৫৯ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ / ১৪ মাঘ, ১৪২৮
কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের জীবনাবসান
দেশহিতৈষী পত্রিকার প্রবীণ কর্মী এবং সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কেন্দ্রের অন্তর্গত দেশহিতৈষী ১নং শাখার সদস্য কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। গত ১৫ জানুয়ারি অসুস্থতার জন্য তাঁকে বজবজের একটি নার্সিংহোমে ভরতি করা হয়েছিল। সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এবং নিউমোনিয়া ও কোভিড সংক্রমণের জন্য তাঁকে মঙ্গলবার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই তিনি প্রয়াত হন। বয়স হয়েছিল ৮৭। তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা সহ অন্যান্য আত্মীয়-পরিজন রয়েছেন।
কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের জীবনাবসানে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। শোক জানিয়েছেন দেশহিতৈষী পত্রিকার সম্পাদক প্রণব চট্টোপাধ্যায় সহ পত্রিকার সহকর্মীরা। দেশহিতৈষী পত্রিকায় দীর্ঘ ৫০ বছরের সহকর্মী ও বন্ধুকে হারিয়ে গভীর বেদনা প্রকাশ করেছেন এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২১ জানুয়ারি, শুক্রবার দুপুরে কোভিডবিধি মেনে নিমতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
এদিন বিমান বসু প্রয়াত কমরেডের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘‘কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজের ছাত্র। ১৯৬৬ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে আমাদের একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল ছাত্র বহিষ্কারের প্রতিবাদে, তাঁদের শিক্ষাজীবন সচল রাখার দাবিতে। সেদিন রাত ১১টা নাগাদ আচমকা পুলিশ আমাদের উপরে হামলে পড়ে। আমাদের গ্রেপ্তার করে লালবাজার সেন্ট্রাল সেলের তিনতলায় রাখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যও ছিলেন। তখন তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের নৈশ বিভাগের ছাত্র। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি, প্রবল আর্থিক সমস্যার মধ্যে তাঁকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে অনেক সময়ে তাঁর পড়াশোনায় ছেদ পড়েছে। তাই একটু বেশি বয়সে তিনি স্নাতক হয়েছেন এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইন পাশ করেছেন। শুনেছি, লেখাপড়া ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি উত্তর কলকাতার বাজারে সবজিও বিক্রি করেছেন। রাজনীতি করার অপরাধে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে শত্রুর আক্রমণের শিকারও হতে হয়েছে এবং বাসস্থানও দু’-একবার বদলাতে হয়েছে। তিনি আমাদের পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতি বরাবর একনিষ্ঠ ছিলেন। দেশহিতৈষী পত্রিকায় যুক্ত হওয়ার পর নিয়মিত তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন। আমি কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর পরিবারের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।’’
দেশহিতৈষী পত্রিকার উদ্যোগে কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের স্মরণসভা ২৬ জানুয়ারি দেশহিতৈষী দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভায় পত্রিকার সম্পাদক প্রণব চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন সম্পাদক অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ দেশহিতৈষী’র কর্মীবৃন্দ এবং কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের শুভান্যুধায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ আগস্ট হাওড়ার সালকিয়ায়। এরপর তাঁরা ছিলেন উত্তর কলকাতার নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে এবং পরবর্তীকালে পাইকপাড়া অঞ্চলে। ১৯৬৬ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময়েই তৎকালীন খাদ্য আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচিতে ও বিভিন্ন গণআন্দোলনে সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে তিনি কলকাতা জেলার পার্টি নেতা কমরেড অলক মজুমদারের মাধ্যমে দেশহিতৈষী পত্রিকার কাজে যুক্ত হন এবং ওই বছরেই তিনি পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তিনি আমৃত্যু পার্টি সদস্য ছিলেন। তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক। দেশহিতৈষী পত্রিকার প্রয়াত কর্মী কমরেড অমল ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর ছোটো ভাই।
১৯৭১-৭২ সালে তৎকালীন নব কংগ্রেস ও নকশালপন্থীদের যৌথ আক্রমণে তাঁদের গোটা পরিবার পাইকপাড়া থেকে উচ্ছেদ হয়। তারা কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যকে প্রাণে মারারও পরিকল্পনা করেছিল বলে জানা যায়। ওই সময়ে এলাকার পার্টির বিভিন্ন কাজে, বিশেষ করে কমরেডদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্যের মায়ের বড়ো ভূমিকা ছিল।
উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া থেকে উচ্ছেদ হয়ে তাঁদের পরিবার বেহালায় বসবাস শুরু করে। বর্তমানে কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্য বজবজে থাকতেন। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কমরেড শিবপদ ভট্টাচার্য দেশহিতৈষী পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি দেশহিতৈষী পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে পত্রিকার কাজ থেকে অব্যাহতি নেন।