E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৮ মে, ২০২১ / ১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

কমরেড রবীন মণ্ডলের জীবনাবসান


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা কমরেড রবীন মণ্ডল ২৫ মে, মঙ্গলবার দুপুরে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর কয়েকদিন আগে বাড়ি ফিরে এলেও তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। এদিন দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে রঘুনাথপুরে নিজের বাসভবনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কমরেড রবীন মণ্ডলের জীবনাবসানে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্য মিশ্র। কমরেড রবীন মণ্ডলের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব বলেছেন, সংসদীয় ও সংসদ বহির্ভূত দু’ধরনের সংগ্রামেই সমান দক্ষ ছিলেন কমরেড রবীন মণ্ডল। বিধানসভায় সব দলের বিধায়করা যেভাবে তাঁর কাছে আসতেন ও আলোচনা করতেন তা ছিল শিক্ষণীয়। নিউটাউন গড়ে তোলায় সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। সিপিআই(এম)’র উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী শোকপ্রকাশ করে বলেছেন, কমরেড রবীন মণ্ডল ছিলেন প্রাণচঞ্চল, খোলা মনের মানুষ। সমাজের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও তাঁর দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার সাহস অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। আমার অসুস্থতার সময়ও তিনি মনোবল জুগিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাই।

কমরেড রবীন মণ্ডলের জন্ম ১৯৪১ সালের ১১ নভেম্বর। দমদম মতিঝিল কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। রাজারহাট এলাকায় পার্টি সংগঠন বিকাশের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। এছাড়াও ছিলেন অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার কৃষক ও উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। রাজ্য স্তরেও নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র আন্দোলনের মাধমেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসেছিলেন। মতিঝিল কলেজে বিপিএসএফ’র ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পঞ্চায়েতের আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ও পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচিত হন। প্রথমে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। কিন্তু পার্টির নির্দেশ মেনে ১৯৬৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাজারহাট (৩) আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে পার্টির ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সদস্য হন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আমৃত্যু পার্টির জেলা কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য ছিলেন। এছাড়াও সামাজিক ন্যায় মঞ্চের জেলা সভাপতি ছিলেন।

পরিষদীয় কর্মকাণ্ডেও কমরেড রবীন মণ্ডল দীর্ঘ অবদান রেখেছেন। ১৯৬৯ সালে রাজারহাট বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। তিনি মোট এগারো বার বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সাতবার জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে বিধানসভায় সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক নির্বাচিত হন। বিধানসভায় বহু আলোচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন।

কমরেড রবীন মণ্ডল রাজারহাট সহ জেলার পার্টি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। সাতের দশকে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের সময়ে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। একবার বোমা ছুঁড়ে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু রাজারহাটের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে সাহসিকতার সঙ্গে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন রবীন মণ্ডল। কৃষক আন্দোলন, উদ্বাস্তু আন্দোলন ছাড়াও জেলার ভেড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজারহাটের উন্নয়নে সক্রিয় ছিলেন। রাজারহাটের পঞ্চায়েত অঞ্চলের বহুমুখী উন্নয়ন, রাজারহাট-গোপালপুর পৌরসভা গঠনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রাজারহাটের প্রথম মহাবিদ্যালয় ডিরোজিও মেমোরিয়াল কলেজ গঠনেও তাঁর অবদান ছিল। ভিআইপি রোডের ফ্লাইওভারের জন্য তাঁর প্রস্তাব বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে নেওয়া হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে জ্যোতি বসু নগর (নিউটাউন) তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর বিরাট উদ্যোগ ছিল। নেবারহুড ডেভেলপমেন্ট কমিটি ও ব্রাডা’র চেয়ারম্যান এবং জমিদাতাদের কমিটির সংগঠকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কমরেড রবীন মণ্ডল ছিলেন সুবক্তা, সাহসী এবং রসিক মনের মানুষ।

কমরেড রবীন মণ্ডলের প্রয়াণে তাঁর বাসভবনে এসে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেখা গোস্বামী সহ বামফ্রন্ট এবং পার্টি নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, বিধায়ক তাপস চ্যাটার্জি, বিধায়ক অদিতি মুনশি, বিধাননগর পৌর নিগমের প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য প্রণয় রায়, জাতীয় কংগ্রেস নেতা সমীর রায় সহ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা।

কমরেড রবীন মণ্ডলের মরদেহ তাঁর বাসভবন থেকে রঘুনাথপুর পার্টি অফিস হয়ে বারাসতে সিপিআই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাঁর দেহে রক্ত পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তড়িৎবরণ তোপদার, পলাশ দাস, সুভাষ মুখার্জি সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ। বাড়িতে ও জেলা অফিসে শ্রদ্ধা জানান স্ত্রী পদ্মাবতী মণ্ডল, প্রবীণ নেতা অমল গুহ, গার্গী চ্যাটার্জি, ময়ূখ বিশ্বাস, বলাই চ্যাটার্জি, রমলা চক্রবর্তী, মানস মুখার্জি, তন্ময় ভট্টাচার্য, বাবুল কর, শুভজিৎ দাশগুপ্ত, ঝুলন দাশগুপ্ত, জহর ঘোষাল, সত্যসেবী কর, সবিতা চৌধুরি, সোমা দাশ, দেবশঙ্কর রায় চৌধুরী, পুলক কর, পারভেজ উর রহমান, দেবজ্যোতি দাশ, দিলীপ সাহা, রানা রায়, অরিন্দম চক্রবর্তী সহ ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠন এবং সামাজিক ন্যায় মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। পরিবারের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান মৌ মণ্ডল। এদিনই রতনবাবু শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।