E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩য় সংখ্যা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / ১১ ভাদ্র ১৪২৭

বিজ্ঞান আলোচনা

রাখিগড়ি ডিএনএ এবং হিন্দুত্ববাদীদের উচ্ছ্বাস

তপন মিশ্র


সিন্ধু সভ্যতার আর এক নিদর্শন, হরিয়ানার হিসার জেলার রাখিগড়িতে প্রায় ৪৫০০ বছর পুরনো ৫৩ টি কবর থেকে ৪৬টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। তার মধ্যে কেবল একটি কঙ্কালের ডিএনএ-র জিনোমিক পরীক্ষা হয়। এই ডিএনএ বিশ্লেষণের পর পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এই প্রকল্পের মুখ্য বিজ্ঞানী বসন্ত শিন্ডে। যে গবেষণাপত্রটি তিনি এবং তাঁর সহ-গবেষকরা বিশ্ববিখ্যাত ‘সেল’ (এলসেভিয়ার-এর সেল প্রেস থেকে জীবনবিজ্ঞানের প্রায় ৫০ টি ধারায় এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির কোনো দেশ, কাল, পাত্র নেই। অত্যন্ত উন্নতমানের বিজ্ঞান গবেষণা পরিবেশনের জন্য পত্রিকাটি বিশ্ববিখ্যাত) পত্রিকায় লেখেন। রাজনৈতিক চাপে সেই বক্তব্যের ঠিক উলটোটাই সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের বলতে হয়। হিন্দুত্ববাদীদের চাপে তাঁদের বলতে হয় যে, ভারতবর্ষের মানুষ স্বদেশজাত এবং পৃথিবীর অন্য কোনো অংশের মানুষের অভিপ্রয়াণের (migration) ফলে ভারতবর্ষের জনসমষ্টি তৈরি হয়নি। অর্থাৎ ‘এদেশের আর্যরা (হিন্দুরা) হলো স্বদেশজাত’। এই বক্তব্য ইদানিংকালে হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে মেকি-বৈজ্ঞানিক (pseudo-scientific) উৎসাহ তৈরি করে। ওরা বলতে শুরু করে যে, ইয়োরেশিয়ান স্টেপ (Steppe) এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানুষের অভিপ্রয়াণের (migration) বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব ভ্রান্ত।

হরপ্পা থেকে রাখিগড়ি

১৯২০ সালে হরপ্পায় প্রথম এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। সিন্ধু নদীর তীরে এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করায় এই সভ্যতার নাম হয় সিন্ধু সভ্যতা। তখন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌দের ব্যাখ্যা ছিল যে, সিন্ধু সভ্যতা হলো বৈদিক সভ্যতার -পূর্ব সভ্যতা এবং আর্যরা অনুপ্রবেশ (Aryan invasion) করার পর এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯২১ সালে মহেঞ্জোদরোতে একইভাবে এই প্রাচীন সভ্যতার আরও চিহ্ন পাওয়া যায়। এই সভ্যতাকেও সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কার্বন ডেটিং-এর মধ্য দিয়ে সময়কাল নির্ধারিত হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ পর্যন্ত। এই সভ্যতার বিস্তার ছিল প্রায় সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। সীমানা ছিল উত্তরে আফগানিস্তান, জম্বুর মান্ডা অঞ্চল, দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ, কচ্ছ, গুজরাত অঞ্চল, পূর্বে আলমগিরপুর, এবং পশ্চিম সীমা পাকিস্তানের বালুচিস্তান পর্যন্ত। কালক্রমে ইয়োরেশিয়া অঞ্চলের মানুষদের (আর্যরা) উত্তর পশ্চিম অংশ থেকে ভারত ভূমিতে অভিপ্রয়াণ হয় এবং অচিরেই তাদের আধিপত্য স্থাপন করে। সেই অর্থে আর্যদের দ্বারা প্রথম অধ্যুষিত হয় ভারতবর্ষের উত্তর অংশ, তারপর উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়। কেউ কেউ এই অঞ্চলকে আর্যাবর্ত বলে। মনে রাখতে হবে যে, সেই সময়ে রাখিগড়ি আবিষ্কৃত হয়নি এবং ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতিহাস চর্চার পদ্ধতিও অজানা ছিল।

তার অনেক পরে হরিয়ানার রাখিগড়িতে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য উদ্ধার হয় ১৯৬০ সালে। ঘাঘর-হাকরা দুই নদীর সংলগ্ন এলাকায় প্রথমে সাতটি ঢিবি পাওয়া গিয়েছিল এই সময়ে। ২০১৪ সালে আরও বেশ কিছু ঢিবি উদ্ধার হওয়ার পরে প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌রা মনে করেন যে, মহেঞ্জোদরোর থেকেও বড় এলাকাজুড়ে ছিল রাখিগড়ির জনবসতি। এখনও এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ঢিবি বিভিন্ন কারণে খোঁড়া যায়নি।  প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌দের মতে, সিন্ধু সভ্যতার অনেক আগে মনুষ্যবসতি ছিল হরিয়ানার এই অংশে। রাখিগড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের কার্বন-ডেটিং পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে সেগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০০ সালের। অন্য দিকে, সিন্ধু সভ্যতার সময় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ পর্যন্ত; যদিও পরবর্তী সময়ে রাখিগড়িকেও সিন্ধু সভ্যতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কি বলছে আধুনিক ডিএনএ গবেষণা?

সেল পত্রিকায় ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের লেখক বসন্ত শিন্ডে এবং তাঁর সঙ্গে দেশ বিদেশের আরও ২৭ জন গবেষক। প্রবন্ধটির নাম “An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers”। রাখিগড়ির যে একটিমাত্র কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার তথ্যর সাথে অন্য কয়েকটি তথ্য যুক্ত করে এই প্রবন্ধ রচনা করা হয়। প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো নিম্নরূপ -
১। এই কঙ্কালটি একজন মহিলার। যিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ থেকে ২৩০০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে জীবিত ছিলেন।
২। বলা হলো যে, তার ডিএনএ তন্তুতে ‘R1a1’ জিন পাওয়া যায়নি। এই জিনটি সাধারণ ভাবে তথাকথিত আর্যদের মধ্যে অর্থাৎ ইয়োরেশিয়া বা স্টেপ অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের মধ্যে থাকার কথা।

একথা থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে, বহিরাগত কেউ সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তোলেনি। বসন্ত শিন্ডে এবং তার সহ-গবেষকদের প্রবন্ধের শেষপ্রান্তে অর্থাৎ উপসংহারে ওঁরা লিখছেনঃ “While our study is sufficient to demonstrate that this ancestry profile was a common feature of the IVC, a single sample - or even the gradient of 12 likely IVC samples we have identified - cannot fully characterise a cosmopolitan ancient civilisation. এখানে আইভিসি (IVC)-র অর্থ হলো Indus Valley Civilization বা সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা। উপরের বাক্যে গবেষকরা পরিষ্কার বলছেন যে, একটিমাত্র নমুনা থেকে এই আদিম বিশ্বজনীন (cosmopolitan) সভ্যতার মূল্যায়ন করা যায় না। তারপরই তাঁরা লিখছেনঃ “An important direction for future work will be to carry out ancient DNA analysis of additional individuals across the IVC range to obtain a quantitative understanding of how the ancestry of IVC people was distributed and to characterise other features of its population structure.”। তাঁরা মনে করেছেন, যে কোনো সিদ্ধান্তে আসার জন্য আরও ডিএনএ গবেষণা করা প্রয়োজন। তারা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যেঃ “In other words: the DNA from the skeleton of the woman, dated to about 5,000 years ago, shows no detectable ancestry from the “Steppe pastoralists or from Anatolian and Iranian farmers, suggesting farming in South Asia arose from local foragers rather than from large-scale migration from the west”. This conclusion does not contradict the prevailing understanding of the Harappan settlers’ origins.” অর্থাৎ তাঁদের মতে এই গবেষণার ফল কখনই পূর্বের ধারণা যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার পশ্চিম অংশ থেকে বহু সংখ্যায় মানুষের অভিপ্রয়াণের কথা বলা হয়েছে সে তত্ত্ব ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে না। বলাই বাহুল্য যে, এই জিনোম ব্যতিরেকে সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার আর কোনো কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি।

‘সেল’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই প্রবন্ধ প্রকাশের ঠিক আগেই ৬ সেপ্টেম্বর প্রায় অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে সংগঠিত একটি গবেষণাকার্যের আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সায়েন্স পত্রিকায়। নাম The Genomic Formation of South and Central Asia এবং এর লেখক-গবেষকের সংখ্যা শতাধিক। এই প্রবন্ধের মুখ্য গবেষক ভর্গিজ নরসিমন (Vagheesh M. Narasimhan,  Harvard Medical School)। এই প্রবন্ধের অন্যতম লেখক হলেন এই বসন্ত শিন্ডে। এশিয়া এবং ইয়োরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেমন ইয়োরেশিয়া স্টেপ অঞ্চল, পূর্ব ইরান এবং স্বাট উপত্যকার লৌহ যুগ (বর্তমান পাকিস্তান)-এর ৫২৩টি কঙ্কালের ডিএনএ গবেষণা এবং অন্যান্য অনেক পুরাতাত্ত্বিক তথ্য এই প্রবন্ধ আমাদের সামনে যে সত্য তুলে ধরেছে তার সামান্য আলোচনা এখানে করা দরকার মনে করছি। তাঁদের গবেষণার সিদ্ধান্তের উক্ত অংশ তুলে ধরছি। তাঁরা স্পষ্ট কথায় বলছেনঃ “By sequencing 523 ancient humans, we show that the primary source of ancestry in modern South Asians is a prehistoric genetic gradient between people related to early hunter-gatherers of Iran and Southeast Asia. …The Steppe ancestry in South Asia has the same profile as that in Bronze Age Eastern Europe, tracking a movement of people that affected both regions and that likely spread the distinctive features shared between Indo-Iranian and Baltic-Slavic languages. এর সারমর্ম হলো দক্ষিণ এশিয়ার জনসমষ্টির মধ্যে স্টেপের প্রাচীন বংশধারা (ancestry) স্পষ্ট।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বসন্ত শিন্ডের মতো একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং পুনার ডেকান কলেজের উপাচার্য নিরজ রাই-এর মতো একজন জিন বিশেষজ্ঞ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঠিক ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে বলেন যে, ভারতবর্ষের মানুষ স্বদেশজাত এবং পৃথিবীর অন্য কোনো অংশের মানুষের অভিপ্রয়াণের ফলে ভারতবর্ষের জনসমষ্টি তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানের কাছে যেমন আর্য-অনার্য-র ভাগ অপ্রাসঙ্গিক, কেবল প্রাসঙ্গিক হলো মানবসভ্যতার বিকাশের ধারাকে জানা।

তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে ইতিহাস লেখা হয় তাহাই আমাদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যুক্তিগ্রাহ্য। অনুমানের উপর ভিত্তিকরে যাঁরা ইতিহাস রচনার কথা বলেন তাঁরা জ্ঞানের অগ্রগতি স্বীকার করে না বরং বাধাদান করে। মানবজাতির ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে রচনা করা গেছে একথা কেউ দাবি করেন না। কিন্তু মোটামুটি একটা রূপরেখা যে পাওয়া গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হিন্দুত্ববাদীদের চোখরাঙানি জ্ঞানের ধারাকে স্তব্ধ করতে পারবে না।