৬০ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৮ জুলাই, ২০২৩ / ১১ শ্রাবণ, ১৪৩০
গণতন্ত্র উদ্ধারে এক অসম লড়াইয়ের এপিটোম
জয়দীপ মুখার্জি
এক বেনজির জালিয়াতি, লুট, প্রহসনের দগদগে ক্ষত রেখে সম্পন্ন হলো রাজ্যের দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোটারদের কাছে আরও বেশি বেআব্রু হলো, রাজ্যের ঠুঁটো নির্বাচন কমিশন, মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন ও পুলিশের প্রায় সিংহভাগের জঘন্য পক্ষপাতিত্ব। শাসকদলের চাপের কাছে তাদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। ফলশ্রুতি করপোরেট পুঁজির দালাল, বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, ফ্যাসিস্ত আরএসএস-র আশীর্বাদপুষ্ট তৃণমূল কংগ্রেস দলের আরও পাঁচ বছর গ্রাম সরকারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়ন। শাসকদলের যাবতীয় অপরাধ এবং অনাচারকে আড়াল করতে প্রশাসন ও পুলিশের উচ্চ থেকে নিম্নবর্গের আধিকারিকদের বড়ো অংশের এমন কদর্য উদ্যম নিঃসন্দেহে রাজ্যের ইতিহাসে গণতন্ত্র নিধনের এক কলঙ্কিত এপিটাফ। কিন্তু এটা সত্যের অর্ধেক মাত্র। বাকি অর্ধেক জুড়ে রয়েছে শাসকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্বৃত্ত বাহিনীর বেলাগাম আক্রমণের বিরুদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধ। বোমা, বন্দুক, ধারালো অস্ত্রের আস্ফালনের মুখে গ্রাম বাংলার মানুষের প্রতিস্পর্ধী লড়াই। ভুলুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এক অসম লড়াইয়ের এপিটোম।
যদিও রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩-র চূড়ান্ত ফলাফল এখনও অসমাপ্ত। উচ্চ আদালতের নির্দেশে আপাতত স্থগিত রয়েছে ফলপ্রকাশ। ভোট প্রক্রিয়া, ভোটগণনা নিয়ে নির্বাচন কমিশন, রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ এবং শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিধিভঙ্গ ও অনাচারের ভুরি ভুরি অভিযোগের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালত এই নির্দেশ কার্যকরী রেখেছে। যা কীনা, রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক কলঙ্কিত নিদর্শন। রিগিং, ছাপ্পা, এপিক কার্ড কেড়ে ভোটদানে বাধা, শারীরিক আক্রমণ, ভোটার লাইনে আঙুলে কালি লাগিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া, শাসকদলের প্রার্থীর পক্ষেই একশো শতাংশ ভোট বিরোধী প্রার্থী শূন্য, ভোটারের চেয়ে ছাপ্পা ব্যালটের সংখ্যা বেশি, এরকম ভোট ডাকাতির সব নজির ছাপিয়ে এবারের স্পেশাল ছিল হেরে যাওয়ার পর গণনার টেবিলে জয়ী প্রার্থীর ব্যালট কেড়ে চিবিয়ে খেয়ে পুনর্গণনায় জয় হাসিল। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ব্যালট বাক্স বদল। ভোট শেষের পর ব্যালট বোঝাই বাক্স প্রশাসনের আধিকারিকদের যোগসাজশে মাঝপথে সরিয়ে তার জায়গায় শাসকদলের প্রার্থীর ছাপ্পা বোঝাই বাক্স লকার রুমে পৌঁছানো। পাশাপাশি, হেরে গিয়ে বিরোধী দলের জেতা প্রার্থীদের শংসাপত্র ছিঁড়ে দেওয়া, জোর করে জয়ী শংসাপত্র আদায়, বৈধ ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে বা চুরি করে বাইরে ফেলে দেওয়া, শাসকদলের প্রার্থীদের অবৈধ ব্যালট মান্যতা দেওয়া, শারীরিক আক্রমণ, গণনা কেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া, শ্লীলতাহানি, বিরোধীদলের মহিলা প্রার্থীদের গায়ে মদ ঢেলে দেওয়া, শাসকদলের সাংসদ-বিধায়কদের দিয়ে অন্যায়ভাবে গণনা কেন্দ্রের দখল নেওয়া - এসব তো ছিলই। এখনও ঝোপে-ঝাড়ে, নর্দমায়, খালে, হাট-বাজারের আবর্জনার স্তুপে সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ প্রার্থীদের নামের পাশে ছাপ দেওয়া বৈধ ব্যালট উদ্ধার হয়ে চলেছে।
।। দুই ।।
রাজ্যের দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটের বলি এপর্যন্ত ৫৫। এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বলা সম্ভব নয়। কোথাও রিগিং, ছাপ্পার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শাসকদলের ঘাতক বাহিনীর আক্রমণে শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। কোথাও আবার শাসকদলের অন্তর্কলহে প্রাণ হারিয়েছেন প্রান্তিক মানুষ। রক্তাক্ত, জখম হাজার হাজার সিপিআই(এম) কর্মী ও সমর্থক। ভোটের আগে, ভোটের দিন এবং পরেও বোমা, গুলি, কাটারি, বল্লমের আঘাতে মরণাপন্ন হয়ে হাসপাতালে সংকটজনক অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই এর দায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য সরকারকে নিতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা মোকদ্দমায় শেষ পর্যন্ত হেরে অযথা বিলম্ব ঘটিয়ে প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন না করে তারা এই বিপদ তৈরি করেছেন।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় থেকেই এবার পুলিশ এবং প্রশাসনের একটা বড়ো অংশ এই ভোট কারচুপিতে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দলের নেতা, কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। পুলিশের উর্দি গায়ে চড়িয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম), সহযোগী কংগ্রেস, আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, থানায় ডেকে হুমকি, মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় আড়ালে থেকে শাসকদলের ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনীকে মদত, গণনা কেন্দ্রের ভিতর থেকে বিরোধী দলের প্রার্থী-এজেন্টদের বের করে দেওয়া, এরকম একের পর এক বেআইনি কাজ করেছে। গণনা কেন্দ্রের ভিতরে রিটার্নিং অফিসার, সহকারি রিটার্নিং অফিসারদের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে বিরোধী দলের জয়ী প্রার্থীদের ফল উলটে শাসকদলের প্রার্থীদের হাতে শংসাপত্র তুলে দিয়েছে। এমনকী, সংবাদ মাধ্যমের কাছে অনেক প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নির্ভীকভাবে এই সমস্ত জালিয়াতির কথা তুলে ধরেছেন। সংবাদ মাধ্যমের বাইরে পথে ঘাটে তো প্রায় সবাই বলছেন। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ এমন প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড পার্টির সংগ্রহে আছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন ঘোষণা থেকে গণনা পর্যন্ত বিশেষ করে ভোটের দিন জেলার শীর্ষ থেকে ব্লক স্তর পর্যন্ত নানা মাপের সরকারি আধিকারিক, জেলা পুলিশের বড়োবাবু থেকে দারোগা, কনস্টেবল সমস্ত পদাধিকারী কে কোথায় কী ভুমিকা পালন করলেন তারও সবিস্তার মূল্যায়ণ করে তালিকা প্রস্তুতি চলছে। মনে রাখা ভালো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী তো কিছু নয়।
গত বারো বছরে রাজ্যে চুরি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেছে। সরকারি প্রকল্পের টাকা, সরকারি সম্পদ, রেগার টাকা, সরকারি জমি, পরিকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দের টাকা, লুট সর্বত্র। সরকারের হিসেব খাতায় এই অনাচার, লুটকে ম্যানেজ করতে পদস্থ আমলা থেকে নিচুতলার কর্মীদের একটা বড়ো র্যা কেট সেয়ানে সেয়ানে কাজ করে চলেছেন। এতে ছিটে-ফোঁটা তাদেরও প্রাপ্তিযোগ। পুলিশ বাহিনীর বড়ো অংশ তো আবার শাসকদলের সমস্ত অপকর্মের জলজ্যান্ত সাক্ষী। নেতা-নেত্রীদের হয়ে হাত ময়লার কাজগুলি তারাই করতে বাধ্য হন। বিনিময়ে তাদের জন্য মাসোহারা, কমিশনের বন্দোবস্ত। সরকার চোখ বুজে থাকে। পারস্পরিক লেনদেন দীর্ঘ মেয়াদি রাখতে এবারের ভোটে পুলিশ, প্রশাসনের এই অংশই তৃণমূল কংগ্রেসকে সমস্ত কারচুপি ও জালিয়াতিতে খুল্লম-খুল্লা সহায়তা দিয়েছে। এদের হাতেই দু’দিনে মাত্র ৮ঘণ্টা সময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ৭৬ হাজার ৪৮৯টি মনোনয়ন পত্র জমা পড়ে যায়। অর্থাৎ, প্রতি সেকেন্ডে ৩টি করে।
দুর্নীতি, স্বজনপোষণের আখড়ায় পরিণত গোটা রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। তৃণমূলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এলাকার মাতব্বর। সরকারি সম্পদ লুটের টাকায় বাড়ি, গাড়ি হাঁকিয়ে তাদের আঙুল ফুলে কলা গাছ। পুরনো দিনের জমিদার, জোতদারদের বৃহৎ অংশ যাঁরা চালকল, তেলকলের মালিক, বড়ো দোকান ব্যবসায়ী, আড়তদার, হিমঘরের মালিক, জমি ব্যবসায়ী, দালাল, মহাজন, সুদের কারবারি, ঠিকেদার - গ্রামবাংলার এই নব্য ধনিক শ্রেণিই হয়ে উঠেছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। এদের মুনাফার স্বার্থে সমস্ত অনৈতিক কাজকে পুলিশ, প্রশাসনের থেকে আড়াল করাই সর্বত্র শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্যদের মুখ্য কাজ। প্রতিদানে এরাই তৃণমূল কংগ্রেসের মিত্রশক্তি। মানুষ কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতায় এসব প্রত্যক্ষ করছেন।
।। তিন ।।
কয়েক মাসের ব্যবধানে রাজ্যের দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে ভাঁটা পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে আসা যাক, বালিগঞ্জ বিধানসভা আসন উপনির্বাচনের প্রসঙ্গে। ২০২১-এর ভোটে ওই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের পরিমাণ ছিল ৭০.৬০ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি’র ভোট ২০.৬৮ শতাংশ এবং তৃতীয় সিপিআই(এম) ৫.৬১ শতাংশ। কোনো সন্দেহ নেই মুখ্যমন্ত্রীর মিত্রবাহিনীর ‘নো ভোট টু...’ স্লোগান শহুরে ভোটারদের মধ্যে বিশেষত সংখ্যালঘু অংশের মেরুকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর ওই কেন্দ্রেই ২০২২-এর উপনির্বাচনে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর ভোট কমে হলো, ৪৯.৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি দলের ভোট কমলো, ২০.৯১ শতাংশ। ৩০.০৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলেন সিপিআই(এম) প্রার্থী। সিপিআই(এম)-এর ভোট বাড়লো ২৪.৪৫ শতাংশ। তৃতীয় স্থান বিজেপি’র, প্রাপ্ত ভোট ১২.৮৩ শতাংশ, কমলো ৭.৮৫ শতাংশ। এবারে আসা যাক, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে। ২০২১-এর নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস ৫০.৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি (২৪.০৮ শতাংশ), তৃতীয় কংগ্রেস ১৯.৪৫ শতাংশ ভোট। সেবার বামফ্রন্ট এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল। ২০২৩ -এর উপনির্বাচনেও কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল বামফ্রন্ট। ফলাফল, বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ৪৭.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আসনটিতে জয়ী হলেন। কংগ্রেসের ভোট বাড়লো ২৭.৯০ শতাংশ। দ্বিতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (৩৪.৯৪ শতাংশ) ভোট কমলো, ১৬.০১ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়ে বিজেপি’র (১৩.৯৪ শতাংশ) ভোট কমল, ১০.১৪ শতাংশ। বিধানসভা নির্বাচনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রাজ্যে বামফ্রন্ট ও সহযোগী কংগ্রেসের এই প্রত্যাবর্তন এবং তথাকথিত দ্বিতীয় শক্তি বিজেপি’র পতন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। আম জনতার চর্চায় করপোরেট মিডিয়ার তৈরি করা মেকি দ্বিদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারণা ফিকে হতে শুরু করলো।
স্বভাবতই দুটি উপনির্বাচনের একটিতে ২০ শতাংশের ওপর ভোট ক্ষয় এবং অপরটিতে হারের পর তৃণমূল দলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি বেশ ভালোই বুঝেছিলেন পঞ্চায়েত নির্বাচন তাঁর শিয়রে সমন। এরাজ্যে বিজেপি’ই তাঁর অক্সিজেন। কেননা, বিজেপি’র হিন্দুত্বের পালটা তাঁর হিজাবি ভড়ং। বিজেপি’র পতন মানে তাঁরও সর্বনাশের শুরু। বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান মানে আরএসএস-বিজেপি’র করপোরেট-হিন্দুত্ব সন্ধি বিপদগ্রস্ত। তাই বেপরোয়া সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্র খাটিয়ে পঞ্চায়েত দখল। এগরার খাদিকুল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বাজি কারখানার আড়ালে প্রাণঘাতী বোমা তৈরির কারখানা। ভয়ংকর বিস্ফোরণে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেলেন ৬ জন মহিলাসহ ৯ টি মানুষ। শুধু তো খাদিকুল নয়, গোটা রাজ্যে জেলায় জেলায় অসংখ্য বোমা কারখানার হদিশ মিললো একের পর এক বিস্ফোরণের জেরে। মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে পর পর বিস্ফোরণে মৃত্যু ২১ জনের। সবই প্রায় পুলিশের নাকের ডগায়, থানার একশো থেকে পাঁচশো মিটারের দূরত্বে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মালিকরা এলাকার তৃণমূল দলের কেউকেটা। সেইসব জায়গায় যে পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের শায়েস্তা করার প্রস্তুতি চলছিল তা নিহতদের পরিজনদের বয়ানেই স্পষ্ট। রেগার কাজ বন্ধ, ঝুঁকি থাকলেও বোমা বাঁধার কাজে টাকা একটু বেশি পাওয়া যায়, সামনে ভোট, প্রচুর চাহিদা, তাই ঘরের মা-বোনেরাও একাজে গেছেন দু’টো টাকার জন্য। প্রশাসন, পুলিশ বেশির ভাগ জায়গাতেই ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ। উলটে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ বলে লঘু করার চেষ্টা হয়েছে।
জনতা কিন্তু শুরু থেকেই পাহারায় ছিলেন। বাধা, বিপত্তি, পুলিশের লাঠি, ব্যারিকেড সরিয়ে সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের নেতৃত্বে কৃষিজীবী-খেতমজুর-দিনমজুর প্রান্তিক মানুষ ব্লক থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত অবস্থান, জমায়েত, সমাবেশে শামিল হয়েছেন। জমির পাট্টা, ন্যায্য মজুরি, ফসলের দাম, সেচের বিদ্যুৎ, রেগার কাজ, একশো দিনের বকেয়া মজুরি, পানীয় জল, মিড-ডে মিলের দাবিতে ব্লক অফিসে ডেপুটেশন, মহকুমা অফিস প্রাঙ্গণে জমায়েত, জেলা সদরে পুলিশের দমন পীড়ন প্রতিরোধ করে বিক্ষোভ, সমাবেশের মধ্য দিয়ে তাঁরা সাহস সঞ্চয় করেছেন। তারই ফলশ্রুতি এবারের পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশের একটা বড়ো অংশের মিলিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিস্পর্ধী লড়াই। মনোনয়ন দাখিল, প্রত্যাহার, প্রচার পর্ব, ভোট দান ভোট গণনা, ফল ঘোষণা প্রতি স্তরে পুলিশ এবং প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে বিরোধী প্রার্থীদের বেপরোয়া আক্রমণ করে গেছে রাজ্যের শাসকদল। তা সত্ত্বেও মানুষ রাস্তা ছাড়েননি। উলটে বোমা, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করতে আসা শাসকদলের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন। ধৃতরা কবুল করেছে দু’টো টাকার লোভে তারা শাসকদলের হয়ে ভাড়া খাটতে ওই কাজ করেছে। বুথের মধ্যে ভোট ডাকাতি করতে যাওয়া দুষ্কৃতীরা বমাল ধরা পড়ে গেছে। ভোটের আগে গ্রামবাসীদের রাত পাহারায় ধরা পড়ে গেছে বাড়ি বাড়ি শাসাতে আসা বাইক বাহিনী। কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী কারও দেখা মেলেনি।
।। চার ।।
ভোটের প্রথম রাউন্ডের চ্যালেঞ্জ ছিল মনোনয়ন দাখিল। ২০১৮-এর নির্বাচনে এই জায়গাটিতে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল বামফ্রন্ট প্রার্থীদের। শাসকদলের প্রবল বাধা ও গা’জোয়ারির মুখে সেবার গ্রামপঞ্চায়েত স্তরে ৩৬.৮০ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বামফ্রন্ট। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলাপরিষদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়েছিল যথাক্রমে ৪৮.২৮ শতাংশ ও ৬৮ শতাংশ আসনে। পৃথকভাবে লড়ে তিনটি স্তরে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যথাক্রমে ১২.১৭ শতাংশ, ১৫.১২ শতাংশ এবং ৪২.৭৯ শতাংশ আসনে। এবারের নির্বাচনে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদল বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাম, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভোট যাতে বিভক্ত না হয় সেটাই ছিল পার্টির নির্বাচনী কৌশল। সেই বোঝাপড়া থেকেই তিনটি স্তরে সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রার্থী দিয়েছিল বামফ্রন্ট এবং সহযোগী কংগ্রেস, আইএসএফ-এর সংযুক্ত মোর্চা। মনোনয়ন দাখিল পর্বে তিনটি স্তরে মোট ৭৩,৮৮৭ টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ এবং সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ছিলেন ৭০,৭৫০ জন। অর্থাৎ, তিনটি স্তর মিলিয়ে মনোনয়ন দাখিল হয়েছিল ৯৫.৭৫ শতাংশ আসনে। শাসকদলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এটা ছিল প্রথম সাফল্য। এরপর প্রত্যাহার পর্বে পুলিশ, প্রশাসনের নানা প্রকৌশল এবং বাড়ির শিশু, মা- বোনেদের ওপর শাসকদলের গুন্ডাবাহিনীর মধ্যযুগীয় আক্রমণের মুখেও বুকটান করে তিনটি স্তরে ৮৫.১১ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রইলেন বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ মনোনীত প্রার্থীরা। ভোট পর্ব এবং গণনা এই দু’পর্বে শাসকদল, প্রশাসন, পুলিশের সম্মিলিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুঝতে হয়েছে পার্টির অগণিত কর্মী, সমর্থক, দরদিকে। এই অসম লড়াইয়ে পথে নেমে বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষও। এটাও নিঃসন্দেহে একটা বড়ো সাফল্য।
এবারের নির্বাচনে এ’পর্যন্ত পাওয়া অঙ্কের হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের পরিমাণ ৫১.০১ শতাংশ। ২০১৮-র তুলনায় যা কীনা, ২০.৯৯ শতাংশ কম। বিজেপি পেয়েছে ২৩.০৬ শতাংশ ভোট। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায় সেটা বেশি হলেও ২০২১ -র বিধানসভায় প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ১৪.৯১ শতাংশ কম। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ-এর সংযুক্ত মোর্চার ভোট ২২.৩০ শতাংশ। যার মধ্যে বামফ্রন্টের প্রাপ্তি ১৪ শতাংশ। গত পঞ্চায়েত এবং বিধানসভা ভোটের তুলনায় বামফ্রন্টের ভোট বৃদ্ধি ৮ শতাংশের কিছু বেশি। বিধানসভার তুলনায় ভোট বৃদ্ধি হয়েছে সংযুক্ত মোর্চারও, প্রায় ১২.৩ শতাংশ। অঙ্কের হিসেবে বামফ্রন্ট তথা সংযুক্ত মোর্চার ভোটের পরিমাণ যাই হোক না কেন, জনসমর্থনের উত্থান পতনের ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই ইঙ্গিতই আগামীদিনে পথ চলার দিশা দেয়। ভোট শান্তিপূর্ণ হলে বা নিরপেক্ষ পরিবেশে হলে ফলাফল কী হতে পারতো তা নিয়ে আক্ষেপ করার সময় এটা নয়। করপোরেট পুঁজি তার ক্লেদাক্ত চেহারা নিয়ে যখন ধান্দার ধনতন্ত্রে মুনাফার পাহাড় গড়তে চায় তখন তাদের দালাল শাসককুল ও পুলিশ, প্রশাসনের এমন দুষ্টচক্র এবং বিষময় আঁতাত হওয়াটাই দস্তুর। তাই আগামীদিনের লড়াই এই মুহুর্ত থেকেই শুরু করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থেকে লুটেরাদের তাড়িয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করে যাঁরা ত্রিস্তরে জিতেছেন এই লড়াই শুধু তাঁদের নিয়েই নয়। জনগণের পঞ্চায়েত গড়ার লক্ষ্য নিয়ে যে বিপুল অংশের মানুষ জীবন সংশয় করে রাস্তায় নেমেছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, তাঁদেরও সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে পথ।