৬০ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৮ জুলাই, ২০২৩ / ১১ শ্রাবণ, ১৪৩০
চিত্রাঙ্গদার রাজ্য আজ আগ্নেয়গিরিঃ দায় কার?
কনীনিকা ঘোষ
কথা শুরুর কথাঃ
আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্র নন্দিনী। চিত্রাঙ্গদা মণিপুর রাজের কন্যা, রাজা তাকে অস্ত্রশস্ত্রে দীক্ষিত করে, শিক্ষিত করে মানুষ করেছেন এভাবে, যাতে সে রাজ্যের ভার নিতে সক্ষম। অর্জুন তার বীরত্বে মুগ্ধ। চিত্রাঙ্গদার কণ্ঠে রবি কবির লেখনী স্বাধীনচেতা নারীর কণ্ঠস্বরঃ
“যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।“
এইতো মণিপুর, ক্ষমতার কেন্দ্রে অন্যতম, নারীরা। কঠোর পরিশ্রম, জীবন সংগ্রাম, সংসার নির্বাহ প্রথা অনুযায়ী মূলত প্রধান মেয়েরা। ভারতীয় সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের বিয়ে হয়, এখানে মেয়েরা বিয়ে করে। বীরত্ব সংগ্রাম সাহসে নারীরা অন্যতম অগ্রণী। সেই মণিপুরই প্রায় দু’মাস ধরে সংবাদের শিরোনামে। তবে লুকোছাপা করে গোদি মিডিয়া, তার প্রভুদের দায়-এর কীর্তি কাহিনি যতটা সম্ভব বাইরে না আনতে চেষ্টা করেছে, আর তার ফাঁক দিয়ে ভারতীয় মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে প্রায় ২০০ গ্রাম। মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের জাতিদাঙ্গায় প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে মণিপুরের মাটি। গত ১৯ জুলাই, মণিপুর লুক্কায়িত সব কিছুকে ছাপিয়ে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির নতুন করে অগ্নুৎপাতের মতো সামনে চলে এলো। যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’জন মহিলাকে নগ্ন করে প্যারেড করানো ও তারপর দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের ভিডিয়ো ভাইরাল হলো। আদিমতম, বর্বরতম এ ঘটনায় জগৎ শিউরে উঠেছে, তীব্র ঘৃণা, প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে মণিপুরের রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকার তথা ডাবল ইঞ্জিন বিজেপি সরকারের ওপর। ৭৭ দিন ধরে জাতিদাঙ্গার পরও নীরব নরেন্দ্র মোদি মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন আদালতের চাপে ও এই ঘটনা সামনে আসায়, কিন্তু সাথে সাথেই এই রাজ্যের সঙ্গে আরও দুই একটি বিরোধী শাসিত রাজ্যের কথা বলে পরিস্থিতি গুলিয়ে দিতে চেয়েছেন, যা কখনোই এক নয়।
মণিপুর - বৈচিত্র্য যার ভূষণ
ভারতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মতোই মণিপুরের বৈচিত্র্যও অপরিসীম এবং সৌন্দর্যময়, একদিকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল শ্যামল উপত্যকা ইম্ফল, চারপাশে সবুজ বনানী ও কালো রঙের পাহাড়। মণিপুরের মাত্র দশ শতাংশ ভূভাগ নিয়ে ইম্ফল, কিন্তু কোনো দেহের সমস্ত রক্ত মুখে থাকলে যেমন তাকে সুস্থ বলা যায় না, ঠিক তেমনি আধুনিক হাসপাতাল, পর্যটন, হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয়, শপিংমল এক কথায় জীবনের জন্য, আরামের জন্য, এমনকী বিলাসিতার জন্যও যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছুই এই উপত্যকায়; আর এখানেই বাস করে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ, তাই সুযোগ সুবিধার দিক থেকে অসম মণিপুর বরাবরই। দূর পাহাড়ের গায়ে ওই পর্বতরাজির কোল, যার মোট আয়তন মণিপুরের ভূ-ভাগের ৯০ শতাংশ যেখানে বাস করে কুকি সম্প্রদায়, যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ, নাগা সম্প্রদায়, যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ, এরা উপজাতি বা জনজাতি। বাকি জনগোষ্ঠী হলো অত্যন্ত অল্প, মুসলিম সম্প্রদায়। কুকি যারা সাধারণত খ্রিস্টান ও সংখ্যাগুরু মেইতেই যারা সাধারণভাবে হিন্দু। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই চলছে জাতিগত দাঙ্গা, যা উত্তর পূর্বের এই পার্বত্য রাজ্যকে করে তুলেছে চঞ্চল, অশান্ত, রক্তাক্ত, পরিণত করেছেন মৃত্যু উপত্যকায়।
সংঘর্ষ-দাঙ্গা
সমস্ত সম্পদ এবং সুবিধা ভোগ করা মেইতেইরাই ছিল স্বাধীনতার আগে থেকে মণিপুরের শাসক। রাজাও ছিল মেইতেই সম্প্রদায়েরই। আজ যতটুকু জায়গা উপজাতিদের আছে তাও দখল করার অভিপ্রায়ে, পার্বত্য অঞ্চল অধিকার করার বাসনায়, তারা উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত হতে চেয়ে একটি আবেদন জমা দেয় মণিপুর হাইকোর্টে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই আবেদন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর কাছের লোকজনের থেকেই জমা পড়ে, তারপর হাইকোর্টের একক বেঞ্চ এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, এই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখা হোক এ কথা বলে, আর তাতেই আগুনে ঘি পড়ে এবং মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। আজ কোনো একটি বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হলেও জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে তিক্ততা বহুকাল থেকে। মেইতেইরা আরও বেশি চায়, নাগারা ‘নাগালিম’ তাদের নিজস্ব রাজ্য গঠন করতে চায়, আর কুকিরা জানে পার্বত্য অঞ্চলটুকুও দখল হয়ে গেলে তাদের আর কিছুই থাকবে না। বাড়ি ঘর দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়েছে। মণিপুরে মেইতেই, কুকি বা নাগা সকলেরই আছে গেরিলা সংগঠন, আর সরকার বারে বারে থেকেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের দখলে। তাই কুকি গেরিলাদের সঙ্গে সরকারের সংঘর্ষ ছিল রোজকার ঘটনা। ২০০৮ সালে সরকার ও কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ বিরোধী চুক্তি সম্পাদিত হলে জঙ্গি কার্যকলাপ এবং সরকারি দমন পীড়ন খানিক বন্ধ হয়।
বিভাজনের রাজনীতি
প্রথম থেকেই রাজ্য সরকারের মেইতেইদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের মনোভাব বিজেপি-আরএসএস’র চিরাচরিত নীতির পথেই হয়েছে। সংখ্যালঘিষ্ঠ কুকিদের আগে থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ‘বহিরাগত’ বা ‘মায়ানমারের অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পাহাড় জঙ্গলের বসতি উচ্ছেদ করতে নিদান দিয়েছেন, অথচ করেননি কোনো বিকল্প পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। একের পর এক গ্রাম যখন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে তখন সেই আর্ত মানুষগুলোর জন্য কোনো সহানুভূতি জোটেনি, জুটেছিল সন্ত্রাসবাদী তকমা। তাই দাঙ্গার পটভূমি প্রস্তুত ছিলই। ‘দেশকো গদ্দারকো গোলি মারো শালো কো’ বলার মতো বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা বা আরএসএস কল্পকাহিনি পরিবেশন করেছে কুকিদের সম্বন্ধে। তাদের বলেছে ড্রাগ মাফিয়া। এইসবের মধ্যে দিয়েই বিভাজনের রাজনীতিকে মদত দিয়েছে বিজেপি। বিভিন্ন জায়গায় যে বুলডোজার সংস্কৃতি চালানো হচ্ছে তারই প্রয়োগ করে খ্রিস্টান সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়কে উৎখাত করতে চায় তারা। প্রথমেই যখন দাঙ্গা লাগে তখনই লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র সহ নানা অস্ত্র, আর তা হয় সরকারি জায়গা থেকে। মেইতেই সম্প্রদায়ের জঙ্গিগোষ্ঠী মূলত এই লুট করেছে। কেন সরকার এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারল না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, প্রশ্ন উঠছে কীভাবে সরকার ও উগ্রপন্থী দু’পক্ষের লড়াইয়ের পর ১২ জন জঙ্গিকে আটক করলেও কেমন করে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ছিনতাই করতে সক্ষম হলেন প্রায় ১২০০ মহিলা, এরা সকলেই মেইরা পাইবি সংগঠনের সদস্য। সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তখন উগ্রপন্থীদের ছেড়ে না দিলে বড়ো ধরনের অঘটন ঘটে যেত, তাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, এরা সকলেই রাজ্যের নিষিদ্ধ মেইতেই উগ্রপন্থী সংগঠন (KYKl) কেওয়াইকেআই-এর সদস্য। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালের ৪ জুন মণিপুরের ডোগরা রেজিমেন্টের উপরে উগ্রপন্থীরা হামলা চালালে সেদিন ১৮ জন সেনা খুন হন, তারই নেতা মাইরাংথেম তাম্বা ওরফে উত্তম এই ১২ জন উগ্রপন্থীদের মধ্যে ছিল। গত আট বছর ধরে উত্তমকে খুঁজছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। এই অপরাধ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধের অভিযোগ আছে, তা সত্ত্বেও তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সেনাবাহিনী। আশ্চর্য নয়! হ্যাঁ এর পিছনে গভীর রহস্য আছে বলেই বিভিন্ন মহল মনে করছে। সাম্প্রতিক অতীতে উগ্রপন্থীদের আটক করে ছেড়ে দেওয়ার কোনো রেকর্ড ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেই। তবে মণিপুরে মেইতেই উগ্রপন্থীদের ক্ষেত্রে কেন এমন হলো? প্রশ্ন উঠছে, উঠবেই। মণিপুরে হিংসার জন্য প্রথম থেকেই কুকি সম্প্রদায় ও কুকি উগ্রপন্থীদের দায়ী করছে বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিন সরকার, কিন্তু বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষকে হত্যা, লুটের নানান ঘটনায় মেইতেই উগ্রপন্থীরা জড়িত থাকার ভিডিয়ো, ছবি প্রকাশ্যে আসলেও তাদের সম্বন্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি তারা। স্বভাবতই মেইতেই উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রতি রাজ্য সরকার নরম মনোভাব নিচ্ছে বলে একাধিক উগ্রপন্থী সংগঠন দাবি করেছে। এমনকী মেইতেই উগ্রপন্থী সংগঠন আরামবাগ টেঙল ও মেইতেই লিপুম নামের দুটি সংগঠনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেছে। আসলে উগ্র জাত্যভিমান, সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের প্রতিভূ বিজেপি’র রাজনীতি এটাই। মণিপুর তাই আজও শান্ত হচ্ছে না।
আনতে হবে শান্তি, হঠাতেই হবে এ বিভাজনের শক্তিকে
ইরাবত সিং-এর মণিপুর, যে ইরাবত চেয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ মণিপুর, যিনি রাজার প্রিয় হলেও, রাজার নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে কসুর করেননি, বলেছিলেন সকলে সমান। যিনি ছিলেন কবি, ছিলেন সমাজ সংস্কারক, ছিলেন সলিল চৌধুরী, বলরাজ সাহনিদের বন্ধু। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, তাঁদের জনপ্রিয় গানগুলি তিনি মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সিপিআই-এর হয়ে, রাজ আজ্ঞা নয়, সকলের ভোটই ঠিক করবে মণিপুরের ভবিষ্যৎ বলে মনে করতেন ইরাবত, সেই ইরাবতের মণিপুর, সাধারণ মানুষের মণিপুর, যোদ্ধা চূড়াচাঁদ সিং-দের মণিপুর, সামাজিক আন্দোলনের কর্মী শর্মিলা চানু, বা বক্সিং বিজয়ী মেরি কমের মণিপুর তো এ দাঙ্গা চায় না। তাই রাজা আর অসাধু ব্যবসায়ীদের চাল রপ্তানির আঁতাতের বিরুদ্ধে, নুপিলান বিদ্রোহে যে নারীরা শহিদ হন, যারা অসীম সাহসের সাথে সংগ্রাম করেন, তাদের স্বপ্ন তো এ মণিপুর ছিল না, তাই নারীদের চরম অপমানের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে নুপিলান বিদ্রোহীদের শহিদের স্বপ্নের মণিপুর, প্রাকৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছোট্ট এ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যকে করতে হবে দাঙ্গা মুক্ত, প্রতিষ্ঠা করতেই হবে শান্তি, তার জন্যই প্রয়োজন এ বিভাজনের শক্তিকে - বিজেপি, আরএসএস-কে হঠানো। তবেই চিত্রাঙ্গদার রাজ্য, ইরাবতের রাজ্য, নুপিলান বিদ্রোহীদের শহিদের রাজ্য মিলবে মানুষ সম্প্রীতির মোহনায়, প্রতিষ্ঠা হবে শান্তি।