৬০ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৮ জুলাই, ২০২৩ / ১১ শ্রাবণ, ১৪৩০
লুটের পঞ্চায়েত মানুষ মানবে না, মানুষের নিজস্ব পঞ্চায়েত গড়ার আহ্বান মহম্মদ সেলিমের
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণের স্বচ্ছতার প্রশ্নে লড়াই-সংগ্রাম চলবে, তেমনি তার রূপায়ণের গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে পার্টি। একটি বিকল্প পঞ্চায়েতের ভাবনা আমরা রূপায়িত করব। লুটের পঞ্চায়েত মানুষ মানবে না। বিকল্প জীবিকা এবং গ্রাম বাংলার অর্থনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন এই ভাবনার সঙ্গে জড়িত। সামগ্রিকভাবে রাজ্যকে বাঁচানো, রাজ্যের মানুষের ঐক্যকে বাঁচানোর মধ্যে দিয়ে দেশ বাঁচানোর যে লড়াই তাকে এগিয়ে নিতে চাই আমরা। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের লড়াই তৃণমূল এবং বিজেপি দু’দলের সঙ্গেই। ২৬ জুলাই পার্টির রাজ্য কমিটির দু’দিন ব্যাপী বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত রাজ্য কমিটির এই বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে রাজ্যে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার কথা উঠে এসেছে ২৫ও ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত পার্টির রাজ্য কমিটির বৈঠকে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটের সঙ্গে গণনার ভোটের প্রায় চার লক্ষ তফাত। অনেক বাড়তি ব্যালট। সেই হিসেব অনেকে মেলাতে পারছে না। সরকার, নির্বাচন কমিশন, বিডিও, এসডিও-দের বড়ো অংশের অপদার্থতা, কিছু ক্ষেত্রে নির্লজ্জ ভূমিকা, গুন্ডা বদমাইশ মস্তানদের সমস্ত চাপকে উপেক্ষা করে প্রাণ সংশয়, হামলা, বাড়ির লোকেদের অপহরণ সত্ত্বেও বহু মানুষ প্রার্থীপদ টিকিয়ে রেখেছেন এবং ভোটের দিন দীর্ঘ বছর পর বহু মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন মরণপণ সংগ্রাম করে।
আক্রান্ত মানুষের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাঁরা খুন হয়েছেন, তাদের পরিবারের পাশে, যাঁরা আক্রান্ত ও আহত হয়েছেন তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। যারা লড়াই করেছেন তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, তাঁদের কাছে যাওয়া, আদিবাসী, তপশিলি, সংখ্যালঘু গরিব প্রান্তিক মানুষ, দিনমজুর, পরিযায়ী শ্রমিক তাঁদের মধ্যে অনেকে যেমন এখনো আক্রান্ত হচ্ছেন ঘরছাড়া হচ্ছেন তাঁদের পাশে আমরা রয়েছি। সংগঠিতভাবে, খুব সংহতভাবে তাঁদের কাছে গিয়ে আমরা অভিজ্ঞতা বিনিময় করব, তাঁদের কাছে অনেক কিছু শিখব জানব। এর পাশাপাশি জেলা কমিটি, এরিয়া কমিটি সহ নির্বাচনী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের থেকে তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়গুলি জানব, এবং তারপর এই গোটা বিষয়টার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি হবে।
তিনি বলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেভাবে ভোট লুট করা হলো, গণনাকেন্দ্রেও লুট চলল তার একটিই লক্ষ্য, কীভাবে তৃণমূল জিতবে আর বিজেপি’কে দ্বিতীয় করবে। বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া ব্যালট উদ্ধার হচ্ছে। সেখানে বিজেপি’র প্রতীকে ছাপ নেই। তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধীদের পক্ষে ছাপ রয়েছে।
হাইকোর্টে পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত বহু মামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রার্থীপদ জমা দিয়েছেন এবং ভোটে লড়েছেন তাঁদের এত লড়াই সত্ত্বেও ভোটের পর ঝোপেঝাড়ে জঙ্গলে যে গোছা গোছা ব্যালট পেপার পড়েছিল, বিভিন্ন চ্যানেল, সংবাদপত্র এবং সামাজিক মাধ্যমে তার ছবিও দেখা গেছে। সেসব হাইকোর্টে জমা হয়েছে। হাইকোর্টে এই অসঙ্গতি নিয়ে অনেক মোকদ্দমা হয়েছে। আদালতে শুনানি এবং বিডিও-দের জবানবন্দি মারফত সরকারি ভোট কর্মীরা কী যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছেন সেসব জানা যাচ্ছে। তবুও এখনো তৃণমূল সরকারের অপদার্থতায় পঞ্চায়েত ভোটের ফল কী হলো কেউ জানে না। লুটেরাদের এই পঞ্চায়েত মানুষ মেনে নেবেন না।
তিনি বলেন, এইসব দিক নিয়েই প্রাথমিক আলোচনা এবং রিপোর্টিং হয়েছে দু’দিনের বৈঠকে। লিখিত বেশ কিছু রিপোর্ট আগেও জমা পড়েছিল এখনো জমা পড়ছে। এসব তথ্য থেকে সত্য যাতে উঠে আসে তাই আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার কথা বলেছি।
বিভিন্ন প্রকল্পের বেনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গরিব মানুষের জীবন জীবিকা ও তার সংগ্রাম, ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা সহ ২৭টা দপ্তরের যে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও নানা সরকারি প্রকল্প আছে তার রূপায়ণের স্বচ্ছতা এবং যারা প্রাপক তারা কার ঘর কে পেল এই ধরনের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে একদিকে যেমন লড়াই সংগ্রাম চলবে, তেমনি তার রূপায়ণের ব্যাপারে পার্টি গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। লুটেরা এবং মাফিয়ারা যেন ওই সমস্ত নিয়ন্ত্রণ না করে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির হিন্দু-মুসলমান বা আদিবাসী-তপশিলি-রাজবংশী এইভাবে ভাগাভাগি রুখতে বৃহত্তর মানুষের ঐক্যের স্বার্থে, সম্প্রীতির স্বার্থে আমরা শপথ নিয়েছি। রাজ্যের অন্য বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে এই লক্ষ্যে কথা বলা হবে। সহযোগী শক্তিগুলির সঙ্গে কথা বলা হবে। একটি বিকল্প পঞ্চায়েতের ভাবনা আমরা রূপায়িত করব। মানুষের বিকল্প জীবন-জীবিকা এবং গ্রাম বাংলার অর্থনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত। কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পগুলিকে যে ছন্নছাড়া অবস্থা করেছে তৃণমূল-বিজেপি তাকে বাঁচানোর প্রশ্ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্যকে বাঁচানো, রাজ্যের মানুষের ঐক্যকে বাঁচানোর মধ্যদিয়ে যে দেশ বাঁচানোর লড়াই তাকে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।
বিজেপি বিরোধী জোটের প্রশ্নে তিনি বলেন, সংবিধান এবং গণতন্ত্রকে রক্ষার লক্ষ্যে ছাব্বিশটি দল বিজেপি বিরোধিতায় এক জায়গায় বৈঠক করেছে। সেই তালিকায় সিপিআই(এম) এবং বামপন্থী দলগুলি রয়েছে। আবার তৃণমূল কংগ্রেসও রয়েছে। বিরোধী দলগুলি যে প্রস্তাব নিয়েছে সেটি দেখুন। ছত্রে ছত্রে বামপন্থীদের সঙ্গে তৃণমূলের বিরোধ ধরা পড়বে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের লড়াই তৃণমূল এবং বিজেপি দু’দলের সঙ্গেই। কিন্তু দেশের ক্ষেত্রে বিজেপি সরকার যা করছে পশ্চিমবঙ্গে সেই একই আক্রমণ চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস।
লোকসভায় ২৬ জুলাই গৃহীত অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে মহম্মদ সেলিম বলেন, দেশে একের পর এক হিংসায় প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকেন কেন, তার জবাব চাইবেন বিরোধীরা। নীরব মোদিকে এবার সরব হতে হবে, এটাই জয়। সেই সঙ্গে বোঝা যাবে কে কোথায় দাঁড়িয়ে। সিএএ বিল, তিন তালাক বিল, লোকপাল বিল, বিচারপতির ইমপিচমেন্ট - সর্বদা দেখা গিয়েছে তৃণমূলের বেশ কিছু সাংসদ গরহাজির। এবার অনাস্থায় কী ভূমিকা নেয় তৃণমূল, দেখা যাবে।
তৃণমূল-আরএসএস সখ্য প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম এদিন বলেন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপি’র আদর্শগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠান আরএসএস’ - যার লক্ষ্য ভারতের সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফ্যাসিস্ট হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাদের বিরোধিতা কখনও করেনি তৃণমূল। লড়াই এই দুই দলের বিরুদ্ধেই।