৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯
ত্রিপুরায় প্রত্যয়ী জনগণের সুবিশাল সমাবেশে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাবার শপথ
সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন সীতারাম ইয়েচুরি।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি ত্রিপুরার আগরতলায় লালঝান্ডার জনপ্লাবিত সমাবেশ ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়দৃপ্ত বার্তা দিয়েছে। শাসক বিজেপি’র শত যড়যন্ত্র, প্ররোচনা, হুমকি ও নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে ত্রিপুরার সংগ্রামী জনগণ ২১ অক্টোবরের সমাবেশকে সাম্প্রতিককালের সর্ববৃহৎ সমাবেশে পরিণত করেছেন। ধর্মনগর থেকে সাব্রুম - হাজার হাজার মানুষ লালঝান্ডা নিয়ে সিপিআই(এম)’র ডাকা এই সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিজেপি জোট সরকারের দুঃশাসনের অবসানের সংকল্প নিয়ে সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন।
এদিনের এই জনকল্লোলিত সমাবেশকে কুর্নিশ জানিয়ে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আহ্বান রেখেছেন, ভারতকে বাঁচাতে হলে বিজেপি’কে পরাস্ত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জোটবদ্ধ হওয়া জরুরি।
ত্রিপুরার লড়াকু জনগণকে অভিনন্দিত করে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য ও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেছেন, জয় আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সমস্ত ষড়যন্ত্র, অত্যাচারকে মোকাবিলা করে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে গেলে মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। তিনি ত্রিপুরায় জনতার সরকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অবস্থান নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী গণতান্ত্রিক পথে রাজ্যের বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারকে উপড়ে ফেলার আহ্বান জানান।
সমাবেশের সভাপতি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঘোর দেববর্মা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, ত্রিপুরার জাতি-উপজাতিসহ বিভিন্ন অংশের মানুষই শেষ কথা বলবেন। ফ্যাসিবাদ শেষ কথা বলে না।
বিজেপি জোট সরকারের প্রায় ৫৫ মাসের শাসনে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত রাজ্যের মাটি। এদের ফ্যাসিস্টধর্মী শাসন কেড়ে নিয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। আক্রান্ত বামপন্থী আন্দোলনের অসংখ্য নেতা, কর্মী ও সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ। আক্রান্ত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, সরকারি কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স সহ বিভিন্ন অংশের মানুষ। এমনকী এই শাসনে নিরাপদে নেই পুলিশও। লুঠতরাজ, জরিমানা আদায়, বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, জীবিকা কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পাহাড় কাঁদছে। বড়মুড়া, আঠারো মুড়া, লংতরাই, শাখান, কালাঝারি প্রভৃতি অঞ্চল জুড়ে খাদ্যের জন্য উপজাতি মানুষের হাহাকার। শহর, মফস্সল, গ্রাম, পাহাড় - সর্বত্র শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, বিদ্যুতের সমস্যায় দুর্বিষহ মানুষের জীবন। বেকারদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন উধাও। চাকরিচ্যুত ১৪৩ জন শিক্ষকের মৃত্যু রাজ্য সরকারের কাছে নিছক একটি সংখ্যা। এমনই এক ভয়াবহ দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে মানুষ যেন মুখিয়েই ছিলেন স্বৈরাচারী বিজেপি-কে প্রত্যাঘাতের জানান দিতে। তাই এদিন শাসকদল ও সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে দৃপ্ত সমাবেশ সংগঠিত করলেন ত্রিপুরার সংগ্রামী মানুষ।
সিপিআই(এম)’র ডাকা এই সমাবেশ যে রাজধানী আগরতলার বুকে জনপ্লাবন তৈরি করবে তার আভাস মিলছিল বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। তাই শাসকদল ও সরকারের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছিল নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও নানাভাবে বাধা তৈরি করা। তাই বিভিন্ন মহকুমায় পরিবহণ মালিক ও চালকদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল ২১ অক্টোবর বেলা ২টা পর্যন্ত গাড়ি নামানো যাবে না রাস্তায়। দোকানে, বাজারে, বাস স্টপে চলছিল বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের নজরদারি। এমনকী চক্রান্ত করে কমিয়ে দেওয়া হয় রেলের কামরা। আগরতলা রেল স্টেশন থেকে বন্ধ রাখা হয় সমস্ত রেল চলাচল। ষড়যন্ত্র করে চড়িলামে রাস্তা অবরোধ করা হয় কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে। এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে হাজার হাজার মানুষ আসেন স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে। সমাবেশের আগের রাতেই আগরতলা শহরে চলে আসেন হাজারো মানুষ। প্রচণ্ড দাবাদাহের মধ্যে দীর্ঘ পথ হেঁটে মানুষ এসেছেন সমাবেশে। জানকবুল লড়াইয়ের মনোবল নিয়ে দীর্ঘ পথচলাতেও কোনো ক্লান্তি আসেনি। তাদের মধ্যে জাগ্রত ছিল লড়াইয়ের অঙ্গীকারে স্বতঃস্ফূর্ত ও সতেজ মনোভাব। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সংগ্রাম-দৃপ্ত মানুষের সমবেত প্রচেষ্টাতেই এদিনের সমাবেশ জনসমুদ্রের রূপ নেয়। সমাবেশ শুরুর অনেক আগে থেকেই একের পর এক রক্তপতাকার উদ্বেলিত মিছিল গর্জে উঠেছে দৃপ্ত স্লোগানে।
মানুষের এই সংগ্রামী মেজাজকে অভিনন্দিত করে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, বিজেপি সরকার আপনাদের আটকাতে শত চেষ্টা করেছে, তাসত্ত্বেও আপনারা হাজার হাজার সংখ্যায় এসেছেন। বর্তমানে রাজ্যে যে পরিস্থিতি চলছে তারজন্য এটাই সমাধান। আসন্ন নির্বাচনেও এটাই হবে অন্যতম পথ। তিনি গোটা দেশে বিজেপি’র বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ, বড়ো বড়ো পুঁজিপতিদের স্বার্থে কোটি কোটি টাকা ঋণ মকুব সহ তাদের অবাধ লুঠের সুযোগ করে দেওয়া, দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবার নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ত্রিপুরার জনগণ এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে - এই কুশাসন চলবে না। আগামীদিনে জনগণের রাজত্ব কায়েম হবে - এই বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পার্টির নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মানিক সরকার বলেন, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে উপজাতি-অউপজাতি অংশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যে তাৎপর্যমণ্ডিত ঐতিহ্য পলে পলে গড়ে তুলেছিলেন ত্রিপুরার বুকে, ৫৫ মাসের দুঃশাসনে তা ধ্বংস করেছে - শ্মশানের কিনারায় নিয়ে গেছে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার। এই দুর্বিপাক থেকে ত্রিপুরাকে উদ্ধার করতে বামপন্থী ফ্রন্ট সহ ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সমস্ত শক্তিকে দল-মত সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ত্রিপুরার ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও দাবিগুলি নিয়ে লড়াই-সংগ্রামের জন্য শুধু সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্টই নয়, ত্রিপুরার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলছে, যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদেরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। এটাই এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস এই প্রশ্নে ত্রিপুরার মানুষ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে কার্যকর ভূমিকায় নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবেন।
জীতেন্দ্র চৌধুরী তাঁর ভাষণে বিজেপি সরকারের প্রথম বছরে ৫০ হাজার চাকরির ভুয়ো প্রতিশ্রুতি, শিক্ষক-কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে বেতন-ভাতা না পাওয়া, শ্রমিক-কৃষক, দিনমজুর, বেকার যুবকদের সাথে প্রতারণা ও তাঁদের দুর্বিষহ অবস্থার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রেগা, টুয়েপে (টাউন এমপ্লমেন্ট প্রজেক্ট) লুণ্ঠন ও দুর্নীতির হাত থেকে ত্রিপুরাকে বাঁচাতে এবং গ্রাম-শহরের গরিব-শ্রমজীবী মানুষের অন্তত দু’বেলা ভাতের নিশ্চয়তা দিতে হলে এই সরকার থাকলে হবে না। তিনি পার্টির জনসভা আটকাতে রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজবিরোধীদের ব্যবহার করা সহ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, তিনি আগের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের থেকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অনেক বেশি অপরাধ করে ফেলেছেন। পরিশেষে তিনি রাজ্যকে বাঁচাতে সমস্ত অংশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
সভাপতির ভাষণে অঘোর দেববর্মা বলেন, কণ্ঠরোধ করে, গণতন্ত্র হরণ করে মানুষকে আটকে রাখা যায় না। গণতন্ত্রে শেষ কথা ফ্যাসিবাদ বলে না। এই সমাবেশ সেই বার্তাই দিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে আমরা শামিল হয়েছি। সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই আমাদের লড়াই করতে হবে।