E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৮ জুলাই, ২০২৩ / ১১ শ্রাবণ, ১৪৩০

মোদি-শাহর কুম্ভীরাশ্রু

দীপক দাশগুপ্ত


ভারতের ২৬টি বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রথমে পাটনায়, দ্বিতীয়বার বেঙ্গালুরুতে সভা করে দেশ থেকে মোদি-শাহ জমানা অগস্ত্যযাত্রায় পাঠানোর জন্য “ইন্ডিয়া” নামক মঞ্চ বানিয়েছে। মোদির বিগত ৯ বছর শাসনকালে মোদি-শাহ চক্র দেশকে অন্ধকারের গর্ভে নিক্ষেপ করেছে। মোদি-শাহ-র শাসন হলো ফ্যাসিস্ট শাসন। এরকম পরিস্থিতিতে দেশের ২৬টি বিরোধী রাজনৈতিক দল দেশ রক্ষায়, দেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো,যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রক্ষার প্রশ্নটি জরুরি মনে করে গড়ে তুলেছেন এক মঞ্চ। এঘটনায় মোদি-শাহ চক্র ভয় পেয়েছে, আতঙ্কিত হয়ে তারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। আতঙ্কের কারণে তারা নানা কথা, নানা গল্প ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ময়দানে নেমে পড়েছে।

বিরোধী দলগুলির বেঙ্গালুরুর সভার খবর শুনেই বিজেপি তার মৃতপ্রায় এনডিএ-র পুনরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য দিল্লিতে সভা করেছে এবং মোদি ও তাঁর একান্ত সহচর অমিত শাহ গোয়েবলসিও কায়দায় অসত্য ও কুৎসিত প্রচার চালাতে শুরু করেছে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে।

মোদি-শাহ চক্রের একান্ত বিশ্বাসযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (যিনি প্রাক্তন তৃণমূল নেতা) বাম-কংগ্রেস কর্মীদের নিজ নিজ দল পরিত্যাগ করে নতুন দল গঠন করা বা সকলকেই আরএসএস-বিজেপি-তে যোগদান করার আহবান জনিয়েছেন। আরও উল্লেখ করা যায়, মোদি-শাহ, অধিকারী, দিলীপ ঘোষ থেকে আরএসএস-বিজেপি’র বড়ো, মাঝারি, ছোটো সকলেই কুমিরের কান্না জুড়ে বলছেন সিপিআই(এম) টিএমসি-র সঙ্গে একই মঞ্চে থাকার জন্য ভীষণ ক্ষতি হলো। এই বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। ভাবখানা এমন যেন এই মঞ্চে সিপিআই(এম) যোগ দিয়ে টিএমসি বিরোধিতা থেকে সরে আসবে। সম্প্রতি এরাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মস্তানি, ভোটলুঠ, ব্যাপক ছাপ্পা, ব্যালট বক্স লুঠ করা সহ সারা রাজ্যে ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মোদি-শাহরা এমনভাবে প্রচার করছে যেন সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস এরাজ্যে শাসক দলের সঙ্গে আতাত করে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী সংগ্রাম পরিত্যাগ করেছে। যেহেতু “ইন্ডিয়া” নামক মঞ্চে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে এই দলও যুক্ত রয়েছে। মোদি-শাহ চক্র বাম-কংগ্রেসের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে চলেছে যেন বাম-কংগ্রেস নেতৃত্বের এই মঞ্চে থাকা একটা বড়ো অপরাধ।

এ প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সম্প্রতি গণশক্তি পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, “তৃণমূল কংগ্রেস আছে বলে আমরা বিজেপি'র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মঞ্চে যাব না, এরকম কথা পার্টি কংগ্রেস বলেনি। পার্টির রাজনৈতিক লাইন তা নয়। তৃণমূলকে হারাতে হবে বাংলায়। যেখানেই তৃণমূলের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, সেখানেই তাদের পরাস্ত করতে হবে। কিন্তু গোটা দেশেই বিজেপি-কে হারাতে হবে। কেন্দ্রের সরকার থেকে বিজেপি-কে সরাতে হবে। ব্যতিক্রম একমাত্র কেরালায়, সেই রাজ্যে কংগ্রেসকেও আমাদের হারাতে হবে।’’ সীতারাম ইয়েচুরি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রাজ্যে রাজ্যে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্বাচনী কৌশল নির্ধারিত হবে। তবে বিজেপি-কে পরাস্ত করাটাই প্রধান কর্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতে এই ঘটনা নতুন নয়। ২০০৪ সালে বামপন্থীরা লোকসভায় ৬১ আসন জিতেছিল। তারমধ্যে ৫৭টিতে আমরা কংগ্রেসকে পরাস্ত করেছিলাম। কিন্তু তারপর জাতীয় স্বার্থে আমরা ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করেছিলাম। আমরা সমর্থন না করলে ইউপিএ সরকার হতো না,মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হতেন না। এর মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। রাজ্যস্তরে রাজ্যের প্রশ্ন মীমাংসিত হবে। দেশের প্রশ্ন জাতীয় স্তরে মীমাংসা করতে হবে।’’

বিরোধীরা সকলে মোদি-শাহ সরকারকে পরাস্ত করার প্রশ্নে এক জায়গায় দাড়িয়েছে বলে মোদি-শাহরা ভয় পেয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে উলটো পালটা বলতে শুরু করেছে। তাই মোদি-শাহর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার গেল গেল রব তুলেছে যেন বামপন্থীরা আদর্শচ্যূত হয়ে গেল! কারণ তৃণমূল “ইন্ডিয়া” মঞ্চে থাকা সত্ত্বেও সিপিআই(এম) সেখানে রয়েছে। বিজেপি নেতাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র নীতি সুস্পষ্ট এবং এই নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে সীতারাম ইয়েচুরি এবং পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। তাঁরা দু'জনেই বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাদের লড়াই হবে তৃণমূল কংগ্রেস-বিজেপিকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই হবে।

বিজেপি-তৃণমূল সম্পর্কে

সিপিআই(এম)'র বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র মোহ নেই। পার্টির বিগত ২৩তম কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বিজেপি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘বিজেপি ভারতের শাসক শ্রেণিগুলির প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে উঠে এসেছে। আরএসএস’র ক্রমবর্ধমান সাংগঠনিক কাঠামোকে ব্যবহার করেই বিজেপি সারা দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। দেশের বুকে কর্তৃত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে বিজেপি। রাজনৈতিক প্রস্তাবে আরও লেখা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে করপোরেট-হিন্দুত্ব আতাতকে আরও দৃঢ় করতে নয়া উদারবাদী সংস্কারের কাজে বিজেপি আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধঃস্তন হিসাবে দুই দেশের কুটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে তারা। ক্রমবর্ধমান স্বৈরতন্ত্রী রাজনীতির সাহায্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আঘাত করা জারি রয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে দ্রুতগতিতে আরও তীব্রতর করা হচ্ছে।

একইভাবে তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, “বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে ছিল টিএমসি। এখন তারা বিজেপি বিরোধিতায় সরব। প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, টিএমসি আমাদের রাজ্যে বিজেপি-কে ডেকে এনেছিল। মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, বিজেপি অচ্ছুৎ নয়। এখনও টিএমসি'র সর্বময়ী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি আরএসএস'র প্রেমে ডগমগ হয়ে রয়েছেন, তাই তিনি বলেছেন যে, আরএসএস একটি দেশপ্রেমিক দল। আরএসএস-ও মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে বলেছে, “তিনি হলেন সাক্ষাৎ মা দুর্গা”। এই হলো পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া।

মমতা ব্যানার্জি নিজেকে গান্ধীবাদী বলে মনে করেন। আর তিনি গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ও তার পার্টি আরএসএস-কে দেশপ্রেমিকের সংশাপত্র দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, বরং ওদের দলের দ্বিতীয় গুরু গোলওয়ালকর বলেছিলেন, তারা ব্রিটিশ বিরোধী কোনও সংগ্রাম করতে রাজি নয়। ওদের আর এক নেতা হিন্দু মহাসভার প্রধান সাভারকর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রে একই কথা বলেছিলেন। সাভারকরের আরও কুকীর্তির কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে, তিনি জেল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে ৫বার চিঠি দিয়েছিলেন। সেই আরএসএস-কে মমতা ব্যানার্জি দেশপ্রেমিকের শংসাপত্র (Certificate) দিয়েছেন।

তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, জন্মলগ্ন থেকেই অর্থাৎ ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে টিএমসি সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। রাজ্যের শিল্পায়ন করার কাজ - যেমন সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা ও নন্দীগ্রামে পেট্রোরসায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ সন্ত্রাস করে বন্ধ করে দিয়েছিল। পরিণামে টিএমসি রাজত্বে কোনো শিল্প কারখানা এরাজ্যে আসেনি। ফলে রাজ্যে বেকার বৃদ্ধি সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

এই তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে আমাদের পার্টির ২৩তম কংগ্রেসে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ভয়ানক দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে আমাদের পার্টি। এই দমন-পীড়ন চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, যাদের অবলম্বন সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি। এইসব আক্রমণের প্রতিরোধও করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২১-র মধ্যে আমরা হারিয়েছি ২০৯জন কমরেডকে। এই সময়কালে ১,০২,০০০-এরও বেশি কমরেড ও সমর্থকদের ঘরছাড়া হতে হয়েছে। ১,৩০,০০০ এরও বেশি সদস্য সমর্থককে মিথ্যা মামলায় হেনস্থা ও ভয় দেখানো হয়েছে। এবারের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে নজীরবিহীন সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই হামলা-সন্ত্রাসের পরিণতিতে প্রায় ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গোটা নির্বাচন পর্ব জুড়ে তৃণমূল গুন্ডামি, সন্ত্রাস, ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দেবার পাশাপাশি গণনা কেন্দ্র দখল করে পেশিশক্তির জোরে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করেছে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের দ্বারা পরিচালিত পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন। ঠিক এই কারণেই রাজ্যের জনগণের কাছে টিএমসি অন্যতম প্রধান শত্রু। রাজ্যের ক্ষেত্রে বাস্তবতা অনুযায়ী বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করে দেশ ও রাজ্যকে বাঁচানোই রাজ্যের জনগণের একমাত্র কর্তব্য।

মিডিয়ার বাইনারি

করপোরেট মিডিয়া এরাজ্যে কমিউনিস্ট ও বামশক্তিকে আড়ালে রেখে তৃণমূলের দ্বারা সংগঠিত প্রচার ও আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। করপোরেট মিডিয়া তৃণমূল এবং বিজেপি’র ভাষ্য প্রচার করে থাকে। সম্প্রতি রাজ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিজেপি-তৃণমূল বাইনারিকে তুলে ধরেছে কর্পোরেট মিডিয়া।

এই সম্পর্কেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

আমাদের করণীয়

আমাদের সকলকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিজেপি এবং আরএসএস হিটলার-মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী আদর্শ বহন করে চলেছে। আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়। ঠিক সেই কারণে আরএসএস-এর সঙ্ঘচালক (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) তাঁদের তথাকথিত হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা কার্যকর করতে অত্যন্ত তৎপর হয়ে নেমে পড়েছেন। প্রসঙ্গত, এরা এই দুষ্কর্ম চালাতে গিয়ে করপোরেটের সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির এক আঁতাত গড়ে তুলেছে। তাই আমাদের প্রধান কাজ দেশকে রক্ষার জন্যে বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন করা এবং পরাস্ত করা এবং পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপিকে পরাস্ত করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই গড়ে উঠেছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মঞ্চ “ইন্ডিয়া”।