৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯
কেরালায় রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা
সংবিধান-বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রাজ্যজুড়ে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান রাজ্যের এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে স্বৈরাচারীর মতো কাজ করছেন। রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে পেছনের দরজা দিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের লোক ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। রাজ্যপালের সচিবালয়ে জায়গা দেওয়া হচ্ছে আরএসএস’র সদস্যদের। রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এরকম বহু অভিযোগে তোলপাড় কেরালায় চলছে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিবাদ আন্দোলন। তিনি যে সমস্ত পদক্ষেপ করছেন তা তাঁর পদের অপব্যবহার এবং তাঁর এই অতিসক্রিয়তা অসাংবিধানিক, গণতন্ত্রের মর্মবস্তুর অবমূল্যায়ন। রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রকে গৈরিকীকরণের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন তিনি। একইসঙ্গে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ সংঘ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে। ২৩ অক্টোবর রাজ্যের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে পদত্যাগ করতে বলা এবং প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী কে এন বালাগোপালকে পদত্যাগ করার ইঙ্গিত দেওয়ার মতো রাজ্যপালের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের প্রেক্ষিতেই উঠেছে এই অভিযোগ।
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রাজ্যপাল সংঘ পরিবার বাহিনীর নির্দেশে কাজ করছেন। সিপিআই(এম) কেরালা রাজ্য কমিটির সম্পাদক এমভি গোবিন্দন বলেছেন, রাজ্যপালের সংবিধানবিরোধী এই পদক্ষেপের সর্বতোভাবে বিরোধিতা করবে রাজ্য সরকার এবং পার্টি। কেরালা হাইকোর্ট অবশ্য রাজ্যপালের এই নির্দেশ খারিজ করে দিয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এক বিবৃতিতে রাজ্যপালের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে।
এই সমস্ত অভিযোগে জেরবার হয়ে রাজ্যপালের দপ্তর থেকে সম্প্রতি দাবি করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কেরালা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্যকে পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে রাজ্যপাল সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সুপ্রিমকোর্টের রায়ে সার্চ কমিটির গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইউজিসি-র নির্দেশ মান্য করা হয়নি, তাই এই উপাচার্যদের সরে যেতে বলা হয়েছিল, তাঁদের বরখাস্ত করা হয়নি। প্রসঙ্গত, কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়, কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, কেরালা ইউনিভার্সিটি অফ ফিশারিজ অ্যান্ড ওশান স্টাডিজ, মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কান্নুর বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়ালম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। এর আগে নজিরবিহীনভাবে রাজভবনে দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে আরিফ মহম্মদ খান অবশ্য জানিয়েছিলেন তার সঙ্গে ১৯৮৬ সাল থেকেই সংঘ পরিবারের মাখামাখির কথা। রাজ্যপালের দপ্তর থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে নিয়োগের অভিযোগ তোলার পাশাপাশি বাছাই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞেরা ছিলেন না বলেও দাবি করা হয়। তার প্রেক্ষিতেই রাজ্যপালের উপাচার্যদের পদত্যাগের নির্দেশ বলে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা বলা হলেও তা ধোপে টিকছে না। ২৩ অক্টোবর রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই ন’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগের নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। ২৪ তারিখ সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে উপাচার্যদের পদত্যাগপত্র জমা দিতেও বলেছিলেন। রাজ্যপালের এই ফতোয়া জারির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় কেরালা জুড়ে। রাজনৈতিক মহলের পাশাপাশি শিক্ষামহল রাজ্যপালের এই অগণতান্ত্রিক আচরণের নিন্দায় সরব হয়। কেরালা হাইকোর্টে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন জানান সংশ্লিষ্ট উপাচার্যরা।
এ প্রসঙ্গে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডক্টর টমাস আইজ্যাক বলেন, রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কেরালা বিধানসভায় পাস হওয়া আইন অনুসারে, উপাচার্যদের নাম বাছাই করার পর তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রিভিউ পিটিশন দাখিল সহ একাধিক আইনি পথ খোলা আছে রাজ্য সরকারের কাছে।
২৪ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি দেবন রামচন্দ্রনের বেঞ্চে উপাচার্যদের অভিযোগের শুনানি হলে কেরালার নয় উপাচার্যকে বহাল রাখার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি রাজ্যপালের নির্দেশে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন কাউকেই এভাবে পদত্যাগ করতে বলা যায় না। এই কথা বোঝার জন্য কোন রায়ের দরকার পড়ে না। এখন যখন রাজ্যপালের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন তখন তার গতকালের নির্দেশের আর কোন অর্থ নেই। উপাচার্যরা স্বপদেই বহাল থাকছেন।
উপাচার্যদের তরফে আইনজীবীরা বলেন, আচার্য কোন উপাচার্যকে অপসারণ করতে পারেন না। যদি অর্থের নয়ছয় হয় বা অসদাচরণ করা হয়, তবেই তদন্ত সাপেক্ষে বরখাস্ত করা সম্ভব। আচার্য উপাচার্যদের নিয়োগ বাতিল করার পরে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। আবার মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার তথ্য তার আইনজীবী পেশ করে বলেন, আচার্যর নির্দেশে অযথা একটি তকমা লাগিয়ে দেওয়া হল। অন্যদিকে রাজ্যপালের তরফের আইনজীবীরা পরে বলেছেন, আচার্য মনে করছেন শীর্ষ আদালতের রায়ের পরে এই উপাচার্যদের নিয়োগ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। তাঁর উপাচার্যদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য নেই।
সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন, রাজ্যপাল দেশের প্রচলিত আইন ও ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করছেন। কেউ তাঁর মর্জি মতো বেআইনিভাবে পদক্ষেপ করলে তার অর্থ এই নয় যে তাঁর আদেশ কার্যকর করা হবে। রাজ্যপালের আকস্মিক পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজ্যপাল কোন এক সুপ্রভাতে বললেই আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোনও ব্যক্তি উপাচার্যের পদ থেকে সরে যেতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তখনই অপসারণ করা যেতে পারে যদি ব্যক্তি অর্থের অপব্যবহার করে থাকেন এবং খারাপ আচরণ করে থাকেন। এই অভিযোগগুলি উচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের দ্বারা তদন্ত করা উচিত।
পিনারাই বিজয়ন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির গণতান্ত্রিক রীতি মেনে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা। রাজ্যপালের পদক্ষেপগুলি সরকার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করার সমান। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কেউই এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন না। গভর্নরের পদ যা ঔপনিবেশিক যুগের একটি পণ্য, তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি নয়। তাই সংবিধান দ্বারা রাজ্যপালকে প্রদত্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণের উদ্দেশ্য রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে হবে।
সিপিআই(এম) কেরালা রাজ্য কমিটির সম্পাদক এমভি গোবিন্দন বলেন, রাজ্যপালের সংবিধান বিরোধী এই পদক্ষেপের সর্বতোভাবে বিরোধিতা করবে রাজ্য সরকার এবং পার্টি। কেরালায় বিজেপি-আরএসএস সরাসরি ক্ষমতা দখল করতে না পেরে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে বিরোধিতা করা হবে। একই সঙ্গে প্রচার চালানো হবে। গড়ে তোলা হবে গোটা রাজ্যে লাগাতার আন্দোলন। এলডিএফ’র ডাকে আগামী ১৫ই নভেম্বর রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে।