E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩য় সংখ্যা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / ১১ ভাদ্র ১৪২৭

সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে দেশব্যাপী সোচ্চার লক্ষ কণ্ঠঃ লাল নিশানের মাতন


হাওড়া ময়দানে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখছেন বিমান বসু, মঞ্চে দীপক দাশগুপ্ত, বিপ্লব মজুমদার এবং শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার জরুরি দাবি সহ করোনা মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতির সুযোগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জনগণের রুটি-রুজির উপর যেভাবে আঘাত নামিয়ে এনেছে এবং করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় সার্বিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ সপ্তাহ পালন করেছে সিপিআই(এম)। ২০ আগস্ট থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত জনজীবনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৬টি জরুরি দাবির ভিত্তিতে এই কর্মসূচি দেশজুড়ে পালিত হয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার আগেই অর্থনীতির বেহাল দশা তৈরি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে দেশের গরিব সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সিপিআই(এম) বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে কেন্দ্রের সরকার উদার অর্থনীতির পথে দেশের সর্বনাশ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, এরা ক্রমশ দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে চাইছে বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে। একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এরা তুলে দিচ্ছে কর্পোরেট বান্ধবের হাতে। দেশে মূল্যবৃদ্ধি চরমে উঠেছে। শিল্প উৎপাদন ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাম ভারতে দুর্দশা প্রকট হয়ে উঠেছে। একদিকে কর্মহীনদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কট তীব্র আকার নিয়েছে। এই দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে করোনার মারাত্মক সংক্রমণের মোকাবিলায় কেন্দ্রের চূড়ান্ত ব্যর্থতার ফলে দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত রেকর্ড সংখ্যায় পৌঁছুচ্ছে। একই সঙ্গে এই অতিমারীর প্রকোপে গত ৬ মাসে দেশের বুকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি সংস্থার অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা বিপন্ন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রাথমিক ধাক্কাতেই কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১৪ কোটি মানুষ। কমপক্ষে ১০‍‌ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছেন। রুজিহীন অসহায় ব্যাপক অংশের মানুষের এক বেলার খাবারও জুটছে না। কেন্দ্রের পরিকল্পনাহীন লকডাউন দেশের ব্যাপক অংশের মানুষের এই চরম সর্বনাশ নামিয়ে এনেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে কেন্দ্রের সরকার একদিকে যেমন পরিকল্পনা মতোই দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রের সর্বনাশ করছে, তেমনি সরকার ও শাসকদল এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তি সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির মধ্যদিয়ে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করতে চাইছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করেছে সিপিআই(এম)। এই দাবিগুলির মধ্যে ছিলঃ আয়কর দেয় না এমন সমস্ত পরিবারকে আগামী ছ’মাস মাসিক নগদ ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে; আগামী ৬ মাস যাদের প্রয়োজন এমন সবাইকে মাথাপিছু ১০ কিলোগ্রাম খাদ্যশস্য বিনামূল্যে দিতে হবে; বর্ধিত মজুরিসহ রেগার কাজ ২০০ দিন করতে হবে; শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন চালু করতে হবে, সকল বেকারকে বেকারভাতা দিতে হবে; আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন প্রত্যাহার করার পরিবর্তে তা আরও শক্তিশালী কর‍‌তে হবে; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন এবং এপিএমসি আইন বাতিল ও সংশোধনের অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে হবে; শ্রমআইন শিথিলের উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে; রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিশেষ করে রেল, বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, কয়লা, ব্যাঙ্ক, বিমা, প্রতিরক্ষা উৎপাদন বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে; প্রধানমন্ত্রীর নামে বেসরকারি ট্রাস্টে সংগৃহীত অর্থ রাজ্যগুলিকে হস্তান্তর করতে হবে; বিপর্যয় মোকাবিলা আইন চালু থাকায় মহামারীতে মৃতদের পরিবারকে জাতীয় বিপর্যয় ত্রাণ তহবিলের বিধি মেনে এককালীন অর্থসাহায্য দিতে হবে; তফসিলি জাতি-আদিবাসী-ওবিসি এবং প্রতিবন্ধী সংরক্ষণ কঠোরভাবে রূপায়ণ করতে হবে; পূর্বেকার সেমিস্টারের ফলাফলের ভিত্তিতে অন্তিম বর্ষের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্র-ছাত্রীদের ডিগ্রি দিতে হবে; জম্মু-কাশ্মীরে ২০১৯-এর আগস্ট থেকে বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে; রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে; পরিবেশ মুল্যায়ন ২০২০-র নির্দেশ প্রত্যাহার করতে হবে; দলিত, মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা, আদিবাসীদের উপর শোষণ বন্ধ করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে ইত্যাদি।

ছত্তিশগড়ে কোরবা জেলার বাঁকেপুরব গ্রামে সিপিআই(এম)-র বিক্ষোভ।

এই কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ আগস্ট দিল্লি সংলগ্ন নয়ডার বিভিন্ন এলাকায় পথসভা, বিক্ষোভ সভা, পথনাটক, ধরনা প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে ১৬ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। ২৬ আগস্ট পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে সিআইটিইউ-র কর্মীরাও অংশ নেন। এই কর্মসূচিতে পার্টি নেতা গঙ্গেশ্বর দত্ত শর্মা, রাম সাগর প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

ত্রিপুরায় প্রতিবাদ সপ্তাহে ১৬ দফা দাবিতে ব্যাপক প্রচার চলে। বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিলি, উঠোন সভা, পথ সভা, পাড়া সভা, মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত হয়। আগরতলা ছাড়াও কৃষক সভার ডাকে বিরাট কনভেনশন হয়েছে সাব্রুমে। এই কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি জীতেন্দ্র চৌধুরী। এছাড়া লংতরাই ভ্যালি মহকুমা, বিলোনীয়া, ধর্মনগর মহকুমার বিভিন্ন প্রচার কর্মসূচিতে অংশ নেন ব্যাপক অংশের মানুষ।

২০ আগস্ট এই কর্মসূচি উপলক্ষে পার্টির ধানবাদ জেলা কমিটির ডাকে রণবীর চকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে পার্টির ঝাড়খণ্ড রাজ্য কমিটির সম্পাদক গোপীকান্ত বক্সি, জেলা সম্পাদক সুরেশ প্রসাদ গুপ্তা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। ১৬ দফা দাবিতে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সাফাই কর্মীদের কাজ থেকে বসিয়ে দেবার বিরুদ্ধে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতির দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। পরবর্তী দিনগুলিতেও ধানবাদের বিভিন্ন এলাকায় এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে কেরালা জুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট রাজ্যের প্রায় ২৫ লক্ষ পার্টি কর্মী ও সমর্থক বাড়িতে বাড়িতে লাল পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বি জে পি’র জনস্বার্থবিরোধী ও নয়া-উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হন। একই সঙ্গে তিরুবনন্তপুরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধেও তাঁরা প্রতিবাদে শামিল হন। এই কর্মসূচিতে শামিল হন ছাত্র, যুব, মহিলা, শিল্পী, গায়ক ও সংস্কৃতি জগতের মানুষরাও। শহিদ কমরেড অভিমন্যুর পরিবার এবং ১০৫ বছর বয়সী করোনা-যুদ্ধে জয়ী আসমা বিবি ও তাঁর পরিবারও এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হন।

গত ২০ ও ২১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন থাকায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে না পারলেও এই দু’দিন পার্টিকর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতিবাদ জানান। ২২ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পার্টি কর্মীরা কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল সহ জেলায় জেলায় লাল ঝান্ডা এবং দাবি সংবলিত পোস্টার নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শামিল হন। কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে শুরু করে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, মালদহ, হাওড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, নদীয়া, হুগলি জেলাজুড়ে ১৬ দফা দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় কাজ ও খাদ্যের দাবি সহ জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬ দফা দাবিতে বিক্ষোভ উত্তাল হয় ২৫ আগস্ট। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষ, গোপালগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার উদ্বাস্তু মানুষ কাঁকসার ডাকবাংলো মোড়ে জমায়েত হন। এখানে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের উজ্জীবিত মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এছাড়া বারাবনির সালানপুরে, জামুরিয়া বাস স্ট্যান্ড, বিডিও দপ্তরে, সিদুলি, পাণ্ডবেশ্বর, দিসেরগড় ছোটোদিঘারি, রানিগঞ্জের বল্লভপুর, গির্জাপাড়া, আসানসোলের মাহিশীলা, রেলপার, দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী সহ জেলার ৪৩টি জায়গায় সভা হয়েছে।

২৫ আগস্ট পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির ডাকে হাওড়া ময়দানে প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি এই প্রতিবাদ সভায় বিজেপি যেভাবে মানুষের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি করছে, ধর্ম ও রাজনীতিকে এক করে দিচ্ছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই-আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। এদিনের এই প্রতিবাদ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, পার্টি নেতা দীপক দাশগুপ্ত, পরেশ পাল প্রমুখ। সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক বিপ্লব মজুমদার। এদিন হাওড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২৫ আগস্ট উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দক্ষিণ দমদমের দক্ষিণদাঁড়ি, সুভাষনগর ও নাগেরবাজারে তিনটি জনসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। তিনি সভাগুলিতে ১৬ দফা দাবির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয় উত্থাপন করে বলেছেন, মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণে মোদী, দিদি একই পথে চলেছেন। কেন্দ্র যেভাবে দেশের সম্পদ বিক্রি কতে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কোনো প্রতিবাদ নেই। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের ঢাক পেটাতে। অথচ এখানে মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে চরম বিপদের মধ্যে রয়েছেন। বিপদের সময় মানুষের পাশে রয়েছেন একমাত্র বামপন্থীরাই। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যেমন লড়তে হবে, তেমনি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির বিভাজনের আক্রমণকেও রুখতে হবে। তিনি কেন্দ্র থেকে রাজ্যে দক্ষিণপন্থী শাসকদের আক্রমণের মোকাবিলায় সমাজের সমস্ত অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবেদন জানান।