E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩য় সংখ্যা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / ১১ ভাদ্র ১৪২৭

৩১ আগস্টের অঙ্গীকার

সুপ্রতীপ রায়


সেদিন ৮০ জন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে খুন করেছিল পুলিশ।

৩১ আগস্ট এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের বীর শহিদদের স্মরণ করে আমরা শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অঙ্গীকার করি। কেবলমাত্র খাদ্যের দাবিতে গ্রাম বাংলা থেকে কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। নিরন্ন মানুষগুলিকে বিনা প্ররোচনায় ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে খুন করেছিল পুলিশ। ৮০ জন মানুষকে খুন করা হয়েছিল। পুলিশের আক্রমণে তিন হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২২ হাজার জনকে। নিখোঁজ হয়েছিলেন অনেকে। স্বাধীনতার পর থেকেই খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেস সরকারের নীতির জন্য খাদ্য সঙ্কট বাড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার ও তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন কার্যত মজুতদার ও মুনাফাদারদের কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরির ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিলেন। রাজ্যে দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি হয়েছিল।

সরকারের খাদ্যনীতি পরিবর্তনের দাবিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’র নেতৃত্বে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ১৪ জুলাই বিভিন্ন জেলার আদালতগুলিতে ও সরকারি অফিসগুলিতে সীমাবদ্ধ আইন অমান্য হয়। ১৮ জুলাই বাটা ও নুঙ্গিতে, ২১ জুলাই তমলুক মহকুমা প্রাঙ্গণে আইন অমান্য হয়। ২৭ জুলাই চুঁচুড়া জেলাশাসক দপ্তরের সামনে আইন অমান্যকারীদের উপর পুলিশ আক্রমণ করে। ৩০ জুলাই বিপুল পরিমাণ মানুষ খাদ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখান।

২৪ আগস্ট থেকে শুরু হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। ঐ সময় জেলায় জেলায় আইন অমান্য হয়। ২০ আগস্ট ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে খাদ্য আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪ আগস্ট মনুমেন্টের পাদদেশে এক বিশাল সমাবেশ হয়। এরপর এলো ৩১ আগস্ট, সেই রক্তস্নাত দিন। (৩১ আগস্টের মিছিলে যাঁরা পা মিলিয়েছিলেন তারা থানা বা পুলিশকে আক্রমণ করেননি) কি ছিল সেদিনের দাবি? দাবিগুলি ছিল - খাদ্যমন্ত্রীর অবিলম্বে অপসারণ চাই, রাজ্যব্যাপী সর্বস্তরের মানুষকে ১৭.৫০ টাকা মন দামে খাবার উপযোগী চাল সরবরাহ করতে হবে, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান তীব্র করতে হবে এবং উদ্ধার করা খাদ্যদ্রব্য সস্তা দরে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করতে হবে, সমস্ত মানুষকে মাথা পিছু দেড় সের চাল নিয়মিতভাবে রেশন দোকান থেকে সরবরাহ করতে হবে, চালকলগুলির উপর শতকরা ৫০ ভাগ লেভি বসাতে হবে, পর্যাপ্ত কৃষিঋণ বণ্টন করতে হবে ইত্যাদি। মানুষের ন্যায্য দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন পৈশাচিকতার সঙ্গে সেদিন দমন করা হয়েছিল। হঠাৎ করেই ৩১ আগস্টের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই গভীর সঙ্কটের মধ্যে পড়েন বাংলার জনগণ। জনগণের জলন্ত দাবি দাওয়াগুলি নিয়ে বামপন্থীরা বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টি ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। দেশবিভাগের ফলস্বরূপ তৈরি হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে কংগ্রেস সরকারের কোনো সুস্পষ্ট নীতি ছিল না। ফলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে বড়ো বড়ো আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে উদ্বাস্তুরা তাদের সমস্যাগুলি জানাতে দিল্লি যান। সেখানে তাঁদের উপর লাঠি চলে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১২ জানুয়ারি কলকাতায় মিছিল হয়। মিছিলের উপর লাঠি, গুলি চলে। ছয়জন নিহত হন। ১৩ জানুয়ারি শোক মিছিলের উপর আবার গুলি চলে। পাঁচজন নিহত হন।

একই সময়ে মাঠে, ময়দানে, কলে-কারখানায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বর্বরতার সঙ্গে মহিলা আন্দোলনও দমন করার চেষ্টা করে। ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন লতিকা-প্রতিভা-গীতা-অমিয়া। ১৯৫৩-র ট্রাম ভাড়া বিরোধী আন্দোলন, ১৯৫৪-র শিক্ষক আন্দোলন, ১৯৫৬-র বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৫৭-র শিক্ষক আন্দোলন, ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে কেরালায় নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারকে ফেলে দেওয়ার বিরূদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নানা ধারার মিলিত স্রোত ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করে।

৩১ আগস্টের পরের দিন আবার রক্তাক্ত হয় কলকাতা। ১ সেপ্টেম্বর সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লন থেকে বিশাল ছাত্র মিছিল বার হয়। সেই মিছিলের উপর পুলিশি আক্রমণে ৮ জন ছাত্র নিহত হন, আহত হন ৭৭ জন।

কিন্তু আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায় নি। ৩১ আগস্টের প্রভাবে পরবর্তীকালে বড়োবড়ো গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনের ধারাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৭-র প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার, ১৯৬৯-র দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং ১৯৭৭ সালের বামফ্রন্ট সরকার।

ব্রিটিশ আমল থেকে ধারাবাহিক দুর্ভিক্ষ চলতে থাকে। ১৮০০-১৮৫০-র মধ্যে ভারতে ৭ বার বড়ো ধরনের দুর্ভিক্ষ হয়। ১৮৫০-১৯০০ সালের মধ্যে ২৪ বার দুর্ভিক্ষ হয়। প্রাণ যায় ২ কোটি মানুষের। ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষে বাংলায় প্রচুর মানুষ প্রাণ হারান। ঐ দুর্দিনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভার ভূমিকা কি ছিল? সঙ্কটের সময় মানুষকে বাঁচানোর চাইতে মন্ত্রিত্ব থেকে লিগকে সরানোই হিন্দু মহাসভার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেছিলেন, “সরকারি এজেন্টদের কাছে ধান বেচিও না”। ফলে সরকারি এজেন্টরা ধান চাল কিনতে পারলেন না। মজুতদাররা তা কিনে দাম বাড়িয়ে দিলেন। অর্থাৎ, হিন্দু মহাসভার রাজনীতির ফলে লাভবান হয়েছিলেন মজুতদাররা।

’৪৩-র দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। ঐ সময় কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ছিল - মজুত বিরোধী অভিযান করা, মজুত খাদ্য ধরে জনগণের খাদ্য কমিটির মারফত বণ্টন করা, দুঃস্থদের জন্য খাদ্য বিতরণ করা। খাদ্য কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে লঙ্গরখানা খুলে খাদ্য বিতরণ করা হয়। যেখানে কোনো রাজনীতি ছিল না। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার গণসংগঠনগুলি একদিকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আবার খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করেছিল।

১৯৪৬ সালে দুর্ভিক্ষের কালোছায়া আবার বাংলাকে গ্রাস করে। ব্যাপকভাবে ধান, চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে মানুষ সেই সময় অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। আবার ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছিলেন। মানুষ ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলেন।

কিন্তু স্বাধীনতার পরও খাদ্য সঙ্কট চলতে থাকে। কারণ কি ছিল? সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থার ফলে কৃষকের সর্বহারাতে পরিণত হওয়া, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, জনবিরোধী খাদ্য নীতির পরিণতিতে মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। ভ্রান্ত খাদ্যনীতি আর মজুতদার-মুনাফাখোর তোষণনীতি বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

স্বাধীনতার পরও জমির ওপর মুষ্টিমেয় জোতদারদের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় ছিল। সেইসময় প্রায় ১৬ লক্ষাধিক কৃষক পরিবারের বেশির ভাগই ছিলেন গরিব কৃষক। এদের অনেকেই জমি হারা হচ্ছিলেন। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় গরিব কৃষক, খেতমজুর, বর্গাদারদের অর্ধাহার, অনাহারে থাকতে হতো। ১৯৪৭-৫৯ এই ১২ বছরে ভ্রান্ত খাদ্যনীতির ফলে সঙ্কট চরমে ওঠে। ১৯৫৮ সালের শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি খাদ্য সঙ্কট নিয়ে সরকারকে সচেতন করে এবং বিভিন্ন প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।

১৯৫৯ সালের সঙ্কট থেকে বর্তমান সময়ে গ্রামীণ এলাকায় সঙ্কটের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সঙ্কট কমেনি বরং বেড়েছে। এর মূল কারণ শাসকশ্রেণির নীতি পুঁজিপতি ও জমিদারদের স্বার্থবাহী। দেশের অধিকাংশ এলাকায় ভূমিসংস্কার হয়নি। ফলে গ্রামীণ মানুষের একটা বড়ো অংশ সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শিকার হচ্ছেন। উদারনীতিতে কৃষিক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। ফলে কৃষিক্ষেত্রে সংকট ক্রমবর্ধমান। অর্থাৎ অন্নদাতারা বিপন্ন।

আমাদের দেশে জমির মালিকানায় কেন্দ্রীকরণ অব্যাহত। ভূমিহীনদের জমির মালিকানা প্রদানের পরিবর্তে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভূমিসংস্কার নীতির ব্যর্থতার জন্য প্রকৃত চাষীর হাতে জমি আসেনি। গ্রামীণ ধনীদের এক শক্তিশালী চক্র গরিব মানুষকে শোষণ করে চলেছে।

উদারবাদের হাত ধরে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। বিদেশি কর্পোরেটদের চাহিদা মেটাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন। খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা বিপন্ন হচ্ছে। কৃষিতে বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বার্থে জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইনগুলিকে ক্রমান্বয়ে শিথিল করা হচ্ছে।

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশ মেনে কৃষিক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। আমদানির উপর পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের ফলে দেশের বাজারে বিদেশে উৎপন্ন কৃষিপণ্য প্রবেশ করছে। ধ্বংসের কিনারায় ভারতীয় কৃষক সমাজ। নয়া-উদারবাদী জমানায় সাম্রাজ্যবাদ কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী মোদী সরকার কৃষি ও কৃষকের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল দিল্লির যন্তর মন্তরে রাজস্থানের কৃষক গজেন্দ্র সিং-এর আত্মহত্যা দেখিয়েছে সঙ্কটের গভীরতা। গজেন্দ্রর মৃতদেহের কাছে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিলো, ‘‘ফসল শেষ হয়ে গেছে, আমার ছেলে মেয়েদের কি হবে?”। গজেন্দ্র সিং-এর মতো লক্ষ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

কৃষি সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই সঙ্কট সর্বগ্রাসী। কেবলমাত্র কোভিড ১৯-কে ঢাল করে আসল সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মোদী সরকার ও তৃণমূল সরকারের আমলে দেশ ও রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছে। দেশের কোথাও কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না। ফলে কৃষক ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন। ঋণভারে জর্জরিত কৃষক চাষ করতে চাইছেন না।

গত সাত বছরে কেবলমাত্র কৃষিক্ষেত্রে কাজ হারিয়েছেন প্রায় তিন কোটি মানুষ। পশ্চিমবাংলায় কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেন না। তৃণমূলী জমানায় রাজ্য সরকার পঞ্চায়েত, সমবায় সমিতি, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে সচেতনভাবে ধ্বংস করেছে। সবেতেই কাটমানি। ফসলও বাদ নেই। গ্রামাঞ্চলে কায়েম হয়েছে ফড়েরাজ। ফড়েদের কাছে কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। তলানিতে গ্রাম ও শহরের মজুরি।

মূল কথা কৃষি সঙ্কটকে অজুহাত করে এদেশের কৃষি ব্যবস্থাটাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে সরকার। যে কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষ আমাদের মুখে খাদ্য তুলে দেন তাঁদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে মোদী সরকার। কর্পোরেট স্বার্থেই স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা হচ্ছে না। কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষিজ ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কিন্তু কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

‘কোভিড ১৯’ আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলেছে। কৃষি ও কৃষকের বিপদ আরও বেড়েছে। আসলে করোনা-জনিত পরিস্থিতিতে সরকার মানুষকে বিপদে ফেলেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে, তাতে আর একটি ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের মধ্যে আমাদের পড়তে হতে পারে। গভীর মানবিক সঙ্কটের মধ্যেও সরকার মনে করছে, নয়া-উদারবাদী সংস্কারগুলিকে আরও আগ্রাসীভাবে প্রয়োগ করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। কারণ অতিমারী আইন প্রয়োগ করে প্রতিবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। ফলে উদারবাদী নীতিকে প্রয়োগের লক্ষ্যেই নানা প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে।

আমাদের দেশে অপরিকল্পিত লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরকম প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ফলে কৃষিকাজ ও কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করার প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হলো। কৃষকদের চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো। খেতকে লকডাউন থেকে ছাড় দেওয়া হলো। মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হলো। লকডাউনে পণ্য পরিবহণ ও যানবাহন চলাচলে নানা নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে চাষবাস ও তা বাজারজাত করার প্রশ্নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো।

একদিকে চলতি অর্থনৈতিক মন্দা, অন্যদিকে ধারাবাহিক কৃষি সঙ্কটের সঙ্গে দীর্ঘ লকডাউন যুক্ত হওয়ার ফলে কৃষক ও সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এটা খুবই পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে যে পরিমাণ খাদ্য মজুত থাকার দরকার তার থেকে তিনগুণ খাদ্য মজুত থাকা সত্ত্বেও সবাই খাদ্য পাচ্ছেন না। লকডাউনে নানা প্রতিবন্ধকতার ফলে কৃষকের উপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক বোঝা চেপেছে। কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন।

১২মে নরেন্দ্র মোদী ২০ লক্ষ কোটি টাকার এক প্যাকেজ ঘোষণা করে বললেন - এটি ‘আত্মনির্ভর’ ভারত গঠনের প্যাকেজ। আসলে এই প্যাকেজ শ্রমিক-কৃষকদের প্রতারিত করার প্যাকেজ। নয়া-উদারবাদের প্রবলতম সমর্থক বিজেপি মনে করে - কৃষিতে নিযুক্ত দেশের অধিকাংশ শ্রমজীবীর আয় দ্বিগুণ করার প্রধান বাধা নিয়ন্ত্রিত বাজার। তাই লকডাউনের সময় কৃষি বিষয়ক নানা অর্ডিন্যান্স জারি করে কর্পোরেট ও দেশীয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কাছে কৃষিবাজার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অতিমারীজনিত পরিস্থিতির সময় সংস্কারের নাম করে বেসরকারি বাজারকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য কৃষি পণ্যের বাজার কমিটি (এমপিএসসি)-র আইনকে লঘু করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। কর্পোরেটরা যাতে কৃষিজমি অবাধে পেতে পারে তার জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ।

লকডাউন পর্যায়ে কৃষকের ফসল খামারজাত করা, ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়ের সমস্যার সমাধানের বদলে কর্পোরেট স্বার্থে অতি দ্রুততার সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে তিনটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো। এই তিনটি অধ্যাদেশ হলো - (১) ফার্মিং প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স, অর্ডিন্যান্স-২০২০; (২) ফার্মারস এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিস এগ্রিমেন্ট-২০২০; (৩) অত্যাবশকীয় পণ্য আইন সংশোধনী অর্ডিন্যান্স-২০২০; এই অধ্যাদেশগুলি কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস করবে। শিল্পের বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হবে। কারণ, শিল্পের বিকাশের জন্য কৃষির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষিত হবে না।

তথাকথিত আত্মনির্ভর প্যাকেজে কৃষক স্বার্থবাহী কোনো কথা নেই। কৃষিক্ষেত্রের প্যাকেজ বলে যা বলা হচ্ছে আসলে তা কৃষককে প্রতারিত করার নামান্তর। প্যাকেজে ফসল নষ্ট হওয়ার ফলে যে কৃষক, খেতমজুররা বিপদে পড়লেন তাঁদের ক্ষতিপূরণের কোনো কথা নেই। প্যাকেজে ঋণগ্রস্ত কৃষি পরিবারগুলির ঋণ মকুব, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনে নেওয়া, ‘মনরেগা’তে মজুরি বৃদ্ধি বা কাজের দিন বাড়ানোর কোনো কথা নেই। বিপদ না কাটা পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের কোনো ঘোষণা নেই।

আসলে মোদীর আর্থিক প্যাকেজ কৃষকদের প্রতি নিষ্ঠুর পরিহাস। এই প্যাকেজের নির্যাস হলো - (ক) দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক-কৃষকদের জন্য কোনো খরচ সরকার করবে না; (খ) সরকার কৃষকদের কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না; (গ) সরকার কর্পোরেটকে রক্ষা করতে শ্রমিক-কৃষকদের উপর সঙ্কটের বোঝা চাপিয়ে দেবে। লকডাউনের ফলে যাঁরা কর্মহীন হয়েছেন তাঁদের কথা প্যাকেজে নেই। আসলে নরেন্দ্র মোদী ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর যোগ্য প্রতিনিধি।

১৯৫৯-র ৩১ আগস্ট ছিল শ্রেণিসংগ্রামের একটি রূপ। পরিস্থিতি জটিল। কিন্তু হতাশার স্থান নেই। কারণ ‘কোভিড’-এর পরিণতিতে তীব্র থেকে তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হবে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। আসুন, তাই ৩১ আগস্ট আপসহীন শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করি।