E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ / ১৪ মাঘ, ১৪২৮

চলে গেলেন চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুর


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ চলে গে‍লেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের লড়াইয়ের সা‍‌থি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ও‌য়াসিম কাপুর। ২৪ জানুয়ারি আকস্মিক ব্রেন স্ট্রোক কে‍ড়ে নিল এই অসামান্য শিল্পীর জীবন। অকৃতদার এই শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

জীবনাবসানের পর শিল্পীর মরদেহ রাখা ‍‌ছিল পিস হেভেনে। ২৬ জানুয়ারি আত্মীয়, পরিজন ও অগণিত গুণাগ্রাহীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিকেল ৪.৩০ নাগাদ খিদিরপুরের ষোলআনা ‍কবরস্থানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। এদিন শিল্পীর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে শেষ শ্রদ্ধা জানান বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম এবং বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।

১৯৫১ সালের ৩ জানুয়ারি লক্ষ্ণৌতে জন্ম। বাবা ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও কমিউনিস্ট এসআর কাপুর। সংস্কৃতি মহলে সালেখ লক্ষ্মৌভি নামে যিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। শৈশবে আর পাঁচটা শিশুর মতো জীবন ছিল না ওয়াসিমের। বয়স তখন ছয় মাস। খাট থেকে পড়ে বড়ো চোট পেয়েছিলেন। এরপর শৈশবের বারোটা বছর কাটে বিছানায়, প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায়। প্রতিনিয়ত হাসপাতাল আর বাড়ি করতে হতো। বিছানায় শুয়ে দিন কাটত। জানালা দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে যা কিছু যোগাযোগ। দেখতেন চলমান মানুষ আর যানবাহন। সেই সব দৃশ্য খাতায় ধরে রাখতে ইচ্ছে হতো ওয়াসিমের। বাবার কাছে প্রথম আবদারই ছিল ছবি আঁকার। বাবা তাঁকে ছবি আঁকার উপকরণ এনে দিয়েছিলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ছবি আঁকার সূত্রপাত। ওয়াসিমের ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ দেখে বাবা একজন অঙ্কন শিক্ষককে নিয়ে আসেন। সেখান থেকেই ছবি আঁকার সূত্রপাত।

শৈশবে বিছানাবন্দি হওয়ার যন্ত্রণা কোনোদিন পিছু ছাড়েনি ওয়াসিমের। ওয়াসিমের আঁকা ছবিতে কোথায় যেন বারে বারে ফুটে উঠত সেইসব দৃশ্যাবলি। বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে সে কথা উচ্চারণ করেছেনও - ‘আমি তো একাকীত্ব নিয়ে পথ চলি’। কিন্তু কোনোদিন ভোলেননি শৈশবে অঙ্কন শিক্ষক অমর নন্দনকে। তিনিই ওয়াসিমকে ১৫ বছর বয়সে আর্ট কলেজে ভরতি করে দেন। ক্র্যাচে ভর দিয়ে যেতেন কলেজে। আর্ট কলেজে যাওয়া আসার সময় প্রকৃতপক্ষে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয়।

কলেজের প্রথম বর্ষেই ওয়াসিমের আঁকা ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়। রং তুলিতে ভর করে ডানা মেলে তাঁর স্বপ্নের ভুবন। দেশে বিদেশে তাঁর ছবির বেশ কিছু প্রদর্শনী হয়েছে। সর্বত্রই প্রশংসা আদায় করে নেয় ওয়াসিমের ছবি। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ওয়াসিমের ছবির প্রশংসা করেন শিল্প সমালোচকরা। ভারতের সংসদ ভবন, উর্দু আকাদেমি, ললিতকলা আকাদেমি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ইরানি সোসাইটি, বিড়লা আকাদেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার সর্বত্র ওয়াসিমের ছবি স্থান করে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তাঁর আঁকা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর তৈলচিত্র এখনও রয়েছে। শিল্পী জীবনে পেয়েছেন আকাদেমি অফ ফাইন আর্ট, এশিয়ান পেইন্টস ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার। তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে ভারতের প্রায় সব বড়ো শহরে এবং জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইডেনে।

শিল্পী জীবনে চলার পথে পেয়েছেন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, যামিনী রায়, মকবুল ফিদা হুসেন, পরিতোষ সেনদের মতন প্রথিতযশা শিল্পীদের সাহচর্য। প্রিয় রং ছিল কালো। অন্তর ছিল লাল রঙে রাঙানো। রঙের ক্ষেত্রে যেমন কোনোদিন আপস করেননি, তেমনি বামপন্থার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা কখনো অস্বীকার করেননি। এই সময়কালে অনেক শিল্পী উৎকোচ আর তকমার প্রলোভনে শিবির বদল করেছেন, সেখানে ওয়াসিম ছিলেন ব্যতিক্রম। নির্ভয়ে বলেছেন, আদর্শ বিক্রি করতে পারব না।

তাঁর প্রয়াণে শিল্পী মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের বাসভবনে প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হন অনেকেই। শ্রদ্ধা জানাতে যান সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব সহ ছাত্র-যুব নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র শিল্পী ওয়াসিম কাপুরের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ওয়াসিমের সঙ্গে পরিচয় বাম আন্দোলনে যুক্ত একজন খোলা মনের মানুষ হিসাবে। অবাংলাভাষী এলাকায় কাজের সুবাদে মাঝেমাঝে ওয়াসিমের কাছে যেতে হতো। বিশেষত উর্দুতে স্লোগান, ব্যানারের বয়ান লেখার জন্য। খুব শক্তিশালী ও বিশাল মাপের একজন শিল্পী ছিলেন। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের কাজে খুব উৎসাহ দিতেন। অনেক সময় তিনি তাঁদের নানা সুপরামর্শ দিতেন। শুধু ছবিই নয় অন্য শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর টান ছিল। বামপন্থার প্রতি ছিল গভীর আস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, এনআরসি বিরোধী, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন ইত্যাদি নানা কর্মসূচিতে প্রতিবাদী শিল্পী হিসাবেই তিনি যোগ দিতেন। শিরদাঁড়া টানটান রেখে বামপন্থার প্রতি নিজের অবস্থানকে অটুট রেখেছেন।

পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় এক শোক বার্তায় বলেছেন, তিনি ছিলেন আমাদের সহযাত্রী। সংগঠনের রাজ্য উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। আজীবন মানুষের পাশে থেকেছেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে পথে নেমেছেন এবং তাঁর পথচলায় কোনও ক্লান্তি ছিল না। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ-র রাজ্য সম্পাদক দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় শোক প্রকাশ করে বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের সংগঠনের অকৃত্রিম বন্ধু। জনবাদী লেখক সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক রামআহ্লাদ চৌধুরী বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের সংগঠনের রাজ্য সভাপতি। আমাদের পথ চলার কাজে প্রতিনিয়ত তাঁর পরামর্শ পেয়েছি। সংগঠনের পত্রিকা ‘শোধ-সৃজন’ প্রকাশে তাঁর উদ্যোগ ভোলার নয়।

প্রয়াত শিল্পী ওয়াশিম কাপুরের জীবনাবসানে ‘আওয়াজ’ সংগঠনের পক্ষ থেকেও গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। প্রয়াত শিল্পী ছিলেন এই সংগঠনের রাজ্য কমিটির সভাপতি। সংগঠনের রা‍জ্য সম্পাদক সাইদুল হক এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আওয়াজ’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে চলার পথে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে‌ছেন। পাশে থেকেছেন। তাঁর মৃত্যু ‘আওয়াজ’র কা‍‌ছে অপূরণীয় ক্ষতি। সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা (এআইপিএসও)’র পক্ষ থেকেও শিল্পী ওয়াসিম কাপুরের প্রয়াণে গভীর শোক জানানো হয়েছে। তিনি ছিলেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।