৫৮ বর্ষ ৩য় সংখ্যা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / ১১ ভাদ্র ১৪২৭
করোনা-আবহে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা
সৃজন ভট্টাচার্য
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে কলেজ স্ট্রিট ছাত্রদের মিছিল।
করোনা। সামান্য একটা ভাইরাসই এখন থমকে দিয়েছে মানবসভ্যতাকে। সংবাদমাধ্যম প্যান্ডেমিকের নিকটতম বাংলা অনুবাদ বার করেছে অতিমারী। এই অতিমারী যেভাবে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটাচ্ছে, তার জন্য চিন্তিত আমি আপনি সবাই। লকডাউনে অভ্যস্ত নই কেউই, অথচ স্বেচ্ছাবন্দি থাকাটাই এই মুহূর্তের সবথেকে জরুরি কাজ। এসএফআই’র অবশ্য পুরোটা ঘরে থাকার ফুরসৎ নেই - মানুষ যাতে ঘরে বেঁচেবর্তে থাকেন, আমরা সেজন্য রাস্তায়। হ্যাঁ, চিকিৎসকদের পরামর্শ, প্রশাসনের নির্দেশ - সবটা মেনেই।
যখন প্রথম করোনা নিয়ে প্রাথমিক আশঙ্কা তৈরি হতে থাকে, আমরা বিভিন্ন জেলার এসএফআই ইউনিটগুলিকে খবর দিয়ে কতগুলো সাধারণ কথাই বলেছিলাম। কমরেডদের সাবধানে থাকতে বলা, বড়ো জমায়েত এড়িয়ে যাওয়া, ছোটো ছোটো গ্রুপে ভাগ হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার ইত্যাদি। লিফলেট বানিয়ে বিলি করা হয় রাজ্যজুড়ে, আমাদের মেডিক্যাল সেকশনকে বলা হয় বাড়তি ভূমিকা নিতে। তখনও লকডাউন ঘোষিত হয়নি।
মূলত স্যানিটাইজার এবং সাথে মাস্ক, সময়ের সাথে প্রয়োজন বাড়ে দুয়েরই। সরকার পারছে না সর্বত্র, আমরা কি ঘরে বসে থাকব? কমরেডরা নেমে পড়ল স্যানিটাইজার বানাতে। অধিকাংশ এলাকাতেই যৌথভাবে কাজ করতে এগিয়ে এলেন যুব আন্দোলনের কমরেডরাও। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, ছাত্রযুব আন্দোলনের কর্মীরা নিজেরাই মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বানিয়ে বিলি করছে এলাকার মানুষের মধ্যে - এই কয়েক মাসে এটা মোটামুটি পরিচিত দৃশ্য হয়ে উঠেছে। লকডাউন ঘোষণা হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গোটা সংগঠন যেন বলে উঠল, আমরা পাশে আছি মানুষের।
প্রায় সমস্ত জেলার অভিজ্ঞতা - মানুষ হঠাৎ অসুবিধায় পড়ে গিয়েছেন ব্যাপক। আমাদের দেশে লকডাউন ‘এনজয়’ করার বিলাসিতা দেখাতে পারেন এমন মানুষ কতই আর? ফোন আসছে নিরন্তর। অন্য রাজ্যে কেউ আটকে পড়েছেন, যোগাযোগ করতে হবে - কমরেডরা আছে। বয়স হয়েছে, বাজার করা দায়, চাল ডাল তেল পৌঁছে দেওয়া - কমরেডরা আছে। ঋতুচক্রের সময়, স্যানিটারি ন্যাপকিন চাই, বেরনো যাচ্ছে না - কমরেডরা আছে। খাবার ফুরিয়ে গিয়েছে, টাকাপয়সা শেষের পথে, অভুক্ত যাতে না থাকেন কেউ - কমরেডরা আছে। ওষুধপথ্য তো বটেই, রক্তও যদি লাগে কারও - কমরেডরা আছে। রাজ্যজুড়ে রক্তের সঙ্কট, তার মধ্যেই, প্রশাসনের অসহযোগিতা সত্ত্বেও, কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত’র শহিদদিবসকে কেন্দ্র করে হাজার ইউনিট রক্ত দিল এসএফআই কর্মীরা। যত সময় এগলো, প্রয়োজন পড়ল অ্যান্টিবডি টেস্ট সংগঠিত করা, বা এলাকা স্যানিটাইজেশনের মতো কাজে হাত লাগানোরও। এক্ষেত্রেও বাকিদের সাথে আগুয়ান থেকেছে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। কোথাও কোথাও ‘কোভিড ভলান্টিয়ার’ বাহিনী তৈরি করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ বামপন্থীরা করেছেন, তা হলো কমিউনিটি কিচেন বা জনগণের রান্নাঘর গঠন করে দরিদ্র মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ। গোটা রাজ্যে যে কয়েকশো কমিউনিটি কিচেন চলেছে, তার জোগাড়যন্ত্রের নেপথ্যেও উৎসাহী ভূমিকা পালন করেছে তরুণ প্রজন্ম।
দু’একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ার নিয়ে যেতে হবে অসুস্থ ব্যক্তিকে, গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না কোনোমতে, এমনকী প্রশাসনও সুরাহা করতে পারছে না। দু’দিন অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর এসএফআই কর্মীরা জোগাড় করে দিলেন গাড়ি, সাবধানে বাড়ি ফিরে গেলেন ওই অসুস্থ ব্যক্তি। আর এক জায়গায় দেখলাম, লকডাউনের জন্য অন্তঃসত্ত্বাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন আমাদের কর্মীরা; পরে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, মা ও সদ্যোজাত শিশু দুজনেই সুস্থ রয়েছেন। মুখে হাসি ফুটতে না ফুটতে ফোন এলো, দমদমের ঘটনা - করোনা রোগীকে চিহ্নিত করা হলেও পিপিই পরা সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী তাকে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না - স্থানীয় এসএফআই নেতা অসীম সাহসে ভর করে এগিয়ে এসেছে। মরদেহের শেষকার্য সম্পন্ন করার লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, এগিয়ে এসে হাত লাগিয়েছে বাম ছাত্রযুব কর্মীরা।
শুধু রাস্তায় নেমে ত্রাণকার্যে হাত লাগানোই নয়, এসএফআই থেকেছে বইখাতা’র সমস্যাতেও। লকডাউন ঘোষণা হতেই বোঝা গেল, একধাক্কায় লেখাপড়া পিছিয়ে যাবে অনেকটাই। সিবিসিএস-এর সময়ে - সিলেবাস বাকি পড়ে যাওয়ার ঝক্কি অনেক। তাই, লেখাপড়া - খানিক এগিয়ে রাখার জন্যেই আমরা অনুরোধ করেছিলাম বিশিষ্ট অধ্যাপকদের, যদি তাঁরা অনলাইনেই ক্লাস করাতে সম্মত হন। তাঁদের সম্মতিতে শুরু হলো অনলাইন আলোচনা - পোশাকি নাম ‘কোয়ারেন্টাইন ক্লাসরুম’। তবে এখনো দরিদ্র প্রান্তিক অংশের কাছে পৌঁছনো বাকি, যে ছাত্রের বাড়িতে অন্তত একটাও স্মার্টফোন নেই, তারই কাছে লেখাপড়ার উপাদান পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে বাড়তি ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন - এটাও বারবার বলছি আমরা। দাবি থাকছেঃ মিড-ডে মিল প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি ছাত্রের বাড়িতে রোজ খাবার পৌঁছে দেওয়ার, দাবি থাকছে স্কুল-কলেজে লকডাউন পিরিয়ডের ফি’টুকু মকুবেরও। গবেষকদের স্টাইপেন্ডের সমস্যা নিয়েও সোচ্চার হয়েছি আমরা। দেশের বা রাজ্যের ভিতরে ঘর থেকে দূরে আটকে-পড়া ছাত্রদের জন্যও বাড়তি ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে এসএফআই। বস্তুত, এই সময়টাকে ব্যবহার করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, তার বিরুদ্ধে বারংবার সোচ্চার হতে হয়েছে বাম ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের। কখনো জোর করে পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা, কখনো লাগামছাড়া ফি, কখনো রেজাল্ট ও ভরতি বিভ্রাট, কখনো বা ‘ডিজিটাল ডিভাইস’- এসএফআই ঘরের বারান্দায় পোস্টার হাতে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেনে আবদ্ধ রাখেনি নিজেকে, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই একাধিকবার নেমেছে রাস্তাতেও।
এদেশে শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র নামে - এসএফআই বর্তমানে এই সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে বিরামহীন। লড়াইয়ের পাশেই চলছে রিলিফের কাজ - ছাত্রদের হাতে রাজ্যজুড়ে চলছে বইখাতা পেন পেন্সিল খাদ্যসামগ্রী সংবলিত লেখাপড়ার ‘কিট’ তুলে দেওয়ার কাজ। ভর্তি প্রক্রিয়ায় হেল্পডেস্ক বানিয়ে সাহায্য করার কাজ থেমে নেই প্যান্ডেমিকের মধ্যেও।
এই সময়েই আমাদের রাজ্যে করোনার পাশাপাশি আরেকটা দ্বিতীয় আঘাত হেনেছে প্রকৃতি। আমফান ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা। শুধু রাস্তায় নেমে গাছপালা সরানোর কাজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণই নয়, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্যে ভর করে ত্রিপল, শুকনো খাবার, ওষুধ, জামাকাপড় ইত্যাদি নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটেও গিয়েছে এসএফআই কর্মীরা। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে গিয়েছে রাজ্য কমিটির দল - চালচোরদের দৌরাত্ম্যে অস্থির মানুষ সাদরে বরণ করেছেন সাহায্য। আমরা জানিয়ে এসেছি, এই সাহায্য কোনো ত্রাণ নয়, সংহতি বড়জোর। দুই সরকার মিলে যখন লকডাউনেও বেচে দিচ্ছে রেল, দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুতের, পৌঁছে দিচ্ছে না প্রয়োজনীয় রেশন - তখন সবাই মিলে এক হয়ে প্রতিরোধ করাটাই নিয়ম, মানুষ বাঁধার বার্তা দিতে চেয়েছে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা এসময়ে। আমরা নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছি - নো টু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, ইয়েস টু ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং। আমরা সামাজিক সংহতির পক্ষে, সামাজিক দুরত্ব এই কঠিন সময়ে মানুষকে একে অন্যের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করবে না। এই সময়টা বিজ্ঞানমনস্কতার।
এই সঙ্কটকে যারা গোমূত্র খাইয়ে আর যজ্ঞ করে পার করাতে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে যাদবপুরের ছেলেমেয়েদের বানানো ‘লকডাউন কমিকস’। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গানে গল্পে আড্ডায় আমরা বার্তা দিচ্ছি যৌথতার, সৌভ্রাতৃত্বের।
এই সময় রাজনীতির লড়াইয়েরও বটে। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করেও বামপন্থীদের সম্বন্ধে কুৎসা ছড়ানোর কাজ অব্যাহত রেখেছে আরএসএস। আমরা বলছি, সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এখন লড়তে হবে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য। মানবসভ্যতাকে রক্ষার শ্রেষ্ঠ পথ যে বামপথই, তা ফের প্রমাণ হয়েছে বিশ্বজোড়া অতিমারীতে। আমরা মতাদর্শের লড়াইটাও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি। ‘ছাত্র সংগ্রাম’ পত্রিকার ডিজিটাল সংস্করণ শুরু হয়েছে, কর্মীদের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে ‘বই তরণী’ নামক রাজনৈতিক পাঠ্যপুস্তকের সংকলনও। বিভিন্ন আলোচনা, ছোটো সভা, ফেসবুক লাইভ - ইত্যাদির মাধ্যমে নিরন্তর প্রচেষ্টা জারি আছে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে মানোন্নয়ন ঘটানোর।
এখনো অনেক জায়গায় নামা যায়নি। যতদূর নামলে শান্তিতে ঘুমানো যেত রাতে, তার ধারেপাশেও যাওয়া যায়নি এখনো। বাকি অনেক পাড়া, অনেক অঞ্চল, অনেক গ্রাম। সঙ্কট বাড়ছে, চাহিদাও বাড়ছে রোজ। এই সময়টা কর্তব্য পালনের, এবং রাজ্যজুড়ে বাম ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা যে কাজ করছেন, তা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য। আমরা সেলাম জানাতে চাই তেমন সকল কমরেডকে, যারা কোনো না কোনোভাবে এই কঠিন কঠিনতর হতে থাকা পরিস্থিতিটাকে বাকিদের জন্য একটু সহজ করে তোলার চেষ্টা করছেন। আমরা গর্বিত, আমাদের সহযোদ্ধাদের জন্য।
এখনও বেশকিছু দিন এই অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হবে সকলকে। সাবধানে থাকবেন সকলে। কোথাও কোনো অসুবিধা হলে, আমাদের যে কাউকে জানাতে পারেন। যে কোনো দরকারে আমরা আছি, এটুকুই বলার।