৫৮ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৮ মে, ২০২১ / ১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
রাজ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত তিন জেলা সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল
সুবর্ণরেখা নদীর জলে তটভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবে বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। ২৬ মে এই তিন জেলার উপকূলবর্তী এলাকা বাঁধভাঙা জলে, প্রবল জলোচ্ছ্বাসে এবং ঝড়ের দাপটে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিন পূর্ণিমার ভরা কোটালের জলোচ্ছ্বাস ও ইয়াসের ধাক্কায় রূপনারায়ণ ও ভাগীরথীর অসংখ্য বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাওড়ার বিস্তৃত গ্রামীণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রূপনারায়ণের জলস্ফীতির ফলে জোয়ারের জলের উল্টো স্রোতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের বিভিন্ন এলাকাও প্লাবিত হয়েছে।এছাড়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জেরে টর্নেডো ঝড়ে ২৫ মে হুগলির ব্যান্ডেল ও উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহরে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইয়াস চলে যাবার পর আবার উত্তর ২৪ পরগনার গুমা-অশোকনগর, নদীয়ার শান্তিপুর ও বীরভূমের মুরারইয়ে আকস্মিক টর্নেডোর ধাক্কায় প্রচুর ঘরবাড়ি, ফসল ও পানের বরোজের ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে ইয়াসের প্রভাব কলকাতায় তেমন না পড়লেও গভীর নিম্নচাপের জেরে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। এছাড়া ভরা কোটালের জেরে আদিগঙ্গার জলে কালীঘাট অঞ্চলে হাঁটু সমান জল দাঁড়িয়ে যায়। তবে কলকাতায় সামান্য কয়েকটি বাড়ি আংশিকভাবে ভেঙে যাওয়া ও কয়েকটি জায়গায় রাস্তার উপর গাছ উপড়ে পড়া এবং মহেশতলা ও কলকাতা সংলগ্ন পাড়ে অল্প-বিস্তর ভাঙন ছাড়া বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দাপটের সঙ্গে পূর্ণিমার ভরা কোটালে বাঁধ ভেঙে সুন্দরবনের বিস্তৃত এলাকা প্লাবিত হয়। বেশিরভাগ জায়গায় বাঁধ উপচে জলের স্রোত প্রবাহিত হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম ভেসে গেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলের কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, মথুরাপুর, গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। নোনাজলে ব্যাপক এলাকার কৃষিজমি ও পুকুর প্লাবিত হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের প্রায় ৪০ কিলোমিটার নদী বাঁধ ভেঙেছে, জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ২৯ লক্ষ মানুষ।
এদিন ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দাপট আয়েলা, বুলবুল, আমফানের মতো ডাঙায় তেমন ক্ষতি করতে না পারলেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন এলাকায় ভরা কোটালে সমুদ্র ও নদীতে প্রবল জলস্ফীতির জন্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সুন্দরবনবাসীকে। বকখালির সমুদ্র সৈকতের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ে প্লাবিত হয়েছে। জলমগ্ন ফ্রেজারগঞ্জের প্রায় ৩ হাজার মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গঙ্গাসাগরে কপিল মুনির মন্দির প্রাঙ্গণ প্রায় বুক সমান জলে প্লাবিত হয়। গঙ্গাসাগরের মহিষমারীতে নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিভিন্ন গ্রাম। নামখানার হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর জল উপচে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। মৌশুনি দ্বীপে তীব্র ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে স্থানীয় মানুষ নিজেরাই বাঁধ মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নামখানা, রায়দিঘি সহ জলমগ্ন বিভিন্ন এলাকায় সিপিআই(এম) কর্মীরা দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান। এদিন রায়দিঘির কুমড়োপাড়ায় বাঁধ রক্ষা করতে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে উদ্যোগী হন সিপিআই(এম) নেতা কান্তি গাঙ্গুলি সহ পার্টি কর্মীরা। কিন্তু শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। নদীর বাঁধ উপচে জলমগ্ন হয় কুমড়োপাড়া এলাকা। এদিনের জলপ্লাবনের ফলে বহু মাটির বাড়ি জলমগ্ন হয়। আশঙ্কা জল নামতেই অনেক মাটির বাড়ি ভেঙে পড়বে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দাপটে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ফসল ও পানের বরোজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে আমফানের আঘাতের পর বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি সামলে যে সম্বলটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও এবারে খুইয়েছেন দুর্গতদের অনেকেই।
ভাঙাচোরা গেরস্থালি... ভাঙা বাঁধের উপরই কোনোরকমে সংসার ধামাখালির মানুষদের।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পাশাপাশি পূর্ণিমার ভরা কোটালে প্লাবিত হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা। আমফানের তাণ্ডবের পর একবছর সময় অতিবাহিত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল কংক্রিটের বাঁধ ও ম্যানগ্রোভ দিয়ে ঘিরে দেবেন গোটা সুন্দরবনকে। কিন্তু প্রতিশ্রুতিই সার, বাঁধে আলগা মাটি ধুয়ে মুছে ভেসে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ইছামতি, বিদ্যাধরী, রায়মঙ্গল ডাসা, বেতনি,কালিন্দী, ছোটো কলাগাছি প্রভৃতি নদীর জলস্ফীতিতে জলমগ্ন হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, টাকি প্রভৃতি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমফানের সময়েও অসংখ্য বাঁধ ভেঙেছিল, নোনাজল ঢুকেছিল চাষের জমিতে। এবারেও ব্যাপক এলাকাজুড়ে চাষের জমি তলিয়ে গেছে। গতবছর আমফানের পর বাঁধ সংস্কারে সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেবার ফলে এবারেও অগণিত মানুষকে দুর্ভোগের কেবলে পড়তে হলো। এসব নিয়ে দুর্গত মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই।
ইয়াসের তাণ্ডবের সাথে ভারী বৃষ্টি ও পূর্ণিমার ভরা কোটালের জেরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূল তীরবর্তী ব্লকগুলির ব্যাপক অঞ্চলে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে প্লাবিত হয়। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। এই জেলাতেও গতবার আমফানের তাণ্ডবে ভেঙে যাওয়া নদী বাঁধগুলি মেরামত না করার ফলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়। সমুদ্র সৈকত দীঘায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখানে ‘বিশ্ববাংলা’ ডুবে গেছে। দীঘা, মন্দারমণি, তাজপুর, চাঁদপুর সহ গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে। ভেঙেছে উপকূল অঞ্চলের হাজার হাজার মাটির বাড়ি, ঝুপড়ি। ভেসে গেছে গোরু, ছাগল প্রভৃতি গবাদি পশু। কাঁথি-১ ব্লকের শৌলা গ্রামের মানুষ সরকারি আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেন পাকা রাস্তার উপর। নিউ দীঘা, ওল্ড দীঘার প্রায় সব হোটেলের একতলায় জল ঢোকে। মন্দারমণি, তাজপুরের কিছু হোটেল পুরোপুরি জলমগ্ন হয়। মন্দারমণির কালিন্দী গ্রামের একজন জলের তোড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। খেঁজুরি, রামনগর ১ও২, কাঁথি-১ ব্লকগুলো তীব্র জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে। এই সমস্ত এলাকার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়। হাজার হাজার মাছের ভেড়ি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ভেসে গেছে সবজি বাগান,পানের বরোজ। জল প্লাবিত হয়েছে নয়াচর থেকে নন্দীগ্রামের ভেকুটিয়া, সোনাচূড়া, কেন্দেমারি প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চল। নন্দীগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গত মানুষেরা পঞ্চায়েত, সরকার, প্রশাসনের দেখা না পেলেও তাঁদের পাশে দাঁড়ান মীনাক্ষী মুখার্জি, মহাদেব ভূঁইয়াদের সাথে রেড ভলান্টিয়াররা। জেলার অন্যান্য জায়গাতেও অসহায় মানুষদের সাধ্যমতো সাহায্যে এগিয়ে আসেন সিপিআই(এম) কর্মীরা।
২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আছড়ে পড়ে ওডিশার ধামরা বন্দরের উত্তরে এবং বালেশ্বরের দক্ষিণে অবস্থিত উপকূলে। আবহাওয়া দপ্তরের অনুমিত সময়ের কিছুটা আগেই সকাল ৯টা নাগাদ ল্যান্ডফলের পর প্রায় চার ঘণ্টা ধরে এই ঝড়ের তাণ্ডব চলে। এই ঝড় আছড়ে পড়ার সময়ে এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে ছিল প্রবল বৃষ্টি। এই ঝড়ের তাণ্ডবে বালেশ্বর, ভদ্রক, জগৎসিংপুর এবং ময়ূরভঞ্জ জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ওডিশায় আছড়ে পড়ায় কিছুটা স্বস্তি মিললেও পশ্চিমবঙ্গে এর তাণ্ডব নেহাত কম হয়নি এদিন ঝড়, বৃষ্টি ও কোটাল- এই ত্রিফলা আক্রমণের জেরে ভয়ঙ্কর প্লাবন হয়েছে। ৫ থেকে ১০ ফিট জলস্ফীতি হয়েছে। আবার কোথাও হয়েছে এর চেয়ে বেশি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১৫ লক্ষ মানুষকে সরানো হয়েছে। ১৪ হাজার ত্রাণ শিবিরে তাদের রাখা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাঁধ ভেঙেছে ১৩৪টি। মুখ্যমন্ত্রীর এই পরিসংখ্যান নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সুন্দরবন ও পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকায় সরকারি ফ্লাড শেল্টার ও নিকটবর্তী স্কুল বাড়িতে ১৫ লক্ষ মানুষ রাখার মতো পরিকাঠামোই নেই। এদিকে কেন্দ্রের কাছ থেকে বেশি অর্থ চাইতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি করে দেখিয়েছেন কিনা সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। আবার আমফানের সময়ে দেখা গেছে কীভাবে শাসক দলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বররা ত্রাণ সামগ্রী ও বিপন্ন মানুষের সাহায্যের টাকা আত্মসাৎ করেছিল। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী ১৫ লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অর্থাৎ মাথাপিছু মাত্র ৬৬ টাকা! এই টাকা পানীয় জল, শৌচালয়, ত্রিপল এবং অন্যান্য পরিকাঠামো গড়তেই খরচ হয়ে যাবে। খাবারের সংস্থান হবে কী করে তা নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে।
এদিকে ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আলাদাভাবে আকাশপথে ইয়াস-বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন। কলাইকুণ্ডায় মমতা ব্যানার্জী প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজ্যের তরফে ২০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সাহায্যের দাবি জানান। কেন্দ্র প্রাথমিকভাবে ওডিশা, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১০০০ কোটি টাকা ররাদ্দ করেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই তৎপরতায় দুর্গত মানুষেরা কতটুকু সাহায্য পান এখন সেটাই দেখার।