৬০ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৮ অক্টোবর, ২০২২ / ১০ কার্ত্তিক, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (ছয়)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
চেতনা
● মানুষের মস্তিষ্ক হলো বস্তুরই একটি রূপ। শুধুমাত্র একটি রূপই নয়, মস্তিষ্ক হলো বস্তুর সর্বাপেক্ষা সংগঠিত ও সর্বোচ্চ রূপ। মস্তিষ্কের কার্যধারার ফল হলো চেতনা-চিন্তা। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানিয়েছে, কীভাবে মস্তিষ্ক কাজ করে। অসংখ্য রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক ও বিদ্যুৎ চুম্বকীয় প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে। মস্তিষ্কের কাজের পরিণতি হলো চেতনা। বহির্জগতের বাস্তবতা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। বহির্জগতের বাস্তবতা এবং মস্তিষ্কে তার প্রতিফলন, এই আন্তঃসম্পর্কই মানব চেতনার ভিত্তি। মস্তিষ্ক ব্যতিরেকে কোনো চিন্তা, ধারণা, আদর্শ, মতবাদ কোনো কিছুই গড়ে ওঠে না। চেতনার ভিত্তি যে বস্তু একথা তো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যে মস্তিষ্ককে আশ্রয় করে চেতনা তা তো বস্তুরই সুউচ্চ রূপ। চেতনাকে আশ্রয় করেই জ্ঞান গড়ে উঠেছে।
জ্ঞান
● হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি জগতের বুকে নিজের অস্তিত্ব সুরক্ষিত ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে মানবসমাজের সংগ্রাম চলেছে। এই সংগ্রামের ধারাতেই মানব স্নায়ুতন্ত্রের ক্রমান্বয়ে বিকাশ ঘটেছে। স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে মস্তিষ্কেরও বিকাশ ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলেছে। মস্তিষ্কেরও বিকাশের ফলে মানব চিন্তন প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। চিন্তন প্রক্রিয়ার অগ্রগতির অর্থ হলো জ্ঞান অর্জন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি। মানুষের ক্রিয়া অর্থাৎ ব্যবহারিক কাজ (practice) কে ভিত্তি করে জ্ঞান গড়ে ওঠে ও তার বিকাশ ঘটে। মানুষ ও প্রকৃতি জগতের নিরন্তর আন্তঃসম্পর্কই মানব অস্তিত্বের ভিত্তি। মানুষ ও প্রকৃতির এই আন্তঃসম্পর্ককে কেন্দ্র করেই মানুষের ব্যবহারিক কাজ তথা ক্রিয়া পরিচালিত হয়। প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। ব্যবহারিক কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করে। এই হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে জ্ঞান (knowledge) সম্ভব হয়। চিন্তাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জ্ঞান মানুষকে আরও বেশি কার্যকরভাবে ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকৃতির ওপর ক্রিয়া করতে সক্ষম করে। কর্ম ব্যতিরেকে জ্ঞান সম্ভব নয়। জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বহির্জগতের বাস্তবতা তাকে ভিত্তি করেই চিন্তা, চিন্তাধারা, মনন ও জ্ঞান। বাস্তবতাকে ভিত্তি করে জ্ঞান গড়ে ওঠে। জ্ঞান উদ্ভবের পর তা বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয়। মানুষের সমগ্র কার্যধারায় জ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে। সমাজ ও প্রকৃতি জগতে মানুষের নিরন্তর রূপান্তরের যে কার্যধারা, তাতে জ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে।
দ্বান্দ্বিকতার মূল দিকগুলি
● আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বস্তুবাদী দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে বস্তুবাদের সমন্বয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছে। দ্বান্দ্বিকতা বা দ্বন্দ্বতত্ত্ব হলোঃ ক) বিকাশের তত্ত্ব এবং খ) সার্বিক সম্পর্কের তত্ত্ব।
ক) দ্বন্দ্বতত্ত্ব বিকাশের তত্ত্ব
● বস্তু সর্বদা গতিশীল। বস্তুর অস্তিত্বের রূপ হলো গতি। বস্তু ব্যতিরেকে গতি হয় না। গতির অর্থ শুধুমাত্র যান্ত্রিক গতি নয়। গতির নানা রূপ। বস্তুর সমস্ত ধরনের ক্রিয়াকেই গতি বলে। গতির নানারূপ সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছতর করতে নিচের উদাহরণ দেওয়া হলো।
● প্রায় ৪৬০/৪৭০ কোটি বছর পূর্বে এই অসীম মহাবিশ্বের কোনো একটি স্থানে ভাসমান গ্যাসীয় মেঘ ও ধুলোকণা নিকটবর্তী হলো। দূর থেকে নিকটবর্তী হওয়াকে যান্ত্রিক গতি বলে।
● গ্যাসীয় পুঞ্জ ও ধুলোকণাগুলি নিকটবর্তী হওয়ায় তার মধ্যে একটি কেন্দ্র গড়ে উঠল। কেন্দ্রকে ঘিরে চাপ তৈরি হতে থাকল ও ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল। প্রবল চাপ ও তাপমাত্রা। চাপ ও তাপের অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি। কোটি কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা।
এই যে তাপ ও চাপের প্রবল বৃদ্ধি, এটা হলো গতির আর এক রূপ - পদার্থিক গতি।
● তাপ ও চাপের প্রবল বৃদ্ধির ফলে কেন্দ্র থেকে পরিধি বিচ্ছিন্নই শুধু হলো না, কয়েক টুকরো হয়ে গেল। কেন্দ্রকে ঘিরে পরিধির টুকরোগুলি আবর্তিত হতে থাকল। এই পৃথিবী নামক গ্রহের সৃষ্টি হলো। পৃথিবী ক্রমান্বয়ে শীতল হলো। জলমণ্ডল ও বায়ুমণ্ডল গড়ে উঠল। জলের মধ্যে বিভিন্ন অজৈব পদার্থের বিক্রিয়া শুরু হলো। এইভাবে মৌলিক পদার্থ থেকে যৌগিক পদার্থ, ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর রূপের যৌগিক পদার্থ গড়ে উঠল। জটিলতর পদার্থ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় প্রাণের সৃষ্টি হলো। প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াও একটা গতি - রাসায়নিক গতি।
● পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির পর শুরু হলো প্রাণের বিবর্তনের ধারা। এককোষী প্রাণী ছিল প্রাণের প্রথম রূপ। বিবর্তনের ধারায় এল বহুকোষী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীকুলের বিবর্তনের ধারায় মেরুদণ্ডী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটল। অবিরত বিবর্তনের ধারায় স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটল। স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের ধারায় পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটল। প্রায় ৩৬০/৩৭০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে এককোষী প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল। আধুনিক মানুষ অর্থাৎ বিজ্ঞানের ভাষায় ‘হোমো স্যাপিয়েনস্ স্যাপিয়েনস্’-এর আবির্ভাব ঘটল প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে। এই সমগ্র ধারাই আর এক ধরনের গতি। একে বলে জৈবিক গতি।
● পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর মানুষ তার সমাজ গড়ে তুলল। সমাজ বিকাশের ধারার বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমরা জেনেছি মানব সমাজের প্রথম রূপ হলো আদিম সাম্যবাদী সমাজ। বিকাশের ধারাতেই সমাজে শ্রেণি বিভাগ দেখা দিল। শোষণ দেখা দিল। শ্রেণি বিভক্ত সমাজের প্রথম রূপ হলো দাস সমাজ। বিকাশের ধারাতেই এরপর আবির্ভাব ঘটল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। তারপর পুঁজিবাদী সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজও বিকাশের ধারাতেই সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হবে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থাৎ সর্বহারার রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানব সমাজ সাম্যবাদের স্তরে উপনীত হবে। সাম্যবাদের স্তরেও মানব সমাজের বিকাশ ঘটবে। সমাজের বিকাশ আর এক ধরনের গতি - সামাজিক গতি।
● চেতনা এটাও তো গতির ফল। কার গতি? মস্তিষ্কের ক্রিয়া - এই গতির ফল।
● গতির ফলেই পরিবর্তন। সমস্ত কিছুই নিরন্তর পরিবর্তনের ধারায় বিরাজ করছে। পরিবর্তনের ধারাতেই বিকাশ ঘটে চলেছে। বস্তুজগতে স্থায়ী বা চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হতে হলে সমস্ত কিছুকে গতি ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় উপলব্ধি করতে হবে। বিশ্বকে তৈরি বস্তু হিসাবে দেখলে তা হবে ভ্রান্তি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সম্মিলিত রূপ হলো বিশ্ব।
● সমস্ত বস্তু ও প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে। উদ্ভব, গড়ে ওঠা, বিকাশ এবং পতনের তথা অবসানের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের জীবনই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে যেমন এই প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায়, আবার আমাদের চারপাশে যে জড় পদার্থ রয়েছে তার মধ্যেও এই প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। মূল কথা হলো, এই বস্তুজগতে কোনো কিছুই চিরন্তন নয়। উদ্ভিদ, পাহাড়, নদী যা প্রত্যক্ষ করছি কোনটিই চিরন্তন নয়। ভারতের উত্তর দিকে যে হিমালয় পর্বত, তাও তো চিরকাল ছিল না। সুদূর অতীতে এই স্থানে টেথিস সাগর ছিল। প্রকৃতি জগতের নিরন্তর বিকাশ ঘটে চলেছে। আমাদের পৃথিবী গ্রহ, তাও তো চিরন্তন নয়, চিরকাল ছিল না। আজ থেকে প্রায় ৪৬০/৪৭০ কোটি বছর পূর্বে আমাদের পৃথিবীর সৃষ্টি। প্রকৃতি জগতের নিয়মেই নক্ষত্র-গ্রহ-গ্রহাণু-ধূমকেতু এগুলির সৃষ্টি হয়। সৃষ্টিও যেমন হয়, আবার অন্ত অর্থাৎ বিকাশও হয়। আমাদের পৃথিবী, এই সৌরজগৎ তো চিরকাল থাকবে না। আধুনিক মানুষও তো কয়েক লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে এসেছে। প্রাণী জগতের বিবর্তন ধারাতেই মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। উদ্ভব, গড়ে ওঠা, বিকাশ ও পতনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনার ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক-ঐতিহাসিক সমস্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইতিহাস নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চলেছে। সামাজিক রূপের নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সামাজিক ঘটনাবলি পরিবর্তনের ধারাতেই বিকশিত হয়ে চলেছে। দ্বন্দ্বতত্ত্বর মূল কথা হলো, সমস্ত কিছুকে গতি, পরিবর্তন ও বিকাশের ধারাতেই দেখতে হবে। ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি সমস্ত কিছুকে পরিবর্তন তথা বিকাশের ধারাতেই দেখতে হবে।
● দ্বন্দ্বতত্ত্ব যেমন বিকাশের তত্ত্ব, ঠিক তেমনভাবে দ্বন্দ্বতত্ত্ব সার্বিক সম্পর্কেরও তত্ত্ব। সমস্ত বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়াকে সার্বিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। পরবর্তী সংখ্যায় এই আলোচনা আমরা করব।
(ক্রমশ)