E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯

গ্রাম জাগাও রাজ্য বাঁচাও

অমিয় পাত্র


ধনিয়াখালি ব্লকের মান্দ্রা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বুথে বুথে পদযাত্রা।

তৃণমূল সরকারের শাসনে গত ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গে অরাজকতা, গুন্ডামি, তোলাবাজি ও দুর্নীতি সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। শাসকদলের আগাপাছতলা দুর্নীতির পাঁকে ডুবে আছে। নেতামন্ত্রীদের কাজ হলো লুট, কাটমানি খাওয়া আর তোলাবাজি করা। এই সরকার তিল তিল করে রাজ্যকে শ্মশানের ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে। রাজ্যে কাজের সুযোগ নেই। বাঁচার মতো মজুরি নেই। তাই পরিবারের জন্য দু-মুঠো অন্ন জোগাতে অনেকেই ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রগুলি এক এক করে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। নতুন কোনো শিল্প, কারখানা হচ্ছে না। তৃণমূল নেতাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ না দিলে কোনো চাকরি হয়না। কাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সমস্ত সরকারি কাজে ভুরি ভুরি দুর্নীতি চলছে। বালি, পাথর, কয়লা, মাটি, জঙ্গলের গাছ লুটপাট হচ্ছে। শাসকদলের নেতা সাঙ্গোপাঙ্গ সহ গোরু পাচারের অভিযোগে জেলে। শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী সহ হাফ ডজন ঘুষখোর এখন জেলের ঘানি টানছেন। দুর্নীতির তদন্ত চলতে থাকলে এটা নিশ্চিত যে গোটাদলটাই জেলবন্দি হবে। রাজ্যে অন্যায়, অবিচার, জুলুমের কোনো প্রতিকার নেই। সর্বত্র পুলিশ এবং মস্তানদের দাপাদাপি।

বাংলার জনগণ কী এরকম একটা সর্বনাশা সরকার চেয়েছিলেন? এই লুটতরাজের সরকার এবং শাসক দলকে কী বরদাস্ত করা যায়? এদের খপ্পরে পড়ে আমাদের জীবন জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার অবস্থা, রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ এক গভীর সংকটগ্রস্ত। এ রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। গরিবদের জন্য বরাদ্দ অর্থ লুট হয়েছে। দুর্নীতি করেছে তৃণমূল, ভুগছেন লক্ষ লক্ষ কর্মহীন শ্রমজীবী। ছোটো থেকে বড়ো - সব নেতার টাকা কামানোর সাম্রাজ্য ঠিক করে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। চুরি ধরা পড়েছে শিক্ষক নিয়োগে, ১০০ দিনের কাজে, সড়ক যোজনা ও আবাস যোজনায়। জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। রাজ্যের দেনার পরিমাণ বেড়ে এখন ৫.৬২ লক্ষ কোটি টাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোথাও ছাত্র নেই, কোথাও ছাত্র আছে শিক্ষক নেই, তাই বন্ধ হচ্ছে স্কুল। রাজনীতি হচ্ছে জাতপাত আর ধর্ম নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী রাম মন্দির নির্মাণ করছেন আর মুখ্যমন্ত্রী দীঘায় জগন্নাথ মন্দির বানানোর কথা বলছেন। স্কুলের মিড ডে মিলে বাচ্চাদের একটা ডিম খাওয়ানোর টাকা নেই, অথচ পুজো কমিটির জন্য অনুদান দিয়েছেন ২৫৮ কোটি টাকা। বাংলায় এই হুল্লোড়বাজ, জোচ্চরদের সরকারের আর দরকার নেই। সুযোগ বুঝে মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি। জাত, ধর্মের ধুয়ো তুলে মানুষকে ভাগ করতে চায়। দেশের লুটেরা, দুর্নীতিগ্রস্তদের রক্ষা করে চলেছে উভয় সরকার। রাজ্যের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে দুর্নীতিবাজদের জন্য টিএমসি, বিজেপি’র অবারিত দ্বার। এদের উৎখাতের লড়াই শুরু হয়েছে। গ্রাম শহরে প্রতিরোধের শক্তি ক্রমশ সংহত হচ্ছে। এ লড়াই সফল করতে সর্বস্তরের পার্টি সদস্য, কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং গণতন্ত্র ও প্রগতিতে বিশ্বাসী সকলের সহযোগিতা কাম্য। ত্রিস্তরের পঞ্চায়েত সাধারণ নির্বাচন ২০২৩ সালের গোড়ারদিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে। শাসকদল এবং রাজ্য প্রশাসনের সেই লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন পেশ থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই শাসকদলের আশ্রিত গুন্ডামাস্তান ও পুলিশের জুলুম ভোট প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। নির্বাচনের প্রচার পর্বে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত গঠনের ডাক দেন। গত একদশকে দলবদলের রাজনীতি, জুলুম, লুটপাট, চুরি দুর্নীতিতে যুক্ত শাসকদল পুরনো কায়দায় এই নির্বাচনেও ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাবে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি ভোটারদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে বিশেষত গরিব বা শ্রমজীবীদের বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে অল্প কয়েকটি এলাকা ছাড়া শাসকের সন্ত্রাস প্রতিরোধে পার্টির উল্লেখযোগ্য ভুমিকা দেখা যায়নি। বিজেপি যে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের রাস্তা মসৃণ করতেই বাংলার রাজনীতির ময়দানে নেমেছে সেটা তখন মানুষকে বোঝানো যায়নি। বিজেপি-কে সমর্থন যে ভুল পথ ছিল তা মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। জনগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো - বিজেপি-র প্রতীকে বা নির্দল হিসাবে যারা গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগ তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। ‘আগে রাম, পরে বাম’ - এই আওয়াজ তোলা হয়েছিল পার্টির শ্রেণিভিত্তিকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যেই। এটা ছিল আর এস এস’র সংগঠিত প্রচার।

এই সময়ে গরিব ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশের মানুষের ঐক্য যত দুর্বল হয়েছে ততই আর্থিক এবং সামাজিক নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধী শক্তি হিসেবে বামপন্থীরা যতটা দুর্বল হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের জুলুম, দুর্নীতি, লুটপাট ততটাই বেড়েছে। বর্তমানে নেতা-মন্ত্রীদের বেহিসেবি সম্পদ, বৈভব এতটাই বেড়েছে যা আর আড়াল করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তদন্তে কোটি কোটি নগদ টাকা, বাড়ি, গাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সোনাদানা বাজেয়াপ্ত হচ্ছে। বাংলার পথে ঘাটে সর্বত্র দুর্নীতি ও লুটপাটের এই চর্চাই চলছে। এই চর্চা থামিয়ে দেবে সে সাধ্য তৃণমূল কংগ্রেসের নেই। রাজ্যকে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। পঞ্চায়েতগুলোতে দুর্নীতির আখড়া ভাঙতে হবে। জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার লড়াইয়ে সর্বস্তরের জনগণকে শামিল করতে হবে। ২০১৮ সালে গায়ের জোরে পঞ্চায়েত দখল করেছিল। এবার তা হবে না। লড়াই হবে গ্রামে গ্রামে, বুথে বুথে। সর্বত্র আওয়াজ তুলুন - কাজ চাই, বুঝে নিতে চাই।

আমরা লক্ষ করছি ক্রমেই বেশি বেশি মানুষ দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসছেন। আমাদের বিশ্বাস নভেম্বর মাসজুড়ে গ্রামকে জাগাতে এবং বাংলাকে বাঁচাতে এই প্রচেষ্টা সফল হবেই। রাজ্যের কৃষক, শ্রমিক ও খেতমজুর সংগঠন ধারাবাহিকভাবে গরিব, কৃষক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ,খাদ্য, মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসগৃহ সহ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে স্বচ্ছতার সঙ্গে উপভোক্তা নির্বাচনের দাবিতে লড়াই করে চলেছে। কৃষকের ফসলের সহায়ক মূল্য, ভরতুকিতে সার, ঋণ, বিমা সহ কৃষি বিপণনের পরিষেবার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ মাশুলে ভরতুকি, কৃষকের দেনা মুকুবের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের আমরা মধ্যে রয়েছি। রাষ্ট্রের সম্পদ করপোরেট স্বার্থে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, শ্রমকোড, বিদ্যুৎ বিল ও নয়া শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের আহ্বান জানাচ্ছি। নভেম্বর মাসজুড়ে নিবিড় জনসংযোগ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই পদযাত্রার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আপনিও আসুন, এই পদযাত্রায় শামিল হোন। আমাদের রাজ্যের সহযোগী ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠন এই লড়াইয়ে শামিল হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যারা সংগ্রাম করে চলেছেন তারাও এই বৃহত্তর লড়াইয়ের শরিক হবেন। নভেম্বরের প্রতিটি দিন আমাদের কাজ হবে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে পৌঁছানো এবং আমাদের এই আন্দোলনের মুল আহ্বান মানুষকে জানানো।

গ্রাম বাংলায় গণজাগরণ চাই, সকলের মিলিত শক্তির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে সব চোর-জোচ্চোরদের তাড়াতে চাই, আমরা চাই - বাংলা আবার মাথা তুলে দাঁড়াক, কাজ বা চাকরি প্রার্থীর মুখে হাসি ফিরে আসুক, কৃষকের ফসলের সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা হোক, ১০০ দিন নয় বছরে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা হোক। থেমে যাবার লড়াই নয়, এ লড়াই ক্রমেই তীব্র হবে।