E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ / ১৪ মাঘ, ১৪২৮

মতাদর্শ ও রাজনীতির ভিত্তিতে পার্টিকে সুসংহত করে শ্রেণি ও গণআন্দোলন তীব্র করতে হবে

সিপিআই(এম) মালদহ জেলা সম্মেলনের আহ্বান

উৎপল মজুমদার


পার্টির নিজস্ব স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধির কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া, মতাদর্শ এবং রাজনীতির ভিত্তিতে পার্টিকে সুসংহত করা, ধারাবাহিকভাবে শ্রেণি আন্দোলনকে গ‌ড়ে তোলা এবং গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্র বা‌ড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে সিপিআই(এম) মালদহ জেলা ২৩তম সম্মেলন থেকে। এছাড়াও সম্মেলন ডাক দিয়েছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সংবিধান বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রচার ও আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটানো, কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের জনবিরোধী আর্থিক নীতির ফলে জনগণের যে দুর্দশা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে ব্যবহার করে মানুষকে আন্দোলনে শামিল করতে হবে যাতে পার্টি ও গণসংগঠনকে উদ্যোগ নি‌য়ে আন্দোলন-সংগ্রামকে এগি‌য়ে নি‌য়ে যাওয়া যায়। করোনাবিধি মেনে ১৯-২০ জানুয়ারি মালদহ শহরে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী নগরে কমরেড তুষার ভট্টাচার্য ও কমরেড মনসুর রহমান মঞ্চে (মালদহ টাউন হল) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ‌য়।

সম্মেলনের পতাকা উত্তোলন করেন জেলা পার্টির প্রবীণ নেতা রণজিত চক্রবর্তী। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন রণজিত চক্রবর্তী, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুমিত দে, জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র, রাজ্য কমিটির সদস্য সোমনাথ ভট্টাচার্য, জামিল ফিরদৌস, পার্টির প্রবীণ নেতা বিশ্বনাথ ঘোষসহ পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যগণ, জেলা কমিটির সদস্য, এরিয়া কমিটির সম্পাদক, গণফ্রন্টের নেতৃত্ব সহ আগত প্রতিনিধিরা।

এরপর শুরু হ‌য় প্রতিনিধি সম্মেলনের কাজ। ভারতী‌য় গণনাট্য সংঘের উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর গঠিত হ‌য় সভাপতিমণ্ডলী, স্টিয়ারিং কমিটি, অনুলেখন কমিটি ও ক্রেডেনশিয়াল কমিটি। সভাপতিমণ্ডলীতে ছিলেন বিশ্বনাথ ঘোষ, নৈমুদ্দিন সেখ, মোজাফ্‌ফর হোসেন, সাধু টুডু, ছবি দেব এবং স্টিয়ারিং কমিটিতে ছিলেন অম্বর মিত্র, জামিল ফিরদৌস, প্রণব দাস, প্রণব চৌধুরী, দেবজ্যোতি সিনহা, আরজাউল হক। এরপর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন নৈমুদ্দিন শেখ। নীরবতা পালনের পর সম্মেলন উদ্বোধন করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুমিত দে।

উদ্বোধক সুমিত দে তাঁর ভাষণে বলেন, বিগত সম্মেলনের পর চার বছরে, বিশেষত কোভিড পরিস্থিতির মধ্য দি‌য়ে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নূতন। বিশেষত মানুষের পাশে থাকা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম,যারা রেড ভলান্টিয়ার হিসেবে পরিচিত, দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁিড়‌য়েছে। এই তরুণ প্রজন্ম আমাদের পার্টির সম্পদ ও ভবিষ্যত। গত এক বছর ধরে রাজ্যে ও দেশে যে আন্দোলন সংগ্রাম হ‌য়েছে, বিশেষত কৃষক আন্দোলন যে শিক্ষা দি‌য়েছে তাতে লালঝান্ডার গুরুত্ব যেমন বে‌ড়েছে, তেমনি আগামীতে আন্দোলন সংগ্রামকে এগি‌য়ে নি‌য়ে যেতে সহা‌য়ক হবে।

তিনি বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট ক‌য়েক দশক ধরে মন্দা কাটাতে পারছে না। এটা অনিবার্য। পুঁজিবাদী শোষণের ফলে যে সংকট উন্নত দেশের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে তা থেকে বের হতে পারছে না। এখন কর্পোরেট সংস্থাই সব ঠিক করে দিচ্ছে। ওদের একমাত্র লক্ষ্য দেশকে সিপিআই(এম) তথা বামপন্থীদের হাত থেকে মুক্ত করা। প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে এদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তাই এই মুহূর্তে সিপিআই(এম) কর্মীদের সবচে‌য়ে বড়ো কাজ পুঁজিবাদী শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মতাদর্শের রাজনীতিকে সামনে এনে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে পার্টিকে শক্তিশালী করা। সম্মেলন মঞ্চ থেকে এই শপথ গ্রহণ করতে হবে।

সুমিত দে বলেন, দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নি‌য়ে আগামীতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গ‌ড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা কোনো আসন পা‌য়নি। তাই আমাদের দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে কাটাতে হবে। শাখা থেকে এরিয়া কমিটি - সর্বত্র দুর্বলতা দূর করে জেলা স্তরে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।

উদ্বোধনী ভাষণের পর খস‌ড়া প্রতিবেদন পেশ করে বিদায়ী জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেন, বিগত দশ বছর রাজ্যে আমরা বিরোধী ভূমিকা পালন করছি। আক্রমণ, সন্ত্রাস সহ বহু চক্রান্ত মোকাবিলা করেই আমাদের এগোতে হবে। এই সম‌য়ে প্রচুর তরুণ আমাদের পাশে এসেছেন। এদের উপযুক্ত মর্যাদা দি‌য়ে পার্টি সংগঠনে স্থান দিতে হবে। গরিব শ্রমজীবী মানুষের ল‌ড়াই-আন্দোলনকে এগি‌য়ে নি‌য়ে যেতে হবে এবং লালঝান্ডার সম্মানকে বৃদ্ধি করতে হবে।

সম্মেলনে মোট ২৮৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবেদনের উপর ৪৮জন প্রতিনিধি আলোচনা করেন। তাঁরা জেলার বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন এবং আগামীদিনে পার্টিকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেন। এরপর জবাবি ভাষণ দিতে গি‌য়ে অম্বর মিত্র বলেন, বিধানসভার নির্বাচনে ফলাফল যাই হোক না কেন সামনে ফেব্রুয়ারি মাসে যে পৌরসভা নির্বাচন হবে তাতে ল‌ড়াই‌য়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। জেলা‌য় দুটি পৌরসভা‌য় মোট ৪৯টি আসন। ইংরেজবাজারে ২৯টি ও পুরাতন মালদহে ২০টি আসন। এই আসনগুলিতে ল‌ড়াই করতে বামফ্রন্ট প্রস্তত। মনে রাখতে হবে মানুষ ক্রমশ তৃণমূল-বিজেপি সম্পর্কে মোহমুক্ত হচ্ছে।

সম্মেলনে দেশ, রাজ্য ও জেলার সমস্যা নি‌য়ে বেশ ক‌য়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হ‌য়। মালদহ জেলার নদীভাঙন, বিশেষত গঙ্গা, কোশী, ফুলহর সহ অন্যান্য নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পুনর্বাসন, ভাঙন প্রতিরোধ এবং জীবন জীবিকার সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ, জাতী‌য় স্বার্থ ও নিরাপত্তা বজা‌য় রেখে সীমান্ত এলাকা‌য় বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যার সমাধান এবং উন্ন‌য়নের দা‌য়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারকে নেবার দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছা‌ড়া গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম, সম্প্রীতি রক্ষার সংগ্রামকে শক্তিশালী করা,শিক্ষাবিরোধী জাতী‌য় শিক্ষা নীতি বাতিল করা, শ্রমকোড প্রত্যাহার, সমবা‌য়কে ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে, করোনাবিধিকে মান্যতা দিয়ে পঠন পাঠন সহ শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখা, সকলের কাজ এবং সবাইকে ভ্যাকসিন দি‌য়ে জনজীবনকে স্বাভাবিক করার প্রস্তাব গৃহীত হ‌য়।

সম্মেলনকে অভিনন্দন জানি‌য়ে বক্তব্য রাখেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এবং রাজ্য কমিটির সদস্য সোমনাথ ভট্টাচার্য। মহম্মদ সেলিম তাঁর ভাষণে বলেন, রাজ্যে কর্পোরেট নির্দেশিত মিডিয়ায় একটাই প্রচার চলছে - হ‌য় তৃণমূল ন‌য় বিজেপি। এতে শুধু সাধারণ মানুষ ন‌য়, বিভ্রান্ত হচ্ছেন অনেক রাজনৈতিক কর্মীরাও। এবারের ভোটের পরেও এই প্রচার চলছে। সবই চলছে মানুষকে বিভাজিত করে সিপিআই(এম)-কে একা করে দিতে। এটি সংঘ পরিবারের পরিকল্পনা। এজন্যই মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি এ রাজ্যের শাসক দল সন্ত্রাস চালি‌য়ে, ভোটের অধিকারকে কে‌ড়ে নি‌য়ে ক্ষমতা দখল করছে। তাই আমাদের প্রথম ও একমাত্র কাজ সংগ্রাম আন্দোলনের মধ্য দি‌য়ে পার্টিকে শক্তিশালী করা। আর একাজে তৃণমূল-বিজেপি - এই দুই বিপজ্জনক শক্তির বিরুদ্ধে রাজ্যের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগি‌য়ে যেতে হবে। এটাই পার্টি তথা কর্মীদের এই মুহূর্তের সবচে‌য়ে বড়ো দা‌য়িত্ব ও কর্তব্য।

সোমনাথ ভট্টাচার্য বলেন, সিপিআই(এম) কর্মীরা যে মানুষের সাথে ও পাশে থাকেন তা প্রমাণিত হ‌য়েছে বিধানসভা ভোটে হারার পরও করোনা আক্রান্তদের পাশে আমাদের কর্মীরা দাঁড়ি‌য়েছেন রাজনীতির মতপার্থক্য উপেক্ষা করেই। একইভাবে লকডাউনের সম‌য় এ রাজ্যে কাজ না পে‌য়ে ভিন রাজ্যে যারা কাজে গি‌য়েছিলেন, কাজ হারি‌য়ে ফিরে আসা সেই পরিযা‌য়ী শ্রমিকদের পাশে ছিলেন আমাদের কর্মীরাই। অন্যদের কোথাও দেখা যা‌য়নি। তাই আর অন্য কোনো দলের সাথে আমাদের যদি মেলানোর চেষ্টা যারা করে তারা ভুল।

সম্মেলনে পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনের শেষ পর্বে ৫০ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হ‌য়। এছা‌ড়া ৩ জন আমন্ত্রিত সদস্য রয়েছেন। পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জেলা কমিটির প্রথম সভা থেকে জেলা সম্পাদক হিসাবে অম্বর মিত্র পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।