৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯
ফিরে দেখা - বাম আমলের পঞ্চায়েত
সুপ্রতীপ রায়
ইতিমধ্যেই আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে আসন বিন্যাস সংক্রান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। যদিও তৃণমূলের আমলে নির্বাচন অবাধ ও গণতান্ত্রিকভাবে হবে এমন আশা করা ঠিক নয়। ২০১৩ সাল থেকে রাজ্যের মানুষ তা দেখছেন।
কিন্তু ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যা চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার সেটি যে গ্রামীণ মানুষের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাম আমলে পঞ্চায়েত শুধু একটি আইনের বিধানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। পঞ্চায়েত একটি বৃহত্তর গণ আন্দোলনের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল। যে আন্দোলন সকলকে যুক্ত করে স্থায়ী উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিল।
১৯৭৮ সালে প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে উন্নয়নমুখী করার চেষ্টা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত আইনের নানা সংশোধনীর মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবনে সামাজিক পরিবর্তন এনেছিল।
বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলিতে নজর দিয়েছিল সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলঃ দায়িত্ব ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা, পঞ্চায়েত সদস্যদের দায়বদ্ধতা। উন্নয়নের কাজগুলি বিশেষ কোনো ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল না। সবাইকে নিয়ে কাজ করার প্রবণতা ছিল। কাজের মধ্যে ছিল স্বচ্ছতা। পঞ্চায়েত তার কাজের জন্য ক্ষমতার মূল উৎস জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ছিল।
আমাদের রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল আইন ১৯৭৩ সালের হলেও এই আইনে দৃষ্টিভঙ্গি, কাঠামোগত ও প্রয়োগ-সংক্রান্ত ব্যাপক পরিবর্তন আনতে গিয়ে বারংবার সংশোধন করা হয়। প্রধান সংশোধনীগুলি কার্যকর হয় ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৪, ২০০৩, ২০০৫ সালে। বাম আমলে পঞ্চায়েত আইনের বিভিন্ন সংশোধনগুলি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। বিকেন্দ্রীকরণের প্রভাব পড়েছিল সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতিতে। বামফ্রন্ট সরকারের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যা থেকেই তৈরি হয়েছিল উন্নয়নের অভিমুখ। গরিব, প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে নজর দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে কমেছিল সামাজিক অস্থিরতা। গ্রামগুলিতে কমেছিল মামলা মোকদ্দমা, গ্রামীণ বিবাদের মীমাংসা করেছিল পঞ্চায়েত। এরফলে মামলার খরচ কমেছিল এবং কমেছিল হয়রানি। উন্নত হয়েছিল পারস্পরিক সম্পর্ক।
গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী, বিকেন্দ্রীকৃত, দায়বদ্ধ, সহভাগী, আরও সক্রিয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ পন্থা রচিত ও রূপায়িত হয়েছিল, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতগুলি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছিল এবং গ্রামীণ মানুষের সক্ষমতা বেড়েছিল। গরিব মানুষের স্বার্থে বিকেন্দ্রীকৃত ও সহভাগী পরিকল্পনা রচিত, রূপায়িত ও তদারকির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পঞ্চায়েতের সব স্তরে আরও বেশি সম্পদ সংগৃহীত হয়েছিল এবং স্থানীয় এলাকার বিশেষত গরিব মানুষের উন্নয়নে তার সদ্ব্যবহার হয়েছিল।
বামফ্রন্ট সরকার গ্রামীণ ক্ষেত্রে যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতি গ্রহণ করেছিল তা নিছক কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য ছিল না। “কিন্তু ভূমিসম্পর্কের পরিবর্তনই সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্কগুলির নিরসনে শেষ কথা নয়। এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, গ্রামীণ জীবনে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের সংগ্রাম। বামফ্রন্ট সরকারের দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সারা দেশের ও বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হলো গ্রামীণ সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের সংগ্রাম। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ভূমিসম্পর্কের পরিবর্তন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে। জমি ও গণতন্ত্রের লড়াই এক এবং অবিচ্ছেদ্য। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে সাফল্য এসেছে তা এই দুইয়ের মিশ্রণে সম্ভব হয়েছে।ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্ক ও কায়েমি স্বার্থের মূলে তীব্র আঘাত হেনেছে। এই দুই কর্মসূচি একদিকে যেমন কৃষকের আর্থিক ক্ষমতা বাড়িয়েছে, একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে। যার ফলে হয়েছে গ্রামীণ গরিব মানুষের চেতনার বিপুল পরিবর্তন।” (পৃষ্ঠাঃ ১৪-১৫: আমরা চলি সমুখ পানে/ তথ্য ও সংষ্কৃতি বিভাগ-পশ্চিমবঙ্গ সরকার)।
বাম আমলে গ্রামীণ উন্নয়নের প্রায় সবক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত যুক্ত। দারিদ্র্য-দূরীকরণ কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ, উন্নয়ন ইত্যাদি কাজগুলি পঞ্চায়েত সরাসরি সম্পন্ন করে। ক্ষুদ্র সেচ, জনস্বাস্থ্য, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা সব কাজই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর এসবই সম্ভব হয়েছিল বিকেন্দ্রীকরণের পথ ধরে।
বামফ্রন্ট সরকার অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে গ্রামসভা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময় গ্রামসভা নিছক প্রতীকী সংস্থা ছিল না। গ্রামসভাগুলি হয়ে উঠেছিল গ্রামের সমস্ত ভোটারের প্রতিনিধিত্বের মঞ্চ। গ্রাম পঞ্চায়েতের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করতে গ্রামসভার হাতেই গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি রূপায়ণের ওপর নজরদারির দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল।
নিজেদের গ্রামের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিকদের মতামত জানানোর সুযোগ করে দিয়েছিল গ্রামসভা। গ্রামবাসীরা নিজেদের সমস্যা তথা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানাতে পারতেন। নিয়মিত গ্রাম সভার বৈঠক আহ্বান করা হতো, বৈঠকে সুসমঞ্জস আলোচ্যসূচি থাকত। গ্রামাঞ্চলের দুর্বলতর জনগোষ্ঠী তাদের মতামত খোলাখুলিভাবে জানাতে পারতেন। গ্রামসভা সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার ফলে পঞ্চায়েত প্রধানরা নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে পারতেন না। গ্রামবাসীরা তাদের সমালোচনা করতে ভরসা পেতেন। গ্রামসভা গঠনের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার ফলে পঞ্চায়েত স্থানীয় গণতান্ত্রিক প্রশাসনের এক কার্যকর ও প্রাণবন্ত মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। বামফ্রন্টের সময় গ্রামসভাগুলির নিয়মিত বৈঠক হওয়ার ফলে গ্রাম সংসদের প্রতি গ্রামবাসীদের আস্থা বেড়েছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় গ্রামসভাগুলি সজীব হয়ে উঠেছিল। এর পিছনে যে কারণগুলি ছিল সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলঃ গ্রামসভার ক্ষমতাবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল, গ্রামসভায় অংশগ্রহণের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা হতো, গ্রামসভার সভাগুলি এমনভাবে পরিচালিত হতো যাতে পরবর্তী সভায় আসার উৎসাহ মানুষের তৈরি হতো, গ্রামের সমস্ত শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ সুনিশ্চিত ছিল, সবার বক্তব্য যথাযথ গুরুত্ব সহকারে শোনা হতো, কাজকর্মে বা মতামতের আদানপ্রদানে স্বচ্ছতার সঙ্গে সঙ্গে নমনীয়তাও ছিল। এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকল্প চয়নের বিষয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতকে পরামর্শ প্রদান করত।
জনদরদি বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই ১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইনের ২২তম সংশোধনের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলায় গ্রাম সংসদ স্তরে গঠন করা হয় গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। গ্রাম উন্নয়ন সমিতি এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রাম সংসদকে সহায়তা করত।গ্রাম সংসদের তৈরি পরিকল্পনাই ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিকল্পনার ভিত্তি। গ্রামবাসীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে গ্রাম সংসদ এলাকার চাহিদাগুলিকে শনাক্ত করা হতো। গ্রাম সংসদকে কেন্দ্র করে সামাজিক সুযোগগুলি সম্প্রসারিত হয়েছিল। সংবেদনশীলতা ছিল পঞ্চায়েত পরিচালনার অন্যতম লক্ষ্য। গ্রামবাসীদের বাড়ির উঠোনে গণতন্ত্রকে পৌঁছে দিয়েছিল। পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারই ভারতের মধ্যে প্রথম তৈরি করেছিল গ্রাম সংসদ গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনী ক্ষেত্র। গ্রাম সংসদের সভাগুলিকে ঘিরে উৎসবের পরিবেশ রচিত হতো।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতগুলি এলাকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পঞ্চায়েতের সংগৃহীত সম্পদ নিজস্ব এলাকার উন্নয়নেই খরচ হতো। নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহে পঞ্চায়েতগুলি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। পঞ্চায়েতের কাজে গতি আনার জন্য সরকার যে অর্থ প্রদান করত তা যাতে দ্রুত পঞ্চায়েতের তহবিলে জমা পড়ে তার জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে সরাসরি পঞ্চায়েতের ব্যাংক আ্যাকাউন্টে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। সমস্ত স্তরেই সরকারি নিয়মমাফিক হিসাবপত্র পরীক্ষা করার ব্যবস্থাও হয়েছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও মজুরি বৃদ্ধি ঘটেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময় পশ্চিমবঙ্গে অকৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল এবং একইসঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম একদশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা ছিল ভারতের মধ্যে সর্বাধিক। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ৫.৭ শতাংশ হারে বেড়েছিল, ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৪.৮ শতাংশ। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলিতে সৃষ্ট শ্রমদিবসের পরিমাণ বেড়েছিল।একশো দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রকল্পের সফল রূপায়ণে পঞ্চায়েতগুলির ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। যেমন ২০০৬-০৭ আর্থিকবর্ষে এই প্রকল্পে নথিভুক্ত পরিবারের সংখ্যা ছিল (৫১.৪ লক্ষ) এবং এদের মধ্যে কাজ চেয়েছেন এমন পরিবারের সংখ্যা (৩২.৩৫ লক্ষ), যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক ছিল। এর মধ্যে কাজ পেয়েছিলেন ৩০.৮৩ লক্ষ পরিবার।
শিক্ষার অঙ্গনে গ্রামীণ পরিবারের মানুষদের আনার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের বিশেষ ভূমিকা ছিল। শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা হয়েছিল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতিতে পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে নজিরবিহীন সাফল্য এসেছিল। “এই অসামান্য নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করা কোনমতেই সম্ভব হতো না - যদি এই কাজের সঙ্গে পঞ্চায়েতকে যুক্ত না করা হতো। একদিকে শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন কর্মসূচি জনগণের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে করা হচ্ছে - অন্যদিকে পঞ্চায়েত তার নিজস্ব উদ্যোগে নিজস্ব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার ধারাকে বহুমুখী ও বেগমান করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।গ্রামের দিনমজুর, খেতমজুর, ভাগচাষি, ছোটো কৃষক, গরিব কারিগর ও অন্যান্য - শ্রমজীবী মানুষের ঘরেই নিরক্ষরতা প্রধানত বাসা বেঁধে আছে। পঞ্চায়েত তার বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণের সাহায্যে কোটি কোটি শ্রমদিবস সৃষ্টি করে চলেছে - এর ফলে কোটি কোটি টাকা গ্রামের এই নিঃস্ব মানুষের হাতে যাচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন প্রকার খেটে খাওয়া মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে চলেছে পঞ্চায়েত - কোথাও সরাসরি অনুদান - কোথাও সহজ শর্তে ঋণদান। এর ফলে এই অংশের মানুষের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে - একাধিক সমীক্ষায় এই সত্য বেরিয়ে আসছে। সেই কারণে শিক্ষার প্রতি আগ্রহের জন্য এই সব পরিবারের সন্তান-সন্ততি অধিক সংখ্যায় বিদ্যালয়ে আসছে এমন বহু পরিবার আছে - যাদের সন্তান এই প্রথম বিদ্যালয়ে আসতে পারল।...” (শিক্ষার অঙ্গনে পঞ্চায়েতের অবদানঃ কান্তি বিশ্বাস / গণশক্তিঃ ১০.২.৮৮)
পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলি শিশু শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করেছে। বালক, বালিকা যারা নানা কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতে পারত না তাদের জন্য খোলা হয়েছিল শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। খোলা হয়েছিল মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র। শিক্ষা প্রদানের কাজে যুক্ত শিক্ষা সহায়িকা, সহায়কদের, শিক্ষা সম্প্রসারকদের মর্যাদা দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।
জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি রূপায়ণে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলির সক্রিয় ভূমিকা থাকার কারণে গ্রামীণ মানুষের গড় আয়ু বেড়েছিল। রাজ্যের সমস্ত গ্রামীণ পরিবার, ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্যবিধিসম্মত আধুনিক শৌচাগারের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সুবিধা দিতে সমস্ত জেলাতেই সার্বিক স্বাস্থ্য বিধান প্রকল্প চালু হয়েছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন ও প্রতিষেধক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য পঞ্চায়েত উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
গ্রামীণ মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতগুলি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকার দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবার থেকে সদস্য বা সদস্যা নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়েছিল। দরিদ্র পরিবারগুলি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আয় বাড়াতে পেরেছিলেন। স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন এক আন্দোলনের পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে স্বনির্ভরগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩লক্ষ ৮০হাজার। ২০১০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লক্ষাধিক। বাম আমলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সাফল্যের ফলেই গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছিল।
গ্রামাঞ্চলে মজুরি বৃদ্ধির ফলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল, বেড়েছিল ক্রয়ক্ষমতা। আর্থিক উন্নতির প্রভাবে গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের জন্য ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটেছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মানবোন্নয়ন সূচক উন্নত হয়েছিল। মহাজনি ঋণের ফাঁদ থেকে কৃষককে মুক্ত করার জন্য পঞ্চায়েতের সদর্থক ভূমিকা ছিল। ঋণের সুদে কৃষকের ভিটেছাড়া হওয়া বন্ধ হয়েছিল বাম আমলে।
বাম আমলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার ফলে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল গ্রামীণ শিল্পায়নে। ২০০০-০৩ সালের মধ্যে ১২,৩০০ ছোটো ও মাঝারি কলকারখানা গড়ে ওঠে এরাজ্যের গ্রামাঞ্চলে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার যখন তার যাত্রা শুরু করে তখন রাজ্যের অর্থনীতির হাল ছিল করুণ। ২০১১ সালে যখন বিদায় নিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার তখন অর্থনৈতিক অবস্থার কয়েকগুণ উন্নতি ঘটে গেছে। এটা হঠাৎ করে ঘটেনি। শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাম আমলের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।
১৯৭৮ থেকে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নীরবে গ্রামীণ উন্নয়নে বিপ্লব ঘটেছে। এ উন্নয়ন ছিল স্থায়ী, টেকসই। তবে চটকদারি বা বিজ্ঞাপন সর্বস্বতা ছিল না। বাম আমলে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির আওতায় থাকা এলাকায় সার্বিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়েছিল। শুধু পরিকাঠামোগত বিকাশ নয় - সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং গোষ্ঠীগত বিকাশও সম্ভব হয়েছিল। গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এলাকার মানুষজনকে শামিল করা হয়েছিল। বামফ্রন্টের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিষয়ক নীতির ফলে স্থানীয় অঞ্চলে জন পরিষেবা প্রদানে দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটেছিল এবং স্থানীয় স্তরের প্রশাসনে দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
মূল ধারার মিডিয়াতে এই সাফল্য কখনই তুলে ধরা হবে না। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সাফল্যকে অপপ্রচার করেও চাপা দেওয়া যাবে না।