E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৮ জুলাই, ২০২৩ / ১১ শ্রাবণ, ১৪৩০

“ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে”

সুশোভন


হাইলি সাসপিসিয়াস

আচ্ছা, বিগত কয়েকদিন সিপিআই(এম)-র যে মিডিয়া ট্রায়াল হলো তার কারণ কি? তৃণমূলের সঙ্গে কোথাও নির্বাচনী জোট করার কথা বলেছে কি সিপিআই(এম)? বাংলায় লড়াইটা তৃণমূল এবং বিজেপি'র বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষে ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে - এর বাইরে কিছু বলেছে কি সিপিআই(এম)? বিজেপি বিরোধী ঐক্যে থাকা বামপন্থীদের বহু দিনের ঐতিহ্য, এমনকী বহুবার এই ঐক্যের ভরকেন্দ্রে ছিল সিপিআই(এম) - একথা কি অস্বীকার করা যায়? এবারের ঐক্যের প্রথম দিকে তৃণমূল বরং নানান অছিলায় ঐক্যের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে - একথা কি মিথ্যে? এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হলো, না! তবুও সিপিআই(এম)-রই মিডিয়া ট্রায়াল হলো! আরও ভালোভাবে বললে, নর্থ ব্লক কিংবা নবান্ন, যে মিডিয়ার মালিকদের টিকি যেখানে বাঁধা, সেখান থেকে করানো হলো!

অথচ এই বাংলার মিডিয়াই খবর পেল না যে মণিপুরের বিজেপি সরকারকে ২০১৭-তে সমর্থন করেছিল তৃণমূল। অবশ্য তার থেকেও হট টপিক পঞ্চায়েত নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বাংলার পথে ঘাটে ব্যালট উদ্ধার। আর কুড়িয়ে পাওয়া সব ব্যালটেই সিপিআই(এম)-র ভোট। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এমনকী শুভেন্দু-সুকান্ত; কেউ কোথাও দাবি করেনি কিংবা আদালতেও জানায়নি যে বিজেপি'র ভোট পড়া ব্যালট উদ্ধার হয়েছে। অথচ ভোট লুঠ আর গণনার কারচুপি তো দিনের আলোর মত স্পষ্ট। বিরোধী ভোটও প্রায় ঘাড়ে গদ্দানে। তাহলে কি রাজ্য নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর মিক্সড ট্যাকটিসে ভোট লুঠ আর গণনার কারচুপিটা সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধেই পরিকল্পিত ছিল? তৃণমূল-বিজেপি'র বাইনারি ধরে রাখার জন্য নাগপুরের আর কালীঘাটের সিক্রেট গেম ছিল?

২০২১-র পরবর্তী সময়ে বাংলাতে বাইনারি ভাঙছে। বামেদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেটা আরও একবার জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমন বাইনারি ছাড়া তৃণমূল-বিজেপি-করপোরেট-মিডিয়ার নেক্সাস বাঁচবে না। তাই কি মিডিয়ার সিলেক্টিভ নীরবতা? তাই কি দিদিমণির 'ইন্ডিয়া'তে সেন্টার স্টেজ দখলের চেষ্টা? তাই কি সিপিআই(এম)-র নামে কুৎসা? আসলে তৃণমূল এবং বিজেপি'র সম্পর্কটা জন্মলগ্ন থেকেই হাইলি সাসপিসিয়াস!

গিভ অ্যান্ড টেক

আধুনিক যুগে বাংলার রাজনীতি তৃণমূল এবং বিজেপি'র সম্পর্ক বোঝাতে আকর্ষণীয় রেটরিক হলো, দুটো দলের গো-ডাউন এক, শো-রুম আলাদা। ছোটোদের কুইজ প্রতিযোগিতায় আজকাল সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন, মুকুল রায় এখন কোন দলে? তৃণমূল না বিজেপি? সঠিক উত্তরটা মুকুল রায়ও জানেন না! শুভেন্দু অধিকারী, যিনি আগের পঞ্চায়েত ভোটেও ভাইপোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোট লুঠ করেছে, ক্যামেরার সামনে ঘুষ খেয়েছে, মাওবাদীদের অস্ত্র সাপ্লাই করে সিপিআই(এম) সদস্য-কর্মীদের খুনে মদত দিয়েছে, সে আজকাল বিজেপি-তে গিয়ে এমন সাধু সাজেন যে মানুষ ভাবছেন এনার বোধহয় অ্যালঝাইমার্স হয়েছে!

এমনিতে পার্লামেন্টের বাইরে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে টুইট করে, ভাষণ দেয়, ধরনায় বসে। আর পার্লামেন্টে ঢুকলেই চুপচাপ বড়ো ফুলে ছাপ দেয়। একটা নয়, দুটো নয়, এই উদাহরণ ধারাবাহিক। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, কৃষি ও বিদ্যুৎ বিল, নয়া শিক্ষানীতি, শ্রম কোড, বনভূমি অধিকার, পরিবেশ সংক্রান্ত বিল - এই রকম গুরুত্বপূর্ণ বিলের ক্ষেত্রে তৃণমূল সংসদের ভেতরে হয় বিজেপি-কে সমর্থন জানিয়েছে না হলে নিরপেক্ষ থেকে বিল পাশ করাতে সুবিধা করে দিয়েছে। আরএসএস-র ল্যাবরেটরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্ট, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে ভোটাভুটির সময় লোকসভাতে তৃণমূলের ৮জন, রাজ্যসভাতে ১জন সাংসদ অনুপস্থিত ছিলেন। অবশ্য নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে নীতিগত সমর্থনও রয়েছে তৃণমূলের। কারণ ২০০৩-এ নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী এনে প্রথম যখন ‘১৪এ’ ধারা সংযুক্ত করে এনপিআর এবং এনআরসি-কে বৈধতা দিয়েছিল বাজপেয়ী সরকার, সেই সরকারের মন্ত্রীসভায় দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

সমর্থন যে বিক্ষিপ্ত নয় তার প্রমাণ হলো, আসামের এনআরসি কর্তৃপক্ষ যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ১ লক্ষ ১১ হাজার আবেদনকারীর তথ্য ও প্রামাণ্য কাগজপত্র চেয়েছিল, তখন নামমাত্র ৭ হাজার জনের রিপোর্ট পাঠিয়ে অসংখ্য বাঙালিকে ডিটেনশন সেন্টারের ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য দায়ী আসলে তৃণমূল। ২০১৬-র পার্লামেন্টের জয়েন্ট সিলেক্ট কমিটিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনার সময় তৃণমূলের তিনজন সদস্যের নীরব সম্মতি জানানোর জন্য দায়ী আসলে তৃণমূল। একাধিক পৌরসভায় এনপিআর-এর কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়ার জন্য দায়ী আসলে তৃণমূল।

একদিকে, নারদা-সারদাতে ইডি-সিবিআই-র গদাইলশকরি চাল, আদালত রক্ষাকবচ না দিলেও ভাইপোকে জেরা করে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের গতি বৃদ্ধিতে গড়িমসি, অন্যদিকে মেরুকরণের রাজনীতিকে তীব্র করা, বামফ্রন্টের সময়ে ঠিক যে কারণে বাংলার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি বিজেপি, সেই ব্যারিকেডগুলোকে ভেঙে ফেলা, সঙ্ঘের রেকর্ড সংখ্যক শাখার বৃদ্ধিতে মদত দেওয়া, আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রশাসনের হিরণ্ময় নীরবতা - আধুনিক যুগে তৃণমূল-বিজেপি'র সম্পর্কটা মিথোজীবীতার। সম্পর্কটা গিভ অ্যান্ড টেকের!

ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে

শুধু আধুনিক যুগে নয়, তৃণমূল-বিজেপি'র সম্পর্কের বীজ প্রস্তর যুগেই! ১৯৯২, ধর্মীয় মেরুকরণের চ্যাংড়ামিতে জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছে বিজেপি। ‘লৌহ পুরুষ’ রথে চেপে, বাড়ি বয়ে বলে আসছেন ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’। অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা। সেদিন ‘অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ কংগ্রেসের’ সাধারণ সম্পাদিকা মমতা বলেছিলেন, ‘‘সব সিপিআই(এম)-র ষড়যন্ত্র।” ৯৭’র ডিসেম্বরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত মমতাই বললেন, “বিজেপি অচ্ছুৎ নয়”। বাস্তবেই ছুৎমার্গ শিকেয় তুলে ৯৮'র লোকসভায় তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বিজেপি। আর ৯৯-এ এনডিএ-র শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন রেলমন্ত্রী!

সেদিন বিবিসি-র সাক্ষাৎকারে মমতা বলেছিলেন, বিজেপি নাকি তৃণমূলের “ন্যাচারাল অ্যালি”। আজকাল ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ানো মমতা গুজরাট দাঙ্গার সময়েও ছিলেন বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী! তৃণমূল সাংসদ কৃষ্ণা বসু তাঁর ‘অ্যান আউটসাইডার টু দি পলিটিক্স’ বইয়ে লিখেছেন, লোকসভায় যেদিন গুজরাটে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে ভোটাভুটি হচ্ছে সেদিন মমতা এনডিএ সরকারকে ভোট দেবার হুইপ জারি করেছিলেন। ভুল যে কিছু লেখেননি সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল ২০০৩-এ। দিল্লিতে ‘পাঞ্চজন্য’র অনুষ্ঠানে মমতা সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনাদের ১ শতাংশ সাহায্যে আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারব।’’ গদগদ আরএসএস নেতারা মমতাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘‘হামারি পেয়ারি মমতাদি সাক্ষাৎ দুর্গা’’। সেই আরএসএস-র দুর্গার উদ্যোগেই ২০০৪’র লোকসভা এবং ২০০৬’র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল লড়লো বিজেপি’র সাথে জোট করেই!

সাইকো-অ্যানালিস্ট গিরিন্দ্রশেখর বসুকে একদিন তাঁরই এক রুগী বললেন, “স্যার, গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনি নর্দমায় পড়ে গেছেন; আর আমি আপনাকে অনেক কষ্টে ওঠাতে চেষ্টা করছি।” গিরিন্দ্রশেখর মুচকি হেসে বলেন, “আমি অত্যন্ত আনন্দিত আপনার সাহায্য পেয়ে। কিন্তু নর্দমায় আমাকে ফেলেছিল কে?’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ আপনি বাংলার মানুষকে বিজেপি’র বিপদ বোঝানোর নাটক করছেন? আগে বলুন তো এই বিপদ বাংলায় ডেকে এনেছে কে? ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে বলে জন্মলগ্ন থেকে বিজেপি'র গলায় ঝুলেছে কে?

ওপেনহাইমার

আমেরিকার ম্যানহাটন প্রোজেক্টে পরমাণু বোমা তৈরির ফর্মুলা সোভিয়েতকে লিক করল কে? এই সন্দেহে আমেরিকার তদন্ত এজেন্সির চরম নির্যাতনের শিকার হন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। পরে অবশ্য আরও এক বিজ্ঞানী, ক্লউস ফুক্‌স নিজেই জানিয়েছিলেন সোভিয়েতকে ফর্মুলা দিয়েছিলেন তিনিই। বাস্তবে ওপেনহাইমার ও ফুক্‌স দু’জন বিজ্ঞানীর আদর্শগত মিল ছিল। দু’জনেই ছিলেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধী এবং কমিউনিস্ট দরদি। ঠিক যেমন তৃণমূল এবং বিজেপি'র আদর্শগত মিল আছে - করপোরেটের দালালি আর কমিউনিস্ট বিরোধিতা।

বিজেপি’র আদানি প্রেম তো হিন্ডেনবার্গ কাণ্ডে প্রমাণিত। কিন্তু তৃণমূল আর আদানির সম্পর্ক? রাজ্যে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ আপাতত দুই। হলদিয়া, তাজপুর। এছাড়া কয়েক লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করে দেউচা পাঁচামী লুটের ব্লু-প্রিন্ট রেডিই। তাজপুরে ১১২৬ একর জমি, ৯৯ বছরের জন্য রাজ্য সরকার আদানিকে দিয়েছে জাস্ট ১ টাকা লিজে। দিতে হয়নি স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন চার্জ। তুলে দেওয়া হয়েছে মাল ওঠা নামার ঊর্ধ্বসীমা। লঘু হয়েছে সরকারি নজরদারি। নেই কর্মসংস্থানের গ্যারেন্টি ক্লজও। আর তৃণমূলের ইলেক্টোরাল বন্ড মারফত এবছর আয় বেড়েছে ৫২৮ কোটি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কোনো অঙ্গরাজ্যের রাজনৈতিক দলের পার্টি ফান্ডে এতো করপোরেট ডোনেশনের নজির আছে নাকি? বিজেপি'র মদত ছাড়া আদানি-আম্বানিরা ব্যবসায় ইনভেস্ট করে নাকি? ঘাসে মুখ দিয়ে না চললে তো হিসেব মেলাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

৬২ সাংসদ নিয়ে অপ্রতিরোধ্য বামেদের সেদিন বোতলবন্দি করা কাদের প্রয়োজন ছিল আমরা জানি। তারই ক্যাসকেডিং এফেক্টে, ২০১১-র বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় কোনও সিম্পল লিনিয়ার ইকুয়েশন ছিল না! মমতার ব্যক্তিগত ক্যারিশমাও ছিল না। জামাত থেকে সঙ্ঘ পরিবার, বিজেপি সহ দেশের বামবিরোধী সমস্ত শক্তির রামধনু জোটের মুখ হিসেবে প্রোজেক্টেড হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ফিনান্স ক্যাপিটালের ব্লু-আইড কন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এটাই বাস্তবতা! এটাই ইতিহাস!

একদিন মার্ক টোয়েন সকালবেলা শার্ট পরতে গিয়ে দেখলেন শার্টে বোতাম নেই। একটার পর একটা, তিনটে শার্ট বার করে পরতে গিয়ে দেখেন সব সার্টেই একটা করে বোতাম নেই। রাগে অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে মার্ক টোয়েন যখন চতুর্থ শার্টটা বের করছেন, তখন তাঁর রুচিশীল স্ত্রী সব শুনে, স্বামীকে অপ্রস্তুত করার জন্যেই প্রত্যেকটি গালিগালাজ স্পষ্ট করে আবার উচ্চারণ করলেন। মার্ক টোয়েন সেটা শুনে বলেছিলেন, “তোমার শব্দগুলো সব ঠিকই আছে, কিন্তু ইমোশনটা মিসিং।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আজ আপনি বিজেপি-সংঘ’র বিরোধিতা করছেন বটে। কিন্তু ওই যে, ইমোশনটাই মিসিং!