৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
বিভীষিকারাজের বিষাক্ত ছোবল ময়নাগুড়িতেও
বিচারের বাণী কী নিভৃতেই কাঁদবে?
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মৃতার পরিবারের পাশে থেকে সমবেদনা জানাচ্ছেন মহম্মদ সেলিম।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শ্লীলতাহানির শিকার আরও এক নাবালিকার মৃত্যু হলো এ রাজ্যে। এবার উত্তরবঙ্গে। অন্য প্রায় সব বিভাগে পিছিয়ে থাকা এই রাজ্যকে মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায় ভরপুর ভাইয়েরা কার্যত ধর্ষণে এগিয়ে থাকা বাংলায় পরিণত করতে এখন বিভীষিকারাজ কায়েম করেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার কালিমায় দেশের ধর্ষণের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ এক গাঢ় কালো দাগে পরিণত হচ্ছে। ব্যানার্জির পুলিশকে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও প্রতিকার না পেয়ে আত্মঘাতী হতে হলো আরও এক নাবালিকাকে। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে। প্রতিকার না পেয়ে উলটে ক্রমাগত অভিযোগ তুলে নেবার হুমকির মুখে কয়েকদিন আগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হবার চেষ্টা করে ক্লাস এইটের পড়ুয়া ওই নির্যাতিতা। এরপর ২৫ এপ্রিল ভোর পাঁচটা নাগাদ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হয় ময়নাগুড়ির ওই নির্যাতিতা ছাত্রীর। খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটে যান পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মৃতার পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন তিনি। ঘটনায় অভিযুক্ত ময়নাগুড়ি ধর্মপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তৃণমূল নেতা বিজয় রায়ের ভাই অজয় রায়।
ময়নাগুড়ি থানা এলাকার ঘটনার সূত্রপাত এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১২ ফেব্রুয়ারি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ১৪ বছর বয়সি নাবালিকাকে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা বিজয় রায়ের ভাই অজয় রায় নাবালিকার শ্লীলতাহানি করে। এই ধর্ষণের চেষ্টা ও শ্লীলতাহানির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হয় ময়নাগুড়ি থানায়। মেয়েটির মা ও বাবা ওই থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
ময়নাগুড়ি থানা এলাকায় ধর্মপুর গ্রাম পঞ্চায়েত সংলগ্ন এই গ্রাম মূলত কৃষিপ্রধান। এখানে বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষের বাস। মধ্যে রয়েছে পেশায় দিনমজুর, খেতমজুর এবং ক্ষুদ্র কৃষক। অত্যাচারিত মেয়েটির বাবা পেশায় দিনমজুর এবং মেয়েটির মা জলপাইগুড়ি শহরে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন।
১২ ফেব্রুয়ারি এলাকার প্রবল প্রতাপশালী তৃণমূলী নেতার ভাই মেয়েটিকে যৌনলাঞ্ছনা করলে নাবালিকার মা বাবা তার মেয়েকে নিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করার পরই পুলিশ তৃণমূল নেতার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেস সাজায় গুরুত্বহীনভাবে। তার জেরে জেলা আদালত থেকে আগাম জামিন পায় ওই তৃণমূল নেতার ভাই। এরপরই ১৪ বছর বয়সি মেয়ের বাড়িতে একা থাকার সুযোগ নেয় তৃণমূলীরা তারা বাড়িতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে একা পেয়ে অভিযোগ তুলে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। অভিযোগ তুলে না নিলে বাড়ির সবাইকে খুন করে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়, এরপরই আতঙ্কে গায়ে আগুন দেয় আত্মঘাতী হবার জন্য, ১৩ এপ্রিল। দীর্ঘ প্রায় ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৫ এপ্রিল ভোরে তার মৃত্যু হয়।
২৫ এপ্রিল এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল করে বিক্ষোভ দেখানো হলো জলপাইগুড়ি ও ময়নাগুড়ি শহরে। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উদ্যোগে জলপাইগুড়ি শহরে মিছিল করে কদমতলা মোড়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয় মৃত নাবালিকার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ময়নাগুড়ির ছাত্রীর মৃত্যুর প্রতিবাদে এদিন জলপাইগুড়ি শহরের বুকে মিছিল শেষে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য, পার্টি নেতা পীযূষ মিশ্র প্রমুখ।
মৃতা ছাত্রীর ময়নাতদন্তের পর দেহ গ্রামের বাড়িতে আনার আগে থেকেই জেলা সদর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ বাহিনী, র্যা ফ, কমব্যাট বাহিনী এনে মৃতার গ্রাম বাগান বাড়ি সহ সমগ্র ধর্মপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা ঘিরে ফেলা হয় মানুষের ক্ষোভ থেকে বাঁচাতে। এমনকী নিজের গ্রামে দাহ না করে পাশের গ্রাম জোরপাকরিতে গিয়ে শ্মশান ঘাটে পুলিশ দিয়ে ঘিরে দাহ কাজ করা হয়। মৃত ছাত্রীর বাড়ির লোক ছাড়া সেখানে আর কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। যদিও গ্রাম এদিন সকাল থেকে ভয়ে কার্যত শুনশান হয়ে যায়। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান, আর যারা ছিলেন তারা বাড়ির ভিতরেই ছিলেন।
শুধু এতেই থামেনি পুলিশ প্রশাসন, তারা সব রাস্তা অবরুদ্ধ করে দেয়। এখানেও সামাজিক ন্যায় মঞ্চের নেতা অলকেশ দাস এবং ময়নাগুড়ির পার্টি নেতা জ্যোতিপ্রকাশ ঘোষ পুলিশের চোখ এড়িয়ে গ্রামে ঢুকে যান। সব রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আটকে রাখার পর নাছোড়বান্দা নেতৃত্বের সাথে তুমুল বিতর্কের পর পুলিশ পার্টি নেতৃত্ব ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের বাধ্য হয়ে চার জন করে ঢুকতে দেয়। মহিলা সমিতি, সামাজিক ন্যায় মঞ্চের প্রতিনিধি এবং পার্টি নেতৃত্ব নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের আশ্বাস ভরসা দিয়ে জানায়, আপনাদের ন্যায় বিচার দিতে সব লড়াইতে আমরা পাশে আছি। শেষ দেখে ছাড়ব। মহিলা সমিতি এবং সামাজিক ন্যায় মঞ্চের পক্ষ থেকে এই পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় শেষকৃত্যের সামাজিক কাজ করার জন্য। এরপর পার্টির উদ্যোগে জোরপাকরি বাজারে মৃত ছাত্রীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সভা করা হয়।