৫৮ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৮ মে, ২০২১ / ১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
লাক্ষাদ্বীপে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রশাসনিক প্রচেষ্টাকে রুখে দেবার আহ্বান জানালো সারা ভারত কৃষকসভা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আরব সাগরের তীরের শান্ত স্নিগ্ধ পর্যটন কেন্দ্র লাক্ষাদ্বীপ এই মুহূর্তে প্রশাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে লাক্ষাদ্বীপে। উন্নয়ন ও পরিকাঠামো নির্মাণের নামে চেষ্টা হচ্ছে এই কেন্দ্রশাসিত দ্বীপপুঞ্জের ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নষ্ট করে আরএসএস’র সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি বাস্তবায়নের। গুজরাটের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজেপি নেতা প্রফুল কোডা প্যাটেল-কে প্রশাসকের পদে বসিয়ে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষকে কর্মচ্যুত করে শুরু হয়েছে কর্পোরেটদের হাতে দ্বীপসমূহের সম্পদ তুলে দেবার অপচেষ্টা। সঙ্ঘের নির্দেশ পালনের জন্য একাধিক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষ এবং তাঁদের দীর্ঘ লালিত ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার পথে পা বাড়িয়েছেন প্রশাসক।
সিপিআই(এম), কংগ্রেস, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসকের বিভিন্ন জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপতিকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে।
এক টুইট বার্তায় সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি অবিলম্বে এই প্রশাসককে অপসারিত করা এবং তিনি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা সব বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে দাবি করেছেন, অবিলম্বে ওই প্রশাসকের নেওয়া সমস্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। লাক্ষাদ্বীপের বিজেপি নেতা এবং কর্মীরাও ব্যাপক সংখ্যায় দল ছাড়ছেন প্রশাসকের ভূমিকার প্রতিবাদে।
এক প্রেস বিবৃতিতে এই অপচেষ্টাসমূহের বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিবাদের ডাক দেবার পাশাপাশি লাক্ষাদ্বীপের মানুষের আন্দোলনের পাশে থাকার আহ্বান এবং প্রশাসককে বরখাস্ত করার দাবি জানানো হয়েছে সারা ভারত কৃষকসভার (এআইকেএস) পক্ষ থেকে।
সাধারণভাবে এতকাল লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক পদে বসতেন কেন্দ্রের যুগ্মসচিব পর্যায়ের আধিকারিকরা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ক্যাবিনেট আলো করে থাকা গুজরাটের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রফুল প্যাটেল ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর থেকেই দ্বীপপুঞ্জে শুরু হয়েছে অশান্তি। কুখ্যাত সোহরাবুদ্দিন মামলায় যখন জেলে গেছিলেন অমিত শাহ, তখন নরেন্দ্র মোদীর গুজরাট মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলে ছিলেন পারিবারিকভাবেই আরএসএস’র সঙ্গে থাকা সবরকন্থ জেলার বিধায়ক এই প্রফুল প্যাটেল (২০০৭-২০১২)।
ওই টুইট বার্তায় সীতারাম ইয়েচুরি আরও বলেছেন, কেন্দ্র নিয়োজিত লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসকের সিদ্ধান্তগুলি নির্লজ্জভাবে আমাদের সংবিধানকে অমান্য করছে এবং প্রতিটি নাগরিকের যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে তাকে অমান্য করা হচ্ছে। অবিলম্বে এই প্রশাসককে অপসারিত করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি যত নির্দেশ দিয়েছেন সব বাতিল করতে হবে।
লাক্ষাদ্বীপের মানুষের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এই আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ প্রশাসককে বরখাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেও একই দাবি জানিয়েছেন একাধিক সাংসদ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপের লোকসংখ্যা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম। এখানে দশটি দ্বীপে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ বাস করেন। বর্তমান প্রশাসক স্থানীয় অধিবাসী, মূলত আদিবাসী মানুষের জমি কেড়ে নেওয়া বা নামমাত্র মূল্যে কেনা সহ বিনা বিচারে এক বছর বন্দি করে রাখা, খাদ্যাভ্যাস বদলে দেওয়া, মৎসজীবীদের জীবিকাচ্যুত করার মতো আইন চালু করার ব্যবস্থা করেছেন। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টকারী নির্মাণ, সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের ছাঁটাই, বহিরাগতদের কোভিড টেস্ট বন্ধ করা সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। দেশ এবং সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করে প্রতিবাদের কাঠামোকেই ধ্বংস করতে চান তিনি, একথাই বলছেন এখানকার মানুষ।
লাক্ষাদ্বীপ পঞ্চায়েত রেগুলেশন ২০২১ (খসড়া) নামের একটি নতুন আইন চালু করতে চাইছেন প্রশাসক, যা চালু হলে স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসিত সংস্থার নির্বাচনে দুইয়ের অধিক সন্তানের বাবা-মায়েরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অথচ এখানে লোক সংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬.২৩ শতাংশ। যা দেশের জাতীয় হার ১৭.৭ শতাংশের অনেক নিচে। এক্ষেত্রে প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এখানকার জনগোষ্ঠীর গরিষ্ঠ অংশ মুসলিম আদিবাসী হওয়াতেই তাঁর এই আইনি প্যাঁচ কষা যা এখানকার ঐতিহ্য বিরোধী।
এর পাশাপাশি রয়েছে ২০২১ সালে আনা অসামাজিক কাজ বিরোধী একটি আইন (গুন্ডা অ্যাক্ট), যে আইন বলে রাষ্ট্র কোন ব্যক্তিকে তাঁর পরিচয় প্রকাশ না করে এক বছর পর্যন্ত বন্দী করে রাখতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে দমন করতে প্রতিবাদকারীকে সমাজবিরোধী হিসেবে দেগে দেওয়ার জন্যই এই স্বৈরাচারী আইন আনা হয়েছে। অন্যদিকে, সমাজবিরোধী কাজকর্মের হার লাক্ষাদ্বীপে খুবই কম। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র তথ্যও একথা বলছে। সম্প্রতি ঐ দ্বীপে সিএএ এবং এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে ঐ আইন ব্যবহার করা হয়েছে।
‘এই আইনের মাধ্যমে দ্বীপবাসী মানুষ যারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে বাস করেন তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রশাসক’ - একথা বলেছেন কেরালার রাজ্যসভার সাংসদ এলামারাম করিম। তাঁর বক্তব্য, দ্বীপের অধিবাসীরা যাতে অন্য কোথাও বিচার চাইতে যেতে না পারেন তাই তাদের প্রতি এই আইনি বৈষম্য। এসব করা হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থে। এ প্রসঙ্গে এই সাংসদ রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে একটি চিঠি দিয়েছেন প্রশাসককে সরাতে।
লাক্ষাদ্বীপে সাধারণভাবে প্রশাসকরা বিভিন্ন স্বশাসিত সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন এতকাল। সেখানে এই পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ প্যাটেল সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটছেন। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্থা ভেঙে দিয়েছেন বা তার ক্ষমতা খর্ব করেছেন।
এআইকেএস সহ প্যাটেলের অন্যান্য সমালোচকদের তার সম্পর্কে একাধিক সমালোচনা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো কর্পোরেটদের জন্য জমি দখল করার আগ্রাসী মনোভাব। এই দ্বীপপুঞ্জের সমস্ত দ্বীপগুলি মিলিয়ে মোট স্থলভাগের পরিমাণ মাত্র ৩২ বর্গ কিলোমিটারের মতো। যেখানে গাড়ি খুব কম চলাচল করে। অ্যান্ড্রট আইল্যান্ড দ্বীপ যা আয়তনে সর্বোচ্চ তা কোনো কোনো জায়গায় সর্বোচ্চ এক কিলোমিটারের সামান্য বেশি চওড়া। জাতীয় সড়কের মতো সড়ক গড়ার জন্য এখানে উদ্যোগ নিয়েছেন প্রফুল খোড়া প্যাটেল। সেখানে হাইওয়ে গড়ার জন্য হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে নির্মাণ করার কি যৌক্তিকতা আছে? কি যৌক্তিকতা আছে এখানকার যে জায়গাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ সেখানে বুলডোজার দিয়ে মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার? কি দরকার আছে সেখানে পরিবেশ তছনছ করে যথেচ্ছ নির্মাণ কাজ চালানোর? এই ধরনের এবং আরো অনেক অযৌক্তিক কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রশাসক প্রফুল খোড়া প্যাটেল। বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে তার এইসব অগণতান্ত্রিক এবং অযৌক্তিক কাজের ঠ্যালায় প্রাকৃতিক নিসর্গ এবং শান্তির মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত লাক্ষাদ্বীপ এখন মানুষের প্রতিবাদে মুখরিত।
তাঁর কাজকর্মের বিরুদ্ধে আরও যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মালায়ালাম সিনেমা অভিনেতা পৃথ্বীরাজ সুকুমারন, কেরালার সমস্ত সাংসদ সহ স্ব স্ব ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। পরিস্থিতির গুরুত্ব এতটাই যে দক্ষিণ ভারতের নিউজ চ্যানেলগুলোতে প্রাইম টাইমে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসকের কার্যকলাপের জেরে নিয়মিত বসছে বিতর্ক সভা। আর সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধু দ্বীপবাসী মানুষই নন, ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন দেশ ও সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ।
আরও যে বিষয়টি লাক্ষাদ্বীপের মানুষকে এবং প্রতিবাদীদের অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করেছে সেটা হল লাক্ষাদ্বীপ অ্যানিম্যাল প্রিজারভেশন অ্যান্ড রেগুলেশন ২০২১ আইন যা একেবারেই বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে কার্যকর করা গোহত্যা বিরোধী আইনগুলোর মতোই একপেশে। এটা গোমাংসের জোগান বন্ধ করার জন্যই আনা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে প্রাণী হত্যার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। মনে করা হচ্ছে, এই লাইসেন্স মাংসের জন্য গোহত্যায় দেওয়া হবে না। আদিবাসী অংশের মানুষ এখানকার প্রাচীন অধিবাসী। এই দ্বীপবাসীদের নিজস্ব জীবনচর্যা রয়েছে। যেখানে তারা গো উৎপাদন করেন। করেন কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য, দুধের জন্য, মাংসের জন্য এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক কারণে। নয়া আইনে এসবই অবদমিত করতে চাওয়া হয়েছে। এই যে একগাদা পরিবর্তন আনা হচ্ছে দ্বীপপুঞ্জে, তার জেরে দ্বীপে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফাঁদে পড়ে দ্বীপবাসী মানুষ তাদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন যা আশঙ্কার বিষয়। অথচ, লাক্ষাদ্বীপে পাওয়া যায় সমুদ্র শসার মতো সামুদ্রিক জীব যার প্রজাতি এই মুহূর্তে বিলুপ্ত হওয়ার মুখে, তা নিয়ে কোনো বক্তব্য বা উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।
দীর্ঘ দিন ধরেই লাক্ষাদ্বীপের সমস্ত অধিবাসীরাই স্বতপ্রণোদিতভাবে দ্বীপপুঞ্জে অ্যালকোহল ব্যবহারের বিরোধী। সেখানে একটি মাত্র দ্বীপ বানগারাম, যা ট্যুরিস্টদের অত্যন্ত প্রিয়, সেখানে ছাড়া অন্যত্র রয়েছে অ্যালকোহল সেবনে স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। নয়া প্রশাসক প্যাটেল এখন গো নিধন বন্ধ করার পাশাপাশি আরো তিনটি দ্বীপে চালু করতে চাইছেন অ্যালকোহলের ব্যবহার। তাঁর এই ঐতিহ্যবিরোধী পদক্ষেপে রীতিমতো ক্ষুব্ধ দ্বীপবাসীরা।
বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে গুজরাটের স্বার্থ দেখতে তিনি আরও একটি চরম অগণতান্ত্রিক কাণ্ড করেছেন। তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন দ্বীপের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তর এবং ঐ দপ্তরের অধীনে কর্মরত অস্থায়ী কর্মচারীদের ছাঁটাই করেছেন। বড়ো ডেয়ারি ফার্মগুলিকেও বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশের জেরে সেখানকার অস্থায়ী কর্মীদেরও বরখাস্ত করা হয়েছে এবং নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে দপ্তরের প্রাণিসম্পদ। এর পাশাপাশি সেখানে গুজরাট কেন্দ্রিক আমুল সংস্থাকে দুধ এবং দুধজাত সামগ্রী বিক্রির জন্য অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর এহেন কাজের ফলে দ্বীপবাসীদের ক্ষোভ তুঙ্গে। যেটা ঘটেছে তা হল তিনি দ্বীপবাসীদের বিরোধিতা করছেন দ্বীপভূমির বাইরের মানুষদের সমস্ত রকম অগ্রাধিকার দেবার জন্যই, এই অভিযোগের ন্যারেটিভ ক্রমশ জোরালো হয়েছে।
কোভিড সম্পর্কে তাঁর পদক্ষেপ গোটা দেশেই বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। করোনা পরীক্ষার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তুলে দেওয়া হয় তাঁর নির্দেশে। তাঁর দায়িত্ব নেবার আগে থেকেই দ্বীপে চালু থাকা কোভিড পরীক্ষার জন্য বহিরাগতদের দ্বীপে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নেগেটিভ আরটিপিসিআর রিপোর্ট দাখিল তুলে দেওয়া হয়। তুলে দেওয়া হয় বাধ্যতামূলক নিভৃতাবাসের নিয়ম। প্রতি স্কোয়ার কিলোমিটার পিছু ২০১৩ ঘনত্ব সম্পন্ন লাক্ষাদ্বীপের কোভিড পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটে এরপরই। যেখানে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি অবধি কোনও কোভিড রোগী ছিল না, সেখানে ১৮ জানুয়ারি অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তুলে দেবার আট দিন পরে প্রথম কোভিড রোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। এই তুঘলকিপনার জন্য কোভিড পরিস্থিতি এখন লাক্ষাদ্বীপে আকাশচুম্বী।
প্রশাসকের আরও একটি নির্দেশ নিয়ে দ্বীপের মানুষ ক্ষুব্ধ। লাক্ষাদ্বীপের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার পর তা দীর্ঘদিন ধরেই কেরালার বেপোর বন্দরে নিয়ে যেতেন। এই মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কেরালার মানুষের এই বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। নয়া প্রশাসক প্রফুল প্যাটেল এসে কেরালার সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের মানুষের দীর্ঘ পরম্পরা ভাঙতে মৎস্যবাহী জলযানগুলিকে কর্নাটকের ম্যাঙ্গালোর বন্দরে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন বিজেপি শাসিত রাজ্যটির ফায়দার জন্য।
এই দ্বীপের মানুষদের অন্যতম মূল জীবিকা হলো মাছ ধরা। প্রশাসকের নয়া কোস্টাল রেগুলেশন আইন বলে সমুদ্রের ধারে জাল শুকানো থেকে মাছ রাখার মৎস্যজীবীদের অস্থায়ী কাঠামো সহ যে ব্যবস্থা রয়েছে তা সমস্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়েই এসমস্ত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ-সমস্তই কোস্টাল আইনের বিরোধী। এর দরুন মৎস্যজীবি সম্প্রদায় প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। জীবিকা নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন তাঁরা।
সারা ভারত কৃষকসভার পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে বরখাস্ত করা এবং মূল আইনগুলিকে বজায় রাখার দাবি জানানো হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেভাবে সময়ের দ্বারা পরীক্ষিত লাক্ষাদ্বীপের প্রচলিত আইনগুলিকে কোনরকম মতবিনিময় ছাড়াই অগণতান্ত্রিকভাবে বাতিল করা হয়েছে তা সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি রূপায়ণের জন্যই। লাক্ষাদ্বীপ এমন একটি অঞ্চল যেখানে মুসলিমরাই জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ, সেখানে এই প্রশাসক দেশের এবং সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার বুননকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে।
আবার আরএসএস’র মুখপাত্র অর্গানাইজার পত্রিকায় প্রশাসকের অগণতান্ত্রিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদকে সাম্প্রদায়িক তকমা দেওয়ার যে চেষ্টা হচ্ছে তারও প্রতিবাদ করা হয়েছে এআইকেএস’র পক্ষ থেকে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই প্রশাসকের বিভিন্ন পদক্ষেপে কৃষি এবং কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন জীবিকাগত কার্যকলাপ এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গোমাংস বিক্রি, বহন করা, কেনা-সমস্ত কিছুই যে আইন বলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার ভেতরে বলদ, মহিষ সমস্ত কিছুকেই রাখা হয়েছে। আইনে শাস্তি হিসেবে যানবাহন বাজেয়াপ্ত করা থেকে ন্যূন্যতম ১০ বছরের জেল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সংস্থান রাখা হয়েছে যা অযৌক্তিক। এক্ষেত্রে রাখা হয়েছে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দেবার বিষয়টিকেও। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে ঘটানো এই যাবতীয় বিষয়গুলির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের কথা বলা হয়েছে এআইকেএস’র পক্ষ থেকে।