৫৯ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ / ১৪ মাঘ, ১৪২৮
২৩ জানুয়ারি নেতাজি’র জন্মদিবস ‘দেশপ্রেম দিবস’ হিসেবে পালিত সারা রাজ্যে
কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন বিমান বসু।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবসকে দেশপ্রেম দিবস হিসেবে রাজ্যজুড়ে উদ্যাপন করেছে বামফ্রন্ট। এই উপলক্ষে কলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ নেতাজিকে নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চালাকির রাজনীতির নিন্দা করে সাম্প্রদায়িক ও জাতের নামে বিভাজনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা উচ্চারণ করেন। তাঁরা নেতাজির দেশভাবনা নিয়ে বিস্তৃত চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
এই অনুষ্ঠানে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, নেতাজিকে নিয়ে চালাকির রাজনীতি করে জনগণের স্বার্থরক্ষা করা যায় না। নেতাজি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতপাতের নামে বিভাজনের বিরুদ্ধে এবং অবৈজ্ঞানিক চিন্তার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর সেই চিন্তাভাবনা স্বাধীন ভারতে কতটা রূপায়ণ করা গেছে তা নিয়ে চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। তার বদলে কেবল মূর্তির কথা বলে রাজনীতি করলে নেতাজির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে না।
এদিনের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নেতাজি জন্মজয়ন্তী কমিটির কার্যকরি সভাপতি বরুণ মুখোপাধ্যায়। নেতাজি জন্মজয়ন্তী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ফরওয়ার্ড ব্লক বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি নেতাজি বিষয়ক লেখা প্রকাশে লোকমত প্রকাশনীর উদ্যোগের কথা জানান। তিনি বলেছেন, বারবার দাবি করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার নেতাজির জন্মদিবসকে দেশপ্রেম দিবস হিসেবে ঘোষণা করেনি। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার নেতাজির জন্মদিবসকে দেশপ্রেম দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পরে তা বজায় রাখা হয়নি। যারা নেতাজিকে উপেক্ষা করছে, জনগণও তাদের উপেক্ষাই করবে।
অনুষ্ঠানে সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, মোদি সরকার এবং তৃণমূল সরকার নেতাজিকে ‘রিয়েলিটি’ থেকে সরিয়ে ‘ভার্চুয়ালিটি’তে আবদ্ধ করার চেষ্টা করছে। আজকের দিনে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে নেতাজির জীবনচর্যা, রাজনীতি, দর্শন, সংগ্রাম, স্বাধীন ভারতের পরিকল্পনাকে নিয়ে চর্চার দরকার। এগুলিকে গুলিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলছেন রাজধানী দিল্লিতে নাকি নেতাজির প্রথম মূর্তি স্থাপন করবেন। দিল্লিতে লালকেল্লার সামনে সুভাষ পার্কে নেতাজির মূর্তি আছে। এখন সংকীর্ণ রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি অমর জ্যোতি নিভিয়ে ঢাল হিসেবে নেতাজির ভার্চুয়াল মূর্তি দেখাচ্ছেন। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ভোটের আগে নেতাজিকে নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোথায় গেল রাজারহাটে আজাদ হিন্দ স্মারক? কোথায় নেতাজির নামে বিশ্ববিদ্যালয়? একবছর ধরে নেতাজির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি কী করেছে? সব প্রতিশ্রুতিই থেকে গেছে।
তিনি বলেন, নেতাজি সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণ বিভাজনের বিরোধী ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা এগুলি ব্যবহার করে কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্য ধ্বংসের চেষ্টা করছে সেই সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। যে নেতাজি বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, গতবছর সেই নেতাজির জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে বিভাজন তৈরি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে। নেতাজি দেশবাসীর ঐক্যের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারত গঠনের জন্য লড়াই করেছিলেন, আমরা নেতাজির জন্মদিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সেগুলি রক্ষার শপথই গ্রহণ করব।
সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস বলেছেন, আজ যারা ক্ষমতায় বসে থাকতে দেশের মানুষকে বিভাজন করছে, তাদের বিরুদ্ধে নেতাজির আদর্শে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য, তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়। সিপিআই (এম) নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী প্রমুখ অন্যান্য নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।
এদিন বামফ্রন্ট এবং বামপন্থী গণসংগঠনের উদ্যোগে জেলায় জেলায় নেতাজির জন্মদিবস দেশপ্রেম দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। কোভিডবিধি মেনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, নেতাজির প্রতিকৃতি ও মূর্তিতে মাল্যদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট কর্মীরা নেতাজির আদর্শে সাম্প্রদায়িক ঐক্য রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন।
কলকাতায় মোমিনপুরে নেতাজি জন্মজয়ন্তী ও স্পোর্টস প্রোগ্রাম কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় হুসেন শাহ পার্কে নেতাজি জয়ন্তী পালিত হয়। অনুষ্ঠানের সূচনায় পতাকা উত্তোলন করেন মহম্মদ সেলিম। অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোর সহ বিভিন্ন বয়সি মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।
কলকাতার ৯২নং ওয়ার্ডে বামফ্রন্টের পক্ষে আয়োজিত দেশপ্রেম দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বামফ্রন্ট কাউন্সিলর মধুছন্দা দেব সহ বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। এসএফআই, ডিওয়াইএফআই’র পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় দেশপ্রেম দিবস পালিত হয়েছে। ছাত্র ব্লকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে রাজ্যের বিভিন্নস্থানে দেশপ্রেম দিবস পালনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক ঐক্য রক্ষার আহ্বান জানানো হয়। কলকাতার নাকতলায় জয় হিন্দ দেশপ্রেমী মঞ্চের পক্ষ থেকে নেতাজির জন্মদিবসে দেশপ্রেম দিবস পালিত হয়। এই উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নেতাজির ওপর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সুজন চক্রবর্তী, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা পাপিয়া দেবরাজন উপস্থিত ছিলেন।
দেশপ্রেম দিবসে নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন মেদিনীপুরে।
কলকাতা ছাড়াও জেলায় জেলায় এই দিনটি দেশপ্রেম দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক হাসপাতাল মোড়ে নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নিরঞ্জন সিহি, সিপিআই (এম) নেতা হিমাংশু দাস, আরএসপি নেতা অমৃত মাইতি, সিপিআই’র গৌতম পণ্ডা, রীতা দত্ত, অমল কুইলা প্রমুখ। এছাড়া কাঁথি জুনপুট মোড়ে সুকুমার সেনগুপ্ত ভবনের সামনে নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়েছে। খেজুরিতে এসএফআই’র উদ্যোগে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে সিপিআই (এম) জেলা দপ্তরে নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টি নেতা রাহুল ঘোষ। বারুইপুরের বিশালাক্ষীতলা থেকে পদ্মপুকুর পর্যন্ত বর্ণাঢ্য মিছিল হয়েছে। ছাত্র, যুব, রেড ভলান্টিয়ার্স, পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চ প্রভৃতি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনটি পালিত হয়। কোদালিয়ায় নেতাজির পৈত্রিক বাড়িতে নেতাজির আবক্ষ মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টি নেতৃবৃন্দ।
নদীয়া জেলা বামফ্রন্টের উদ্যোগে কৃষ্ণনগর পোস্ট আফিস মোড়ে নেতাজির মূর্তিতে মাল্যদান করেন বামফ্রন্টের বিভিন্ন শরিক দলের নেতৃবৃন্দ। প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন অশোক ব্যানার্জি, শঙ্কর সরকার, অদ্বৈত বিশ্বাস প্রমুখ। এসএফআই পলাশীপাড়া আঞ্চলিক কমিটি বার্নিয়া খেলার মাঠে আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। এদিন পিপলস ভলান্টিয়ার তাহেরপুর ফেসবুক পেজে ‘সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার’ শীর্ষক একটি লাইফ অনুষ্ঠান হয়। কল্যাণী, কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণগঞ্জ প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে, কৃষ্ণনগরে ক্ষৌনিশ পার্কের পাশে নেতাজির মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ।
হাওড়া জেলায় গ্রাম ও শহরাঞ্চলে সর্বত্র দেশপ্রেম দিবস পালিত হয়েছে। এসএফআই, ডিওয়াইএফআই জেলার সর্বত্র দিনটি পালন করে। উত্তর হাওড়ায় রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত হয়।
মেদিনীপুর শহরের কলেজ ময়দানে নেতাজির মূর্তিতে মাল্যদান করেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিভিন্ন স্থানে এবং ঝাড়গ্রামেও দিনটি পালিত হয়েছে।
হুগলি জেলায় বামফ্রন্টের শরিক দলগুলি এবং এসএফআই, ডিওয়াইএফআই সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের উদ্যোগে নেতাজির জন্মদিন পালিত হয়েছে। শ্রীরামপুর, রিষড়া, কোন্নগর, সিঙ্গুর, বৈদ্যবাটি সহ বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, পদযাত্রা, প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ইত্যাদির মাধ্যমে দিনটি পালিত হয়।
উত্তর ২৪ পরগনায় জেলা বামফ্রন্টের উদ্যোগে বারাসতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন দেশপ্রেম দিবস হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া বারাকপুর, নোয়াপাড়া, কাঁচরাপাড়া, ভাটপাড়া, জগদ্দল, দক্ষিণ দমদম, নিউটাউন, বিধাননগর প্রভৃতি স্থানে পার্টি ও বিভিন্ন গণসংগঠন ও রেড ভলান্টিয়ার্সের উদ্যোগে মিছিল, রক্তদান শিবির, বস্ত্র বিতরণ, মানব বন্ধন প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়।