে, মানবসমাজে জীবনধারণের পার্থিব উপকরণগুলির উৎপাদন ও বিনিময়কে যে নীতিগুলি ঠিক করে তাদের বিজ্ঞান হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতি।” ড্যুরিং বলেছিলেন - ‘রাজনৈতিক অবস্থাই চূড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক অবস্থাকে ঠিক করে’। এঙ্গেলস বললেনঃ “সেটা হলে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আধুনিক বুর্জোয়াশ্রেণির বিকাশ হতো না।” ড্যুরিংয়ের বক্তব্য, বল প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। এঙ্গেলস বললেনঃ “বলপ্রয়োগ কোনো সম্পদ তৈরি করতে পারে না, বড়োজোর যে সম্পদ এতদিন ধরে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে নিতে পারে।” ড্যুরিং বললেন যে, কোনো জিনিসের মূল্য মানে তাতে কত শ্রম আছে ও তার উপর গায়ের জোরে যে কর নেওয়া হচ্ছে তার যোগফল। এটার অর্থ দাড়ায় যে, বলপ্রয়োগই মুনাফার উৎস, মার্কসীয় দৃষ্টিতে তা ভুল।

ড্যুরিং বললেনঃ “মার্কস পুঁজির গৃহীত অর্থনৈতিক নীতি ধরছেন না।... তার মতে পুঁজি অর্থ থেকে তৈরি হচ্ছে।” এঙ্গেলস লিখলেনঃ “আমাদের মতে, প্রতিদিন অর্থের মালিকের কাছে শ্রমিকের জন্য খরচ হচ্ছে ৬ ঘণ্টার শ্রমের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, কিন্তু শ্রমিক মালিককে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার শ্রমের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য তুলে দেয়। ৬ ঘণ্টার মজুরিহীন উদ্বৃত্ত শ্রমের এই ফারাক যায় অর্থের মালিকের পক্ষে, ৬ ঘণ্টার শ্রম অঙ্গীভূত হয় উদ্বৃত্ত উৎপাদিত দ্রব্যে, যার জন্য অর্থের মালিককে মজুরি দিতে হয় না। ঠকানো সম্পন্ন হলো। উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হলো, অর্থ পরিণত হলো পুঁজিতে।” ড্যুরিং এই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন - “যদি শ্রম সময়ের হিসাব নিই, উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে উৎপাদনের যন্ত্র ও প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মধ্যে তা ঢুকে আছে, কাজের দিনের এই উদ্বৃত্ত সময় হচ্ছে পুজিবাদীর উদ্যোগের অংশ।” এঙ্গেলস লিখলেন - অর্থাৎ ড্যুরিংয়ের মতে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ হচ্ছে ‘পুঁজির আয় বা লাভ’। এঙ্গেলস বললেন - “মার্কস এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, উদ্বৃত্ত মূল্যকে অবশ্যই পুঁজির লাভ বা আয় হিসাবে বিভ্রান্ত হলে চলবে না।”

‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ বইয়ের তৃতীয় অংশ - সমাজবাদ, মোট ৫টি পরিচ্ছেদ। পুঁজিবাদী উৎপাদন যখন সেভাবে বিকাশ লাভ হয়নি, তখন যে সমস্ত মানুষ ভবিষ্যতের কমিউনিজমের কল্পনা করতেন, সেই ইউটোপিয়ানদের ভূমিকা নস্যাৎ করে দিয়ে ড্যুরিং বললেন যে, ওরা “সামাজিক অ্যালকেমিস্ট” (আলকেমি মানে মধ্যযুগের রসায়নশাস্ত্র)। এঙ্গেলস বললেনঃ “সেটা হতে পারে। একদম শুরুর দিকে অ্যালকেমির প্রয়োজন ছিল... কিন্তু সেই সময় থেকে আধুনিক শিল্প পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অভ্যন্তরে সুপ্ত দ্বন্দ্বকে এমন নিদারুণ বৈরিতার সাথে বাড়িয়ে তুলেছে যে, এই উৎপাদনের ব্যবস্থার আসন্ন পতন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।” ফলে এখন তো আর কমিউনিজমের ধারণাকে ইউটোপিয়ান হলে চলে না। কিন্তু ড্যুরিং নতুনভাবে ইউটোপিয়ান ধারণা আনছেন, এঙ্গেলস লিখলেনঃ “এখন যদি ড্যুরিং মহাশয় তার সার্বভৌম মস্তিষ্ক থেকে নতুন ইউটোপিয়ান সামাজিক নীতি বার করেন, তাহলে তিনি শুধু “সামাজিক অ্যালকেমি”-র চর্চা করছেন না, আধুনিক রসায়নবিদ্যার সূত্রগুলি আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠার পর তিনি পুরনো অ্যালকেমি করছেন...। সমস্ত সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক বিপ্লবগুলির চূড়ান্ত কারণগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও বিনিময়ের মধ্যে খুঁজতে হবে; তাকে মানুষের মস্তিষ্কে, চিরকালীন সত্য ও বিচারে মানুষের আরও ভালো অন্তর্দৃষ্টিতে খুঁজলে চলবে না।”

পুঁজিবাদী সমাজে যে সঙ্কট আসে তার সম্বন্ধে ড্যুরিংয়ের বক্তব্য– ‘‘সঙ্কট হচ্ছে ‘স্বাভাবিকতা’–র থেকে দৈবাৎ বিচ্যুতি’’। তাঁর দাবি, অধিক উৎপাদন নয়, মানুষের কম উপভোগ্যতাই সঙ্কট ডেকে আনে, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি খুবই ভালো, গন্ডগোল মানুষের মধ্যে বিতরণে। এঙ্গেলস লিখলেনঃ “শোষণের ভিত্তিতে গঠিত সমস্ত সমাজের প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে জনগণের কম উপভোগ্যতা, সেটা পুঁজিবাদী সমাজেও ঘটে, কিন্তু উৎপাদন পদ্ধতির পুঁজিবাদী রীতিই সঙ্কট ডেকে আনে।”

ড্যুরিং একটা বিপ্লবী কথা বললেন যে, আগামীদিনের মুক্তসমাজে ধর্মকে নিষিদ্ধ করা হবে। এঙ্গেলস বললেন যেঃ “যখন সমাজ সমস্ত উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়ে তার পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার শুরু করবে” সেদিন ধর্মের ‘‘স্বাভাবিক মৃত্যু’’ ঘটবে।

ড্যুরিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তার জবাব দিতে গিয়ে মার্কসীয় দর্শনের একটা উল্লেখযোগ্য বই হয়ে গেল এঙ্গেলসের ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’। বইটি শেষ হলো এইভাবে - “পাঠক, বিষয়টি প্রায়ই যথেষ্ট নিরস ও হতাশার হয়ে গেছে, আমাকে অনুমতি দিন বিদায় নিতে।... ড্যুরিং মহাশয় সম্বন্ধে আমাদের মূল্যায়নকে কথায় গুছিয়ে বললে দাঁড়ায় ‘মেগালোম্যানিয়ার মানসিক অক্ষমতা’। ‘মেগালোম্যানিয়া’ মানে নিজেকে বড়ো বা শক্তিশালী বলে ভাবার বাতিক।