৫৮ বর্ষ ৪১ সংখ্যা / ২৮ মে, ২০২১ / ১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮
সুন্দরলাল বহুগুনা স্মরণে
তপন মিশ্র
সেদিন ছিল ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ। চামোলির কাছে রেনি গ্রামের গ্রামবাসীরা এক ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকে খবর পায় যে, জঙ্গলে গাছ কাটার জন্য কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে, সঙ্গে বনবিভাগের লোক।রেনির নিস্তরঙ্গ জীবন হঠাৎ যেন তরঙ্গায়িত হলো। মহিলা মঙ্গল দলের নেত্রী গুড়া দেভীর নেতৃত্বে ২৭ জন মহিলা একজোট হয়ে জঙ্গলে ছুটে যান। তখন গাছ কাটা শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। ঠিকাদারদের অনেক আক্রমণ ও গালাগাল সত্ত্বেও মহিলারা গাছ জড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় সব প্রস্তুতি। সকাল থেকে সারারাত চলে গাছের পাহারা। পরেরদিন আসেপাশের গ্রামের মহিলা, পুরুষ এবং দাসোলি গ্রাম স্বরাজ সমিতির নেতারা এসে উপস্থিত হন। বেগতিক দেখে ৪ দিন অপেক্ষার পর গাছ কাটার ঠিকাদাররা পালিয়ে যায়। এভাবেই শুরু হয়ে যায় গাড়োয়াল হিমালয়ের পৃথিবী বিখ্যাত ‘চিপকো আন্দোলন’। এই প্রতিরোধ একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা হলেও প্রতিবাদের সূত্রপাত হয় অনেক আগে। এরপর সুন্দরলাল বহুগুনার নেতৃত্বে জঙ্গল থেকে গাছ কাটার বিরুদ্ধে চামোলি জেলার গ্রামে গ্রামে প্রচার চলে। জঙ্গল ও পরিবেশ রক্ষার সেই সেনাপতি সুন্দরলাল বহুগুনা গত ২১ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন। তিনি কেবল চিপকো আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন না, ছিলেন একজন অভিজ্ঞ পরিবেশবিদ, সর্বজন শ্রদ্ধ্যেয় সমাজসংস্কারক মানবদরদী ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
বিস্তীর্ণ হিমালয় ছিল তাঁর প্রাণ। হিমালয়ের ক্ষণভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করার সম্ভাব্য সমস্ত প্রয়াসের তিনি ছিলেন অংশীদার। বারবার মজে যাওয়া নদীর জলের তোড়ে অসহায় মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। ১৯৭০ সালে এমনই এক ভয়ঙ্কর বন্যা আসে অলকানন্দা নদীতে। নদীর ফুঁসে ওঠা জলের সঙ্গে পাহাড়ের পলি মিলে মিশে জোশিমঠের এক বড়ো অংশকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়। সুন্দরলাল বহুগুনা সহ অনেকেই বুঝতে পারেন, অরণ্য ধ্বংসই এই সর্বনাশের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ কারণ। তাঁরা প্রচার শুরু করেন, যার মুল বক্তব্য ছিল গাছ কাটার প্রত্যক্ষ কারণ হলো বন্যা ও ভূমিক্ষয়। মানুষ বুঝতে শুরু করে যে, পাহাড়ে বসবাস করতে হলে ঠিকাদারদের হাত থেকে অরণ্য রক্ষা করা জরুরি। তখন ইংরেজদের তৈরি ১৯২৭ সালের ফরেস্ট অ্যাক্ট ছিল অরণ্য নির্ভর মানুষদের মধ্যে আতঙ্কের কারণ।
১৯২৭ সালে ৯ জানুয়ারি হিমালয়ের কোলে তেহরির কাছে মারদা গ্রামে জন্ম হয় সুন্দরলাল বহুগুনার। বর্তমানে এই অঞ্চল উত্তরাখণ্ডের অংশবিশেষ। পরিবেশ রক্ষার প্রতি তাঁর অবদানের জন্য ২০০৯ সালে তাঁকে ভারত সরকার পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করে। ২০২০ সালে Right Livelihood Award নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের পাশাপাশি একাধিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন তিনি।
চিপকো আন্দোলনের সলতে পাকানো
চিপকো আন্দোলন বাদ দিয়ে সুন্দরলাল বহুগুনার জীবনচর্চা সম্ভব নয়। এই আন্দোলনে তাঁর অভিনব স্লোগান ছিলঃ ‘গাছ কাটার আগে আমাকে কেটে ফেল। কারণ একটি গাছের জীবন আমার জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য একটি গাছের জীবন বাঁচানো জরুরি।’ হিমালয়ে অরণ্য রক্ষার আন্দোলনের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। স্বাধীনতার আগেও (১৯৩০ সালের ৩০ মে) ‘তিলারি কাণ্ড’ নামে খ্যাত এক আন্দোলনে সরকারি বননীতির বিরুদ্ধে এক বিশাল সত্যাগ্রহ সংগঠিত হয়। তেহরি-গাড়োয়ালঅঞ্চলে তিলারিতে সরকারি উদ্যোগে কিছুদিন অন্তর অন্তর গাছ কাটার বিরুদ্ধে মানুষ সত্যাগ্রহে বসেন। তখন তেহরির মহারাজা ইয়োরোপ ভ্রমণে ব্যস্ত। তাঁর প্রধানমন্ত্রী চক্রধর জুয়ালের নির্দেশে যমুনার পাড়ে সংগঠিত মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়। ফলে শিশু, মহিলা সহ বেশ কিছু মানুষ পালিয়ে যাওয়ার সময়ে যমুনার স্রোতে ভেসে যায়। স্বাধীনতার পরও মানুষের এই অসন্তোষ কমেনি কারণ বন আইনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
১৯৬২ সালে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনকালীন একটি প্রচারপত্রে বলা হয় যে, চিপকো কেবল একটি অরণ্য সংরক্ষণের আন্দোলন নয়। বনবাসীদের বনসম্পদের অধিকার অর্থাৎ বনবাসীদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য বনসম্পদের ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরলাল বহুগুনাও এই দাবির পক্ষে ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৪ এপ্রিল এই দাবি নিয়ে তিনি এক সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে কুড়ুল এবং বনবাসীদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির পূজা করা হয়।
১৯৭৩ সালে চামোলি জেলার জঙ্গলে এক বিশেষ প্রজাতির গাছ কাটার সরকারি অনুমতি নিয়ে হাজির হয় এলাহাবাদের এক ক্রীড়া সামগ্রী তৈরির কারাখানা ‘সাইমন্ডস’-এর মালিক। প্রথমে ১৪টি গাছ কাটা শুরু হয়। ওই অঞ্চলের কঙ্গু বা অঙ্গু গাছ (Ashtree বা Fraxinussp) টেনিস বা ব্যাডমিন্টনের র্যাককেট তৈরির কাজে লাগে। প্রতিরোধ গড়ে তোলেন চণ্ডি প্রসাদ ভটের নেতৃত্বে দাসোলি গ্রাম স্বরাজ সমিতি। এটা ছিল ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাস। তার পর ডিসেম্বরে গোপেস্বরের ফাটা-রামপুর অঞ্চলে আবার গাছ কাটার কাজ শুরু হয়। তারপর ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারের বনদপ্তর জোশিমঠ ব্লকের রেনি গ্রামের কাছের পেং-মুরিন্দা জঙ্গলে ২৫০০টা গাছ কাটার অনুমতি দেয়। এখানেই শুরু হয় আসল প্রতিরোধ।
আন্দোলনের পুরোভাগে
রেনির ঘটনার পর সরকার থামেনি। গাড়োয়াল হিমালয়ের আরও বিভিন্ন অংশে চলে গাছ কাটার কাজ। কুমায়ুনের নাইনিদেবী, কাটওয়াড়, রামনগর ইত্যদি অঞ্চলেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নৈনিতালে ১৯৭৭ সালের ২৮ অক্টোবর ছাত্রদের উপর গুলি চালনার ঘটনা ঘটে। সুন্দরলাল বহুগুনা অনশনে বসেন।
কিছুদিনের মধ্যে সরকার জঙ্গলের ব্যবসায়িক ব্যবহার সম্পর্কে নীতি নির্ধারণের জন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বীরেন্দ্র কুমারের নেতৃত্বে একটি ৯ জনের কমিটি গঠন করে। সে কমিটিতে এলাকার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়ক গোবিন্দ সিং নেগি, সুন্দরলাল বহুগুনা সহ আরও ৬ জনকে যুক্ত করা হয়। প্রায় ২ বছর পর কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে। এখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়।
১। পাহাড়ে ৩০ ডিগ্রি বা বেশি ঢালে কোনো গাছ কাটা যাবেনা।
২। সমুদ্রতল থেকে ১০০০ মিটারের উপরে কোনো গাছ কাটা যাবেনা।
৩। অলকানন্দা নদীর ১২০০ বর্গ কিলোমিটার অববাহিকায় (River catchment) জঙ্গলে কোনভাবেই ব্যবসায়িক কারণে গাছ কাটা যাবেনা।
এই সুপারিশ ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বলবত থাকে। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহের মতে (The Unquiet Woods, 1990) “Chipko is the latest in a long series of peasant protests going back to the turn of the century against commercial forestry in the Uttar Pradesh Himalaya”। চিপকো আন্দোলন আসলে এক কৃষক আন্দোলন। অরণ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়।
সুন্দরলাল বহুগুনা কেবল ঠিকাদার বা বননিগমের গাছ কাটার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তাই নয়, বৃক্ষ রোপণ, অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য বনবাসীদের কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পরিচালনা, পরবর্তীকালে মহিলাদের মদ ইত্যাদি নেশার বিরুদ্ধে অভিযান সংগঠিত করা, হিমালয় অঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে জৈববৈচিত্র্য বজায় রাখার জন্য বীজের সংরক্ষণ ইত্যদি কাজেও নেতৃত্ব দেন। হিমালয়ে সুস্থিতি উন্নয়ন (sustainable development)-এর লক্ষ্যে কাশ্মীর থেকে কোহিমা পর্যন্ত প্রায় ৪,৮০০ কিলোমিটার পদযাত্রা ১৯৮০ দশকের প্রথম দিকে তিনি পরিচালনা করেন।
তেহরি বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করে ১৯৯৬ সালে ৭৪ দিন অনশন করেন সুন্দরলাল বহুগুনা। তার আগে ১৯৯৫ সালে ৪৫ দিনের অনশনও করেন একই কারণে। উভয় ক্ষেত্রেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীদের হস্তক্ষেপে অনশন প্রত্যাহৃত হয়। তেহরি বাঁধ নির্মাণের কারণে অনেক মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে ভূকম্পের সম্ভাবনা বৃদ্ধি, এই অঞ্চলে এক বড়ো অংশে অরণ্য ধ্বংস ইত্যাদির কারণে সুন্দরলাল বহুগুনা এই বাঁধের বিরোধিতায় নামেন। এমনকি তাঁর নিজের বাড়িও তেহরি বাঁধে ডুবে যায়। এই বাঁধ নির্মাণের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অনশন করেন তিনি। একই কারণে ২০০১ সালের ২৪ এপ্রিল অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে জেলে যেতে হয়। হিমালয়ের কোলে হোটেল বিল্ডিং এবং বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার বিরোধিতা করেও আন্দোলনে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন বারবার।
আরও অনেক পথ চলা বাকি
চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গায়ত্রী দেবী বলেনঃ “আমরা চিপকো থেকে কিছুই পায়নি। এমনকি আমাদের হক (অরণ্য সম্পদের উপর চিরাচরিত অধিকার) আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা আগে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম, এখন সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। “কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্দেহ নেই সুন্দরলাল বহুগুনা এবং চণ্ডী প্রসাদ ভটের নেতৃত্বে চিপকো আন্দোলন দেশে ও বিদেশে পরিবেশ আন্দোলনের একটি রূপরেখা তৈরি করেছে। আমাদের দেশে ১৯৮০ সালের অরণ্য রক্ষা আইন, ১৯৮৮ সালের নতুন বননীতি যেখানে যৌথ বন পরিচালনার কথা বলা হয়, ২০০৬ সালের ঐতিহাসিক অরণ্য অধিকার আইন এই আন্দোলনের ফলশ্রুতি। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া থেকে উত্তরকাশী পর্যন্ত এখন নন্দাদেবী রিজার্ভ ফরেস্টের অন্তর্ভুক্ত। ফলে অরণ্য সম্পদের উপর সমস্ত ধরনের চিরাচরিত অধিকার বাতিল হয়েছে। একদিকে অরণ্য সম্পদ রক্ষা অন্য দিকে অরণ্যবাসীদের অধিকার রক্ষা, এই দুয়ের মধ্যে এখনও ভারসাম্য রক্ষার কোনো চেষ্টাই করছেনা সরকার। সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ের অংশ এই আন্দোলনে সুন্দরলাল বহুগুনার মতো মানুষের অভাব চিরদিন অনুভূত হবে।