৫৮ বর্ষ ৩য় সংখ্যা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / ১১ ভাদ্র ১৪২৭
মতাদর্শের মরণ নাই
বনবাণী ভট্টাচার্য
সেদিন মধ্যরাত্রি, পরদিন ১৫ আগস্ট, শেষ শ্রাবণের সকালে উপমহাদেশের মানুষগুলোর আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি করার সুযোগ তো হয়নি বর্তমানের অনেকেরই। তবুও নিশ্চিত, দুশো বছরের ব্রিটিশ শৃঙ্খলমুক্ত ভারতীয় মন হয়তো নিজের অজান্তেই কখন গেয়ে উঠেছিল - ‘এলেন নূতন দেশে’। স্বাধীনতা সূর্যের প্রথম আলোয় স্নাত ভারতবর্ষ, দেশগড়ার অভিযানে অজানা অনিশ্চিত চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য, জোট বেঁধে সরবে অথবা একাকী নীরবে শপথবদ্ধ হয়েছিল।
২০২০, ৫ আগস্ট। তিয়াত্তর বছর পর, রাষ্ট্রীয় ভাষণে উচ্চারিত হলো - ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হলো ৫ আগস্ট, ২০২০, অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাসের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার এমন অপব্যাখ্যা এবং অবমাননা ভূমণ্ডলে কেউ জানে কিনা, জানা নেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা অর্জন এসেছে বিদেশি শাসনমুক্ত হওয়াির মধ্য দিয়ে। দেশের মাটিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শাসন ও আধিপত্য থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম যে স্বাধীনতা জয় করে আনে, তা একমাত্র বিশ্বাসঘাতক ও মুৎসুদ্দি দালাল ছাড়া বাকি সমস্ত মানুষের উপভোগের। কিন্তু ৫ আগস্ট রামমন্দির ঘিরে যে স্বাধীনতা লাভের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাতে কি সত্যি সমস্ত ভারতবাসীর অধিকার আছে? যে স্বাধীনতা এক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনা-গৃহের সমাধির উপরে স্থাপিত হলো, সেই স্বাধীনতাকে কি ওই সম্প্রদায়ের ভারতীয়রা দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে পারেন? যে স্বাধীনতায় তাদের মসজিদের শবের গন্ধ লেগে আছে, সেই স্বাধীনতায় কি সুখের হাসির বদলে শোকের অশ্রুজল তাদের উপচে ওঠে না? এ স্বাধীনতা কি সর্বজনীন? এ কি এক খণ্ডিত ভারতীয় সত্তার নয়?
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করতেও পারেন, নাও পারেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস পছন্দ না হলে, তার বিশ্বাসের পরিপন্থী হলে তিনি পুনর্লিখন করতেই পারেন, কিন্তু কিছুতেই সত্য মিথ্যা হতে পারে না। দুশো বছরের পরাধীনতায় দেড়শো বছর ধরে চলা একটা মুক্তি সংগ্রামকে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও রক্তের বিনিময়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্ত পিপাসায় জঘন্য জিঘাংসায়, জনগণের একাংশের গোপন হিংসা চরিতার্থ করার মতো বর্বর অধ্যায়ের তুলনা করায় লক্ষ লক্ষ শহিদের আত্মদানকে অবমাননা করলেন প্রধানমন্ত্রী কোন্ অধিকারে? কোন্ হীনন্মন্যতায় মাস্টারদা-ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাণদানকে, ত্রিশূলের আগায় ভ্রূণ, পোড়া টায়ারে লেগে থাকা হাত সৃষ্টি করা অমানুষদের বীভৎস হত্যালীলার সাথে এক পংক্তিতে দাঁড় করায়, তা বুঝতে দেশবাসীর সময় লাগবে না। স্বাধীনতা দিবস এলেই, যারা মুখ লুকোবার জায়গা খুঁজে পায় না, সেই আরএসএস এবং বিজেপি নতুন এক স্বাধীনতা অর্জনের মোহ বিস্তার করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মর্যাদায় নিজেদের ভূষিত করার কৌশল আবিষ্কার করেছে। কুখ্যাত সেলুলার জেলে যে দলের একজন সাভারকার ইংরেজদের কাছে মুক্তিভিক্ষা করে ইংরেজদের পদলেহীদের অন্যতম হয়ে আন্দামানে দ্বীপান্তরিতদের তালিকায় নাম তোলা ছাড়া, দ্বিতীয় আর একজনের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি - ৫ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা, তাদের সেই লজ্জাবাস। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ, জীবন উৎসর্গ করা তো দূরের কথা, আরএসএস-র সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকারের ‘এক বীর্যবান জাতীয়তার দিকে’ নামের বইতে স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করাকে তারা জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেন না। তাই ওদের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কিছু আগেই ২৬ জুলাই বাংলা গভর্নর জন হার্বাটকে চিঠিতে লেখেন - ‘‘আপনাদের একজন মন্ত্রী হিসাবে আমি পূর্ণ সহযোগিতা জানাচ্ছি।... যুদ্ধ চলার সময় যদি জনতার আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়, সরকার যেন তা প্রতিরোধ করে।’’ ইংরেজের এই দালালদের দল, তাই ১৯৪৭ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজিকে বুলেটবিদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, আর আজ ৫ আগস্ট তারাই মূর্তি গড়তে বসেছেন মেকি এক স্বাধীনতার।
আসলে ৫ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদাদান, এক মতাদর্শের সংঘাতের ফল। প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে নিশ্চয়ই এর সূচনা, কিন্তু আজকের মতো বিশাল মহীরুহের আকার তা তখন ধারণ করেনি। মতাদর্শের সংঘাত মূলত স্বাধীনতা-উত্তরকালের সমস্যা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলাকালে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী-চরমপন্থী দ্বন্দ্ব সুবিদিত। মাস্টারদা সূর্য সেনদের সন্ত্রাসভিত্তিক বিপ্লববাদ ছিল, ছিল কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শ্রমিক-কৃষক এবং শোষিত জনগণের তুমুল গণআন্দোলনভিত্তিক মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধনের আপসহীন লড়াই। এই ত্রিধারার লড়াই কিন্তু মূলগত লক্ষ্যে অভিন্ন ছিল, অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্তি বা সর্বজনীন স্বাধীনতা। যদিও কমিউনিস্ট পার্র্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল আরও সুদূরপ্রসারী - সমাজবিপ্লবের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতাসীন করে শোষিত মানুষকে আর্থ-সামাজিক অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু এই মতাদর্শগত সংগ্রাম তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সাধারণ শত্রু হিসাবে প্রতিপন্ন করে সমস্ত দেশপ্রেমিক মানুষকে স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা দ্বিতীয়, স্বাধীনতা সর্বশেষ - এই এক স্লোগানে শামিল করার প্রয়োজনীয়তার অগ্রাধিকারই ছিল জরুরি এবং জাতীয় কংগ্রেসের আপসকামী নীতিই শুধু নয়, শ্রমিক-কৃষক, শোষিতশ্রেণির জাগরণ শেষ পর্যন্ত আর একটা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের যদি ভারতবর্ষে জন্ম দেয়, সেই আশঙ্কায় ছিল আতঙ্কিত। গান্ধীজির অল ক্লাস ইউনিটি এবং ক্লাস বেসড ইউনিটি নিয়ে এক তর্ক-বিতর্ক থাকলেও লক্ষ্মৌ এবং ফৈয়জপুর কংগ্রেসের সভায় নেহরু সভাপতির ভাষণে সমাজতন্ত্রের গন্ধ থাকায় জমিদার ও পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি হয়ে অন্য কয়েকজন শিল্পপতি সহ ঘনশ্যাম দাস বিড়লা-সর্দার প্যাটেল-রাজাজী-রাজেন্দ্র প্রসাদদের সাথে যোগাযোগের পর গান্ধীজির সাথে সাক্ষাৎ করলে, তিনি তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, গৃহীত কর্মসূচিই অনুসরণ করবেন নেহরু, বক্তৃতায় সমাজতন্ত্রের কথা বললেও। এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে তো কমিউনিস্ট পার্টিকে কংগ্রেস বহিষ্কারই করে দেয়।
বস্তুত শাসক আর শাসিতের চিন্তার যে ফারাক একটা বুর্জোয়া ভাবাবেগ রাজনৈতিক দল ও সর্বহারার দর্শনের রাজনৈতিক দলের যে মৌলিক পার্থক্য এবং দ্বন্দ্ব প্রথম থেকেই জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তা ছিলই, কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার তাগিদে, সেই দ্বন্দ্ব তীব্রতা লাভ করেনি। ফলে মতাদর্শের পার্থক্য কেবল স্বাধীনতা অর্জনের পথ ও পদ্ধতির মধ্যে সীমায়িত থেকেছে।
অনেকের মতে, ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘকাল মতাদর্শের সংঘাত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যরূপেই থেকে গেছে। সর্বভারতীয় স্তরে তা বিস্তৃত হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সংবিধানভুক্ত আর্থ-সামাজিক কর্মসূচিগুলি যখন কেবলই শিশুরাষ্ট্রের অজুহাতে মুলতবি রেখে অবহেলা করা হয়েছে, তখন মতাদর্শগত সংঘাত দানা বাঁধতে থাকে এবং রাষ্ট্রশক্তির বিরোধ বাঁধে মূলত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই। কমিউনিস্ট পার্টি তথা বামপন্থীদের শক্তি পর্যাপ্ত না হওয়ায় সেই সংঘাত সর্বভারতীয় পরিসরে বিস্তার লাভ করতে পারেনি বাঞ্ছিত মাত্রায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন, তেভাগা আন্দোলন, নৌ-বিদ্রোহ-তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ, ডাক ও তার ধর্মঘট প্রভৃতি দেশব্যাপী জঙ্গি গণআন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে ১৯৪৬ সালের বিস্ফোরণমুখী গণ-চেতনাকে বিদেশি শাসন ও দেশীয় শোষণ বিরোধী সংগ্রামে পরিণত করতে চাইলে, কমিউনিস্ট পার্টি তা আন্তরিকভাবে করা সত্ত্বেও সর্বতো সফল হতে পারেনি। কিন্তু এই সময় থেকেই কার্যত ভারতীয় রাজনীতিতে মতাদর্শের সংঘাত দেখা দেয় - শুধু পথের বিরোধই নয়, কমিউনিস্টরা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানালেও, দেশবাসীকে সতর্ক করেছে, জনগণের সংগ্রাম পড়ে আছে সামনে।
একটানা প্রায় তিরিশ বছর দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস আর এই সময়ই জুড়ে তার অনাচার, দুর্নীতি কায়েমি-স্বার্থবাদিতায় কংগ্রেস রাজনৈতিক ও শাসকদল হিসাবে নিজেই ভাঙতে থাকে এবং তার প্রাধান্য কমতে থাকে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরাও দেশব্যাপী শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। রাজনৈতিক মতাদর্শের শূন্য এলাকায় একটু একটু করে মৌলবাদী শক্তি জায়গা করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯২৫ সালে আরএসএস-র উৎপত্তির মধ্য দিয়ে হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ হয়ে, বর্তমানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং তার সংঘ পরিবারই মৌলবাদী মতাদর্শের ধারক ও বাহক, যাদের রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণ ঘটেছে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নিয়ে। এই মতাদর্শ সংখ্যাগুরুরা সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ, আবার সংখ্যালঘুর মৌলবাদকে জাগিয়ে তোলে। এরাও দৃশ্যত দ্বন্দ্বমুখীন - কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদকে রক্ষা করতে এদের তৎপরতা সমানই। স্বাধীনতা সংগ্রামকালের দ্বিজাতি তত্ত্বে তা দিতে এদের কারোরই কোনো শিথিলতা ছিল না।
স্বাধীন ভারতে শক্তির তারতম্য থাকলেও, জাতীয় কংগ্রেসের মূল বিরোধ ছিল বামপন্থীদের সাথেই। এবং সে বিরোধ সংঘাতের উৎস শ্রেণিদ্বন্দ্ব। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় এবং পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতাকা অবনমন, জনগণের দুঃখ-বেদনা ও ক্ষোভের ‘আরব-বসন্তের’ মতন নিস্ফল সংগ্রামগুলির প্রেক্ষিতে কবরের ঢাকনা খুলে ফ্যাসিবাদ একটু একটু করে মাথা তুলতে থাকে এবং বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শক্তির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে আশ্রয় নিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী এবং গণতন্ত্রের মোড়কে ক্ষুব্ধ বঞ্চিত মানুষের দাবিকে স্লোগান করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে নানান দেশে ক্ষমতা দখল করে শাসনব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী অভিমুখী করে তোলে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশেষকরে ট্রাম্প শাসন দক্ষিণপন্থী শক্তিকে পুষ্টি জোগান দেয়। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থী শক্তির এই উত্থান ভারতের রক্ষণশীল শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। সন্ত্রাসবাদ এবং ইসলাম দুনিয়াকে এক ব্র্যাকেটস্থ করার সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ভারতের মুসলিম বিরোধিতাকে ক্রমাগত বৈধতা দিতে থাকে। ফলে ১৯২৫ সাল থেকে হিন্দু মৌলবাদ অযোধ্যার রামমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের যে দাবি নিয়ে যাত্রা শুরু করে, ৫ আগস্ট সেই যাত্রা গন্তব্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কাশ্মীরের জন্য ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ ধারার বিলোপের পদক্ষেপ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত একটি সোপান নির্মাণ। বিজেপি, তার শাসনে গোটা দেশটাকে হিন্দুত্ব ও হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পরীক্ষাগারে পরিণত করছে - গোহত্যা বন্ধের নামে সংখ্যালঘু নিপীড়ন - ইতিহাস বিকৃতি ও পুনর্লিখন - পুরাণ ও গল্পকথাকে ইতিহাস প্রতিপন্ন করা - বিজ্ঞানের বদলে অপবিজ্ঞানে আস্থা, যুক্তির বদলে অলৌকিকতায় বিশ্বাস প্রভৃতিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি-আর্থ-সামাজিকতায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে।
ফ্যাসিবাদী শক্তি সঞ্চয় করে মৌলবাদী মতবাদ থেকে। আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি, যারা আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারতে, তাদের কাছে পৃথিবীর যে ইতিহাস শিক্ষণীয়, তা ওই ইতালি, জার্মানির ফ্যাসিবাদের বর্বর ইতিহাসই। তাই ভারতের ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ অথবা ৫ আগস্টের ভারতের ‘নতুন স্বাধীনতার’ অর্থ ভারতের সংবিধানকে অস্বীকার করা, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে চুরমার করে মানুষের অধিকারে আক্রমণ নামিয়ে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা মূলত সংখ্যালঘু মানুষের জন্য। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে ফ্যাসিবাদের লেলিহান আগুন সংখ্যালঘু - কমিউনিস্ট থেকে শুরু করে খ্রিস্টান, আর্যজাতির জীবন পুড়িয়েছে; এমনকি যাদের তরোয়ালের শক্তিতে হিটলার ‘ফুয়েবার’ হয়েছে, সেই হিটলার ঘনিষ্ঠদেরও মাথা কাটা গেছে ফ্যাসিবাদের তরোয়ালেই। ফলে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজশক্তির লক্ষ্য আজ ভারতের বহুত্ববাদ নস্যাৎ করে ধর্মনিরপেক্ষতার বর্ম ভেঙে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদীদের বিকাশ ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা। ইংরেজ সাহিত্যিক টম জোনসের পাদ্রী Rev. Mr. THWACKUM বলেছিলেনঃ ‘‘আমি যখন বলি ‘ধর্ম’, তখন আমি বোঝাতে চাই ‘খ্রিস্টান’ ধর্ম, আর শুধু খ্রিস্টানই নয়, ‘প্রটেস্টান’ ধর্ম শুধু ‘প্রটেস্টান’ নয়, ‘চার্চ অব ইংল্যান্ডের’ ধর্ম।’’ মোদীর স্বাধীনতা ও সকলের বিকাশও তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে কেবল হিন্দুর স্বাধীনতা, হিন্দুরই বিকাশ।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর চার্চিল সাম্রাজ্য-গরিমা হারিয়ে ক্ষোভে বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা লোপ পাবে, খড়ের মানুষরা রাজাসনে বসায় (Man of Straw)। মোদী সরকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সেই ইচ্ছারই রূপ দিতে চলেছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যাবে। এ লড়াই যেমন রুটির, এ লড়াই তেমনি মতাদর্শের, গণতন্ত্রের ও ধর্মনিরক্ষেতার পক্ষের। স্মরণ রাখতে হবে, ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে সেকুলার এবং সমাজতান্ত্রিক শব্দ দুটি যুক্ত করা হয়, তা কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের পাঁচের দশক থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনী প্রচার ও বিপ্লবী রাজনীতির চাপেই। ইতিহাস সত্যিই সাক্ষী দেয়, শাসক নয়, স্বৈরাচার নয়, ফ্যাসিবাদও নয়, মানুষ আর তাঁর মনুষ্যত্বই শেষ জয়ে জয়ী হয়। নয়তো হিটলারের পোড়া শরীর আর মুসোলিনির ঝুলন্ত দেহ দেখতে পাওয়া যেত না। মানবতার শত্রুরা কোনোদিন চওড়া হাসি হেসে উচ্চারণ করতে পারবে না ‘এন্ড অফ ইডিওলজি’ অথবা ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি’।