৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯
শান্তিপূর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের ওপর গভীর রাতে পুলিশের বর্বরোচিত হামলা
পুলিশী বর্বরতার পর ফের রাস্তায় চাকরিপ্রার্থীরা।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ন্যায্য নিয়োগের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের মাঝরাতে মমতা সরকারের পুলিশ যে কায়দায় হামলা চালিয়ে তুলে দেয়, তা নৃশংসতা, বর্বরতার সমস্ত সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ২০ অক্টোবর রাতে বিধাননগরে পুলিশের এই নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পরদিন ২১ অক্টোবর পুলিশের হামলার শিকার হন এসএফআই-ডিওয়াইএফআই’র নেতা-কর্মী এমনকী পথচারীরাও। পুলিশ এদিন কেবল হামলা চালিয়ে থেমে থাকেনি, এসএফআই-ডিওয়াইএফআই’র নেতা-কর্মী সহ প্রায় ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন নেতা পলাশ দাশ। পুলিশের এই অমানবিক কার্যকলাপ ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ২২ অক্টোবর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে রাজ্যের অন্যান্য জায়গাতেও।
এরাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার পর অপশাসন, দুর্নীতি, নৈরাজ্য আকাশ ছুঁয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতিতে কেবল রাজ্য নয়, গোটা দেশে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার জন্য রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী থেকে শিক্ষা দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক, পর্ষদ কর্তা বেশ কয়েকজন এখনও হাজতবাস করছেন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অনুসন্ধানে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত রাজ্যবাসী।
তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে, বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে দপ্তরের আধিকারিকরা নিয়োগ পরীক্ষায় মেধাবী, উত্তীর্ণ যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে, মেধাহীন-অযোগ্য প্রার্থীদের লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়োগপত্র দিয়েছেন। ঘটনায় প্রকাশ, টেট পরীক্ষায় একটিও উত্তর দিতে অক্ষম প্রার্থী, যারা সাদা খাতা জমা দিয়েছে তাদেরও বিপুল টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এমন অনেককে চাকরিতে নিয়োগ করা হয়েছে, যারা কোনো পরীক্ষাতেই বসেনি। কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে বিভিন্ন সময়ে এই তথ্যও বেরিয়ে আসছে যে, দুর্নীতি মামলায় আটক মন্ত্রী থেকে আমলা অনেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, একেবারে উপরতলা অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই এই দুর্নীতিচক্র চলেছে।
এভাবে চরম অনৈতিক, কদর্য দুর্নীতি করে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই কার্যত ধ্বংস করতে উদ্যত এই সরকার।
রাজ্য সরকারের এই লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন বছরে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও মেধা তালিকায় থাকা যোগ্য প্রার্থীরা ন্যায্য নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একেবারে শুরু থেকেই তাদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায় এসএফআই-ডিওয়াইএফআই সহ বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠন ও গণআন্দোলনের কর্মীরা। ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির সামনে, কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাদদেশে অথবা বিধাননগরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে অবস্থান আন্দোলনে বসেন বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা। তাঁদের আন্দোলন কোনো সময়েই কোনো ধরনের অশান্তি বা প্ররোচনা তৈরি করেনি। এই চাকরি প্রার্থীরা দিনের পর দিন ঝড়, জল, রোদের তীব্রতা সয়ে অবস্থান-আন্দোলনে শামিল থেকেছেন। এভাবে দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই তাঁদের শিশুপুত্র নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। যোগ্য-মেধাবী হবু শিক্ষকদের এই নিদারুণ কষ্ট-যন্ত্রণা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের কোনো মানবিক ভূমিকা দেখা যায়নি। উলটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমানে হাজতবাস করা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে অপমানজনক ও উসকানিমূলক মন্তব্য করে চাকরি প্রার্থীদের প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়েছেন। এভাবেই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন প্রায় দেড় বছর অতিক্রম করেছে।
এমনই এক সন্ধিক্ষণে ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ প্রার্থীরা বিধাননগরে করুণাময়ীতে প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের সামনে ১৮ অক্টোবর থেকে আমরণ অনশন আন্দোলন শুরু করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী ২০২০ সালে নবান্ন থেকে ঘোষণা করেছিলেন, ২০১৪ সালের প্রাথমিকে টেট উত্তীর্ণদের ধাপে ধাপে নিয়োগ করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতি এখন প্রতারণায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে নির্দেশ জারি হয়েছে, আবার তাঁদের ২০১৭ সালের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে ইন্টারভিউ দিতে হবে। নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে। দু’বার ইন্টারভিউ দেবার পরও সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাধ্য হয়েই চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগের দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলনকে আরও তীব্র করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা আমরণ অনশন আন্দোলনে শামিল হন। ২০ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের টেট পরীক্ষায় সফল টেট প্রার্থীরাও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে ধরনায় বসেন।
২০ অক্টোবর মাঝরাতে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ হাইকোর্টের এক নির্দেশকে ঢাল করে অনশনকারী ও ধরনায় বসা চাকরি প্রার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের মারতে মারতে প্রিজনভ্যানে ও বাসে তুলে নিয়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, হাইকোর্টের যে নির্দেশকে ঢাল করে এদিন রাত ১২টার পর পুলিশ নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে আনে, সেখানে আদালত কোনো গণতান্ত্রিক অবস্থান আন্দোলনকে তুলে দেবার নির্দেশ দেয়নি। আদালত শুধু পর্ষদ অফিসে কর্মচারীদের প্রবেশ ও বের হবার পথ মুক্ত রাখার কথা বলেছিল। আন্দোলনকারীরাও এদিন পর্ষদে যাতায়াতের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। এমনকী পুলিশ ১৪৪ ধারা জারির কথা বললে তারা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে মাত্র চারজন করে আলাদা আলাদাভাবে দূরে সরে সরে বসেছিল। কিন্তু ওপর মহলের নির্দেশে গভীর রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী মারমুখী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর।
পুলিশের অপারেশন হতে পারে ইঙ্গিত পেয়ে এদিন রাতেই আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান ডিওয়াইএফআই নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, সিআইটিইউ নেতা ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জি প্রমুখ। পুলিশের হামলার সময়ে পাশে ছিলেন তাঁরা।
ওই দিন রাত ১২টা পনেরো নাগাদ পুলিশ মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে রাস্তা খালি করার ঘোষণা করে। পুলিশ মহিলা অবস্থানকারীদের আটক করাই শুধু নয়, তাঁদেরও মারতে মারতে প্রিজনভ্যান ও বাসে তোলে। পুলিশের আক্রমণে দু’জন মহিলা মারাত্মক আহত হলে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে রাত ১টা নাগাদ তাঁদের নিউটাউন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশের এই হামলার তীব্র নিন্দা করেন উপস্থিত ডিওয়াইএফআই নেতৃবৃন্দ। তাঁরা রাতের অন্ধকারে পুলিশের এই অন্যায় ও বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে তীব্র করার ডাক দেন।
পরদিন (২১ অক্টোবর) পুলিশের এই নৃশংসতা, বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুনরায় আক্রান্ত ও গ্রেপ্তার হন মীনাক্ষী মুখার্জি, ময়ূখ বিশ্বাস, প্রতীক উর রহমান, সায়নদীপ মিত্র, মধুজা সেনরায় এবং পলাশ দাশ সহ বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের বর্তমান ও প্রাক্তন নেতা-নেত্রী সহ দুই শতাধিক বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী।
এদিন এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই’র পক্ষ থেকে টেট পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের উপর মাঝরাতে পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণ ও নিয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ভয়ংকর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২১ অক্টোবর বিধাননগরে শান্তিপূর্ণ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল। করুণাময়ী মোড়ে জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়। মিছিল শুরুর আগেই করুণাময়ী মোড় থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়। সিটি সেন্টারের সামনে থেকে মূল মিছিল শুরু হতেই বিশাল পুলিশ বাহিনী জবরদস্তি করে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের আটক করে বাসে তোলে। কেবল আন্দোলনকারীদের নয়, পথ চলতি প্রবীণ মানুষ, মহিলা কাউকেই ছাড় দেয়নি পুলিশ। তাঁদের আটক করে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্গত বিভিন্ন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অল ইন্ডিয়া ল ইয়ার্স ইউনিয়নের সদস্য সহ অনেক আইনজীবী চলে আসেন। তাঁদের সক্রিয়তায় সন্ধ্যার পরে সকলেই মুক্তি পান। নেতৃবৃন্দের মুক্তির পর নিউটাউন থানা থেকে বিশ্ব বাংলা গেট পর্যন্ত মিছিল সংগঠিত হয়।
নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ও অপশাসনের পরিণতিতে যে তীব্র সংকটে পড়েছে তৃণমূল সরকার, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই তৃণমূল সরকার ফ্যাসিস্ত কায়দায় বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে আনছে, গণতন্ত্র হরণের পথে হাঁটছে। এর প্রতিবাদেই আজ রাজ্যের সর্বত্র প্রতিবাদ বিক্ষোভে গর্জে উঠছেন মানুষ। ২২ অক্টোবর কলকাতা মহানগরীর বুকে হাজার হাজার নাগরিকের প্রতিবাদ মিছিল তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন আর নৈরাজ্যের অবসানে আগামীদিনের আরও বৃহত্তর আন্দোলনেরই এক নতুন ইঙ্গিত দিয়েছে।