E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯

মালদহ-মুর্শিদাবাদে গঙ্গা ভাঙনের জন্য দায়ী কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি উদাসীনতা

প্রতিবাদে শামিল আছে লালঝান্ডাই


কালিয়াচক ৩ ব্লকের পারলাল পুরে ভাঙনের কবলে গঙ্গাতীরবর্তী মন্দির।

‘‘এক দুঃখের দুখী আমি, গাঙের কূলে বাড়ি’’ - বাংলার এই প্রবাদের অংশটি ভাঙন পীড়িত মানুষদের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে। নদীর পাড়ে চিরায়ত নিয়ম নদীর এক পাড় ভাঙে আর এক পাড় গড়ে। মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষের অভিজ্ঞতা নদীর এক পাড়ই ভাঙছে। এই লেখাটির মূল আলোচ্য বিষয় প্রায় পাঁচ দশক ধরে গঙ্গা নদীর ভাঙন-ভূমিক্ষয়, তারজন্য উদ্ভূত সমস্যা, জনজীবনে ভয়ঙ্কর প্রভাব, নদীর গতিপ্রবাহের ব্যাপক পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষের ভূমিহীন-বাস্তুহীন হওয়া। সমাধানের পথ - সর্বোপরি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দায়িত্ব ও করণীয়। বিশেষ করে গঙ্গা জাতীয় নদী - কেন্দ্রের সরকারের দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়গু‍‌লির অবতারণা।

অতীতের ইতিহাস বলে, গঙ্গা নদীর গতিপথ রাজমহল থেকে ফারাক্কা যা নদীর নিম্নগতি মোটামুটিভাবে সোজাসুজিভাবে প্রবাহিত হতো। পরবর্তীতে নদীর গতি পথে পলি সঞ্চয় - চর তৈরি হওয়ায় নদীর সর্পিল পথের সৃষ্টি হয়। ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পরে এই সর্পিল পথ বাড়তে থাকে। ফারাক্কা ব্যারেজের উজানে মালদার দিকে বাম তীর জুড়ে তীব্র ভাঙন হতে থাকে। আর তার ওপারে মুর্শিদাবাদে ডানদিকে ভাঙন ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির শুরুতে পরিকল্পনাহীন ও ত্রুটিপূর্ণ বলে জনৈক নদী বিশেষজ্ঞ যে ভবিষ্যতের কথা বলেছিলেন, তৎকালীন সময়ে সেই বিতর্কিত মন্তব্যে আজ ভাঙন পীড়িত মানুষ যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন। গঙ্গা নদী ভূতনী চরের কাছে প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার প্রসারিত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতবড়ো নদীকে ব্যারেজ দিয়ে আটকালে তার পরিণাম কী হতে পারে? ভাঙন পীড়িত মানুষদের অভিজ্ঞতা ভয়ংকর। ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকারের জনহিতকর, বহুমুখী উদ্দেশ্যে নির্মিত হ‍‌য়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সড়ক ও রেল যোগাযোগ, কলকাতা বন্দরে ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে জল সরবরাহ করা, এনটিপিসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহ, আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে জল সরবরাহ ইত্যাদি। এর উপযোগিতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু‍‌ ভাঙন পীড়িত মানুষদের অভিজ্ঞতা কখনই সুখকর নয়।

ভাঙনের ভয়বহতা যে জায়গায় পৌঁছেছে তা একটু‍‌ চিত্র দিলে স্পষ্ট হবে। ভূতনীর কাছে গঙ্গা ও ফুলহার নদীর মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। গঙ্গা ও ফুলহারের মাঝখানে রতুয়ার কাটাহা দিয়ারা চর। আবার ফুলহার মানিকচকের পশ্চিম নারায়ণপুরে গঙ্গায় মিলেছে। গঙ্গা বামদিকে ভাঙতে ভাঙতে এমনভাবে ধেয়ে আসছে তাতে পাশেই ফুলহার নদীর খাতে মিশে গেলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে। এমনকী মালদা জেলার ভৌগোলিক চিত্রের পরিবর্তনের আশঙ্কা প্রবল। সময় থাকতে দুই নদীর ভাঙনে স্থায়ী রোধের ব্যবস্থা না নিলে তাদের মিলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। উল্লেখ্য, ফারাক্কা ব্যা‍‌‍‌রেজ নির্মাণের পর থেকে মালদহ জেলায় ৬৭টি মৌজা, ১ লক্ষ হেক্টর চাষযুক্ত জমি গঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেছে। আনুমানিক সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণভাবে এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ভূতনীতে ভাঙনের কবলে গ্রামীণ জনপদ। ছবিঃ লেখক

এমনিতেই ষাটের দশকের প্রথমদিকে মালদা জেলার কালিয়াচক-২ ব্লকের পঞ্চানন্দপুরে ভাঙন প্রথম শুরু হয়। ক্রমশ তা দশকের পর দশক প্রসারিত হতে থাকে। গঙ্গা ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করে আশির দশকে। মালদা জেলার ১৫টি ব্লকের মধ্যে সাতটি ব্লক আক্রান্ত। লক্ষ-লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভাঙনের কারণে ঘর বাড়ি, কৃষিজমি, আমবাগান, হাট-বাজার, প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, পোস্ট অফিস, মন্দির-মসজিদ, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সবকিছু গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে গেছে। মানুষ নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাতারাতি ভূমিহীন, বাস্তুহীন মজুরে পরিণত হয়েছেন। নদী-পার্শ্ববর্তী বাঁধে, রাজ্য সড়কের ধারে, খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। বাবু প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন সবাই নিমেষে হারিয়ে গেছে। চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। অথচ বর্তমান তৃণমূল সরকার ও প্রশাসন নির্বিকার। কোথাও কোথাও স্থানীয় জনগণ, কিছু বেসরকারি সংগঠন আমাদের ছাত্র-যুব সংগঠনের কর্মীরা, রেড ভলেন্টিয়াররা সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াচ্ছেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত কাটমানি আর তোলাবাজিতে ব্যস্ত। রাজ্য সরকার ব্যস্ত খেলা-মেলা-উৎসবে। বামফ্রন্ট সরকার প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়াত - আজ তা অতীত। কিন্তু ভাঙন-পীড়িত মানুষের আর্তনাদ কতদিন চাপা থাকবে! কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জে মাননীয়া সেচ প্রতিমন্ত্রীকে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে। স্থায়ী প্রতিরোধ, পুনর্বাসন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ কোনো কিছুতেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বা রাজ্য সরকারের কোনো হেলদোল নেই।

গঙ্গা নদীকে নিয়ে মোদি সরকার সুকৌশলে ধর্মের আবেগ তৈরি করতে চাইছে। ‘নমামী গঙ্গে’ প্রকল্পে কোটি-কোটি টাকা (প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা) বরাদ্দ করে কিছু সৌন্দর্যায়ন করে লুঠ করা হচ্ছে। আসল সমস্যাকে আড়াল করা হচ্ছে। গঙ্গা জাতীয় নদী। নদীর জল, বিভিন্ন জায়গায় ব্যারেজ ব্যবহার করে কেন্দ্রের সরকারের কোটি-কোটি টাকা আয় হচ্ছে। অথচ ভাঙন পীড়িত মানুষদের পুনর্বাসনে পাশে দাঁড়াচ্ছে না। ভাঙন রোধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ভাঙন প্রতিরোধের নামে রাজ্য সরকার বালির বস্তা ফেলে কোটি-কোটি টাকা নয়ছয় করছে - কাটমানিতে যাচ্ছে। পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা রাজ্য সরকার করছে না। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুর্শিদাবাদে প্রশাসনিক সভায় বক্তব্যে গঙ্গার ধারে বাড়ি না করার পরামর্শ সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা না উদাসীনতা?

অতীতে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গঙ্গানদীর ভাঙনের বিষয় নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। গঙ্গা ইরোশন কমিটি (Ganga Erossion Committee) তৈরি করে ভারত সরকারের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন (Central Water Commission)-এর সদস্য (Flood) প্রীতম সিং ড্রেজিং, নদীখাত খনন, গভীরতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য অনেকগুলি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তৎকালীন কেন্দ্রের সরকার সেই প্রস্তাবের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি। কমিটির আরও সুপারিশ অর্থের বরাদ্দের অভাবে গ্রাহ্য হয়নি।

২০০৪ সালে বিধানসভায় সর্বদলীয় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবে‍গৌড়া কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে আপ ও ডাউনে প্রায়‍‌ ৮০ কিলোমিটার করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি ফারাক্কা ব্যারেজের কিছু কাজে অগ্রগতি ঘটায়। বিজেপি সরকার কমিয়ে মালদহে ১২ কিলোমিটার, মুর্শিদাবাদে ৮ কিলোমিটার করেছে। কিন্তু কোনো কাজ করেনি। অন্যদিকে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার তার জন্মলগ্ন থেকে ভাঙন-পীড়িত মানুষদের পুনর্বাসনে কলোনি তৈরি, ভেস্ট জমির পাট্টা প্রদান সহ নানান কাজে উদ্যোগী হয়। ২০০৬ সালের পরবর্তী সময়ে নিজভূমি নিজগৃহ প্রকল্পে জমি কিনে দেওয়ার মতো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। আজ সেগুলি কল্পনাতীত।

আজ তাই ভাঙন-পীড়িত মানুষদের দাবি - ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের অব্যবহৃত জায়গায় পুনর্বাসন দিতে হবে। কোশি ও ফুলহার নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের রাজ্য সরকারের অধীনে মহানন্দা ও এমবাংকমেন্ট সেচ দপ্তরের অধিগৃহীত অব্যবহৃত জমিতে পুনর্বাসন দিতে হবে। জমি কিনে গৃহ নির্মা‍‌ণের ব্যবস্থা করা, অতীতে যেমন হয়েছে কলোনি তৈরি করা। দুই সরকারের কাছে দাবি উঠছে - ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ল্যান্ড লুজার হিসাবে চিহ্নিত করে এক্সামটেড সার্টিফিকেট প্রদান সহ চাকরির সু‍যোগ রাখতে হবে সরকারকে।

বামপন্থীরা মানুষের এই ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে লাগাতার আন্দোলনে শামিল রয়েছেন। অতীতে লোকসভা ও বিধানসভায় সমস্যা উত্থাপন করা, বামপন্থী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিল্লিতে কেন্দ্রের সরকারের কাছে দাবি তোলা, ভালুকা থেকে কলকাতা পদযাত্রায় মানুষকে শামিল করা, কলকাতা ও দিল্লিতে সমাবেশ, ইউ‍‌পিএ সরকারের কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, বামফ্রন্ট সরকারের ভাঙন-পীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো - এই লড়াইয়ের ইতিহাস আমাদের আছে।

বর্তমানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে মানুষ লালঝান্ডা নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। ভাঙন-পীড়িত মানুষদের দাবি নিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ, রাজ্য সড়ক অবরোধ, আইন অমান্য, ফারাক্কা জেনারেল ম্যানেজারের কাছে ডেপুটেশনে মানুষকে লালঝান্ডা নেতৃত্ব দিয়েছে। অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, কেড়ে নিতে হয়। নভেম্বর মাসব্যাপী গ্রামে গ্রামে দাবিগুলি উত্থাপিত হবে। অন্যান্য অংশের মানুষের দাবির সাথে ভাঙন-পীড়িত মানুষদের দাবি উচ্চারিত হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে ‍শেষ দেখে ছাড়বো - এই লড়াই লড়তে হবে আমাদের। আর তার নেতৃত্ব দেবে লালঝান্ডা।