৫৯ বর্ষ ২৪ সংখ্যা / ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ / ১৪ মাঘ, ১৪২৮
স্মৃতিতে ভাস্বর প্রয়াত বন্ধু-শিল্পী নিখিলেশ দাস
রবীন দত্ত
“নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারই ঘর,
তোমাদের স্মরি।
সংসারে জ্বেলে গেলে যে নব আলোক
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক -
তোমাদের স্মরি।”
ষাটের দশকে শিল্পী নিখিলেশ দাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সে ছিল আমার সহপাঠী। তখন আমরা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমি কলেজে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভরতি হই। সেজন্য ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। প্রথম কিছুদিন নিজেকে বহিরাগত বলেই মনে হতো। কিন্তু খুব শিগগিরই বন্ধু নিখিলেশের ভালোবাসায় আর কাছে টেনে নেবার গুণে আমার সেই আগের অবস্থার পরিবর্তন হলো। ক্লাসে ওঁর মাধ্যমেই স্বাভাবিক হলাম, বন্ধুত্ব হলো অনেকের সঙ্গে।
নিখিলেশের সৌম্যকান্তি চেহারা, কথা বলার ভঙ্গি, সবই ছিল আর সবার থেকে একটু আলাদা। যা আমার মতো অনেককেই আকর্ষণ করত,বন্ধুত্ব করে একাত্ম হবার ইচ্ছা জাগত। শুধু নিজের ক্লাসেই নয়, সমস্ত কলেজেই সে ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকী উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা মারতে, আলোচনা করতেও সে ছিল স্বাভাবিক, সাবলীল।
আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষ থেকে আমাদের দু’জনের মধ্যে সামান্য দূরত্ব তৈরি হলো। ও চলে গেল ফাইন আর্টস বিভাগে, আর আমি চলে গেলাম কমার্শিয়াল আর্টের বিভাগে। তবে শুধু এ ঘর আর ও ঘরের দূরত্ব। মনের দূরত্ব একেবারেই নয়। কিন্তু আমি সব সময়েই নিখিলেশের এবং অন্যান্য বন্ধুদের ছবির সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে নিখিলেশের ছবির বিভিন্ন গুণাবলি আমাকে ওঁর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে আরও কাছে টেনে নিয়েছিল, যে কথা আজও অস্বীকার করতে পারিনা।
এভাবেই পাঁচ বছরের কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, রুটি-রুজির সন্ধানে। কিছুদিন বাদে শুনলাম কলকাতার কোনো নামি ইংরেজি স্কুলে চাকুরি হয়েছে নিখিলেশের। তখন মোবাইল ফোন ছিলনা, হোয়াটসঅ্যাপ’র মাধ্যমে ছবি দেখার কথা ভাবাই যেত না। তাই কোনো প্রদর্শনীতে গিয়ে ছবি দেখা ছাড়া উপায় ছিলনা। তবে ওঁর সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। আকাদেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে অথবা কলকাতার অন্য কোনো গ্যালারিতে। ছবি আঁকার বিষয় ছাড়াও কথা হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও চলমান আমাদের জীবনের নানা বিষয়ে। ছাত্রাবস্থা থেকে খুব নিবিড়ভাবে অনুধাবন করেছি ছবি আঁকার বিষয় নির্বাচনে অথবা সমকালীন চিন্তা ও চেতনায় নিখিলেশ ছিল অনেকটাই এগিয়ে, আধুনিক শিল্প জগতের কথা তুলনামূলকভাবে ওঁর আয়ত্তে ছিল অনেকটাই বেশি।
আমাদের পশ্চিমবাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে নিখিলেশ দাস আজ একজন অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ২০১০ সালে ওঁর সঙ্গে শেষ প্রদর্শনী করেছি আকাদেমি অব ফাইন আর্টস-এ। তখন আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে “Pallete 63” নামে একটি শিল্পীদের সংগঠন তৈরি করেছিলাম, সেখানেও নিখিলেশের ভূমিকা ছিল মনে রাখার মতো। পর পর কয়েকটি চিত্র প্রদর্শনী করে শিল্প রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তখনও ওঁর সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা করে ঠিক হয় ভবিষ্যতে আরও প্রদর্শনীর কর্মসূচি নিয়ে, কলকাতার বাইরে গিয়ে ভারতের অন্যান্য শহরে “Pallete 63”-র সদস্যদের ছবির প্রদর্শনী করা যায় কিনা। সে ইচ্ছা নিখিলেশ বারে বারে প্রকাশ করেছে।
বিগত দীর্ঘ কয়েক বছর যাবতই নিখিলেশ ছিল অত্যন্ত পরিচিত “ক্যালকাটা পেইন্টার্স”-এর স্থায়ী গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শিল্পী। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী করে অন্যান্য নামি শিল্পীদের মতো ওঁরও সুনাম হয়েছিল। বিগত বেশ কয়েক বছরে নিখিলেশের ছবিতে বিমূর্ত ভাবধারার প্রতিফলন এবং নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রকাশ আমি লক্ষ করেছি। গ্রুপের প্রদর্শনী ছাড়াও একক চিত্র প্রদর্শনীর সংখ্যাও তাঁর কম ছিলনা।
নিখিলেশের নিজের শহর হাওড়ার ‘শরৎ সদন’-এর সঙ্গে ছিল আত্মিক যোগাযোগ। প্রথম থেকেই সে ছিল প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। এছাড়া স্থানীয় বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁর । শেষদিন পর্যন্ত প্রচুর ছাত্রছাত্রী ওঁর কাছে ছবি আঁকা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সমর্থ হয়েছে। আজ তারা প্রায় সকলেই কর্মরত, এই কাজে প্রতিষ্ঠিত। আমাদেরও এসব শুনতে ভালো লাগে, ওঁর জন্য গর্ববোধ করি। নিজের বাড়িতে, নিজের করা একটি সুন্দর কর্মশালা (স্টুডিয়ো) আছে। নিখিলেশ যার একটি সুন্দর মিষ্টি নামও দিয়েছে “আঁকিবুঁকি”। সেখানেই রেখে গেছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ওঁর সমস্ত শিল্পকর্মকে - ওঁর ভাবনার জগৎকে।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি ওঁর গভীর ভালোবাসা ও যোগাযোগের কথা আমরা প্রায় সবাই জানতাম। সিপিআই(এম)-র একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবেও ছিল সুপরিচিত। পার্টির বিভিন্ন কাজে ওকে শামিল হতে দেখেছি একেবারে সামনের সারিতে থেকে। সিপিআই(এম)’র বিভিন্ন সম্মেলনে মঞ্চসজ্জায় তাঁকে দেখা যেতো উৎসাহী শিল্পীর ভূমিকায়। তাঁর তুলির টানে যেন বিপ্লব মন্দ্রিত হতো। পার্টির জন্য ওঁর শিল্প সৃষ্টির অতি মূল্যবান সময়কে ব্যয় করতে দ্বিধা করেনি, সেটাও আমাদের শিল্পী বন্ধুদের গর্ব ও একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আমাদের প্রিয় সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ’। নিখিলেশ এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিল। এক সময়ে জেলার সভাপতিও হয়েছিল। সংগঠনের প্রতি ওঁর ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা আমাদের আকর্ষিত করেছে, শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে।
আজকে নিখিলেশের চলে যাওয়ায় আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি। নিখিলেশের সৃষ্ট অসংখ্য শিল্প সম্ভার এবং অগণিত ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁর আকাঙ্ক্ষিত আদর্শকে বহমান রাখবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে - এই প্রত্যাশা নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করব।
পরিশেষে বলতে চাই, এ লেখা আমার স্মৃতিচারণা নয়, বন্ধু নিখিলেশের জীবনের সৃষ্টি ও সংগ্রামের কিছু ছবি, হয়ত ওঁরই ক্যানভাসে আঁকা, একটু ফিরে দেখা সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত।