E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

এগারো বছরে রাজ্যে কোনো শিল্পের শুভ সূচনা হয়নি

আবার শোনা গেল লক্ষ-কোটি টাকা লগ্নির গল্প

শংকর মুখার্জি


আবার একটা শিল্প সম্মেলন। আবার লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের গল্প। বাৎসরিক এ গল্প শুনে শুনে রাজ্যবাসী ক্লান্ত অবশ্যই, তবে তার থেকে হতাশ অনেক বেশি। এবারও বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে (বিজিবিএস)’র পর সাংবাদিক সম্মেলন করে, দৈনিক পত্রিকাগুলিতে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকার জানিয়েছে রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ৩ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

তবে এই লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাবে কোনো নতুনত্ব নেই। আগের পাঁচটা সামিটেও তা শোনা গিয়েছিল। সেই প্রস্তাবিত বিনিয়োগের ঠিক কত শতাংশ বাস্তবায়িত হলো সে পর্যালোচনা সরকার কোনোদিন রাজ্যবাসীকে জানায়নি। প্রকৃতপক্ষে, কোনো কাজের বা প্রতিশ্রুতির পর্যলোচনা করা, কিংবা তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা জনগণের কাছে হাজির করার গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভ্যাস তৃণমূল সরকারের একেবারে নেই। মমতা ব্যানার্জি সেই কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকার সময় থেকে আজ পর্যন্ত শিল্প-হাসপাতাল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি তৈরি করবেন বলে নিয়ে কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পর্যালোচনা তো দূরে থাক সেইসব প্রতিশ্রুতির কথা হয়তো মমতা ব্যানার্জির নিজেরও মনে নেই। তৃণমূল শাসনের অভিজ্ঞতা বলছে, গত দশ-এগারো বছরে এ রাজ্য নতুন কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া একটাও বেরোয়নি। তাই সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় এই সামিট থেকে রাজ্যবাসীর কোনো আশার আলো না দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে একটা ব্যাপারে অবশ্যই চমক দিয়েছে ষষ্ঠ বিজিবিএস। তা হলো, মায়াপুরে ৭০০ একর জমির ওপর জিন্দালদের মন্দির তৈরির প্রস্তাব। এটা অতীতের আর অন্য সবের মতো প্রস্তাবিতই থেকে যাবে কীনা তা সময়ই বলবে। কিন্তু শিল্প সম্মেলনে মন্দির তৈরির প্রস্তাব, নিশ্চিতভাবেই একটা অভিনবত্ব আছে।



সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এটা ষষ্ঠ বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট। যার শুরু ২০১৫ সাল থেকে। কিন্তু অতীতে সংবাদপত্রের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, তৃণমূল সরকারের উদ্যোগে এর আগেও শিল্প সম্মেলন হয়েছে কলকাতা এবং হলদিয়ায়। শিল্পপতিদের সঙ্গে বড়ো আকারে বৈঠক হয়েছে দিল্লিতে, মুম্বাইয়ে। দেশের বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে হওয়া শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে ৬৫ জন শিল্পপতি, ২০-২২ জন ব্যাঙ্কার এসেছিলেন। ছিলেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মুকেশ আম্বানীও। এসেছিল বিনিয়োগের প্রস্তাবও। তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে রাজ্যবাসীর হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের গল্প শোনা সেই শুরু।

গত আট-নয় বছরে এরপর হুগলি, দামোদর, রূপনারায়ণ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। দুটি বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা ব্যানার্জি। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ইশতেহারে দেওয়া “...পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি মহকুমায় অন্তত দশটি করে বড়ো, মাঝারি শিল্প গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে”-র মতো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও শিল্প নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা ছিল পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের তৃণমূলের ইশতেহারগুলিতেও। করপোরেট কায়দায় আয়োজনে-বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর হচ্ছে ঝা চকচকে বিজিবিএস। কোভিড মহামরীর কারণে শুধু মাঝে দুবছর হতে পারে নি। সামিটগুলিতে টইটুম্বুর বিনিয়োগের প্রস্তাবও এসেছে। সব মিলিয়ে যার মোট পরিমাণ ছিল ১২ লক্ষ ৬২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিনিয়োগের প্রস্তাবে হয়তো দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলিকে টেক্কাও দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু গত এগারো বছরে মেলা-উৎসব, পুজোর ফিতে কেটে মমতা ব্যানার্জির উদ্বোধনের অসংখ্য ছবি মনে করা গেলেও তিনি একটা নতুন শিল্পের শুভ সূচনা করছেন তার ছবি স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না।



এবারের বিজিবিএস-এ বিনিয়োগের প্রস্তাবের পরিমাণ গতবারের চেয়ে ৫৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। সেই বিচারে সরকার বলতেই পারে, গতবারের থেকে এবারের সামিট আরও বেশি সফল। সামিটের শেষে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৩.৪২ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে আনুমানিক ৪০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। রাজ্যের প্রতিবছরের বাজেট বিবৃতিতেও লক্ষ-কোটি কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়। সেই সব বিবৃতির আদৌও কী হাল তা কোনোদিনই বিধানসভাতেও আলোচনা হতে দেখা যায় না।প্রস্তাবিত বিনিয়োগে শিল্প কতদূর হবে সেটাই যখন একটা বড়ো প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন এই কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ তো অনেক দূরের ব্যাপার।

যেসব সংস্থা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে তাও খুব ভাষাভাষা। অন্তত সরকার যতটা প্রকাশ্যে এনেছে তাতে জানা যাচ্ছে রাষ্টায়ত্ত গেইল, এইচপিসিএল, ওএনজিসি নাকি আগামীদিনে রাজ্যে বিনিয়োগ করবে। এইচপিসিএল এবং ওএনজিসি বিনিয়োগ করবে প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও কোলবেসড মিথেন উত্তোলনে। উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর ছাড়া রাজ্যের অন্য কোথাও তেল ও গ্যাস উত্তোলনের কাজ হচ্ছে বা সম্ভাবনা আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে এইচপিসিএল এবং ওএনজিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে। আর কোলবেসড মিথেনে (সিবিএম)’র বিষয়টা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এর ভালো সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু এতদিনে সিবিএম উত্তোলনের প্রাথমিক পরিকল্পনাই করা হয় নি। শিল্প সম্মেলন এলেই সিবিএম উত্তোলনের প্রসঙ্গ আসে। সরকার বলেছে, বাড়ি বাড়ি পাইপলাইনের মধ্যদিয়ে গ্যাস সরবরাহের প্রকল্পটি নাকি শেষের পথে। কলকাতাবাসী নাকী খুব শীঘ্রই এর সুবিধা পেতে চলেছে। যদিও এই প্রকল্প নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে একই কথা শোনাচ্ছে সরকার। সরকারের কথা একশ শতাংশ সত্যি বলে যদি ধরেওনি, তাহলেও এই প্রকল্প অর্থাৎ গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প রাজ্যের অর্থনীতি কিংবা কর্মসংস্থানের চিত্রে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবে না। এই গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহে সবমিলিয়ে বিনিয়োগের প্রস্তাব ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, কোথায় এত টাকা বিনিয়োগ হবে তা খুব একটা পরিষ্কার নয়।

বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেকগুলি বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে অ্যাপোলো, নারায়ণা, মেডিকা, জেআইএস, হেল্থ ওয়ার্ল্ড হসপিটাল প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা সম্বন্ধে আমরা সবাই অবগত আছি। জেলায় জেলায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় সুপার স্পেশালিটি নামে অসংখ্য হসপিটাল হয়েছে। কিন্তু সেখানে আধুনিক চিকিৎসা তো দূরে থাক, সাধারণ চিকিৎসারও ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় কলকাতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলির ওপর চাপ বেড়েই চলেছে। সব রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থাও সেখানে করা যায় না। মানুষ বাধ্য হয়েই তৃণমূল জমানায় আরও বেশি বেশি করে বেসরকারি হাসপাতালগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সরকারের কাজকর্ম দেখে মনে হয়, তারাও এটাই চাইছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা পেতে সাধারণ মানুষের হয়রানিরও অজস্র ঘটনা ঘটছে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে দূর্নীতির অভিযোগও উঠছে। যদি ধরেওনি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই বিনিয়োগগুলি বাস্তবায়িত হবে, তাহলেও তা রাজ্যের ভেঙে-পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনর্গঠনে কিংবা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারকে খুব একটা সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। শুধু বিনিয়োগ এলেই হবে না, স্বাস্থ্য নিয়ে রাজ্যের নীতিকে গণতান্ত্রিক করতে হবে।

এছাড়াও আরও অনেক বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। সেসব ধরে ধরে আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। কেন না সেই সব বিনিয়োগের প্রস্তাবগুলি একেবারেই ভাসাভাসা। অন্তত যা দেখে কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব সেরকম কোনো তথ্যই নেই। শুধু একটা সংস্থার কথা বলে এ প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করব। এবারের বিজিবিএস-এ টাটা-হিতাচি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। অন্তত সরকার যা বলেছে তার থেকে এটা জানা যাচ্ছে। কিসে বিনিয়োগ করবে তা জানা যায়নি। পাঠকরা জানলে অবাক হবেন যে, ২০১৫ সালে প্রথম বিজিবিএস-য়েও টাটা-হিতাচি’র বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। পরেও বেশ কয়েকবার বিজিবিএস-এ এই সংস্থার বিনিয়োগের কথা হয়েছে বলে আমরা সরকারের বিবৃতিতে জেনেছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিনিয়োগে ইচ্ছুক সংস্থাগুলির যে তালিকা প্রকাশ হয়, তা কী সব সত্য না মনগড়া একটা তৈরি করা তালিকা।



তবে বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজ্যে শিল্পে বিনিয়োগের চিত্রটা হতাশাজনক তো ছিলই না যথেষ্টই উজ্জ্বল ছিল। ১৯৯১-২০১০ সাল পর্যন্ত কুড়ি বছরে ২,৫৩১ নতুন শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ৬৫ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আজকের তুলনায় তখন টাকার দাম অনেক বেশি ছিল। তাই আজকের হিসেবে এই অর্থের পরিমাণ হবে আরও বেশি।কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রেও দেশে নজির সৃষ্টি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট বলছেঃ ২০০৪-১১ সময়কালে সারাদেশে উৎপাদন ক্ষেত্রে ৫৮ লক্ষ ৭০ হাজার কাজ তৈরি হয়েছিল। যার মধ্যে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪ লক্ষ কাজ তৈরি হয়েছিল শুধু পশ্চিমবঙ্গে, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

একটা ধ্বংসাত্মক শিল্পবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই নেতিবাচক চরিত্র তারা একদমই কাটাতে পারেনি। প্রকৃত অর্থে তারা কাটাতে চায়ও না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে শাসকদলের দুর্বৃত্তদের অবাধ তোলাবাজি দাদাগিরি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসব ব্যাপারকে দমন করার চেষ্টা তো করেনই না, বিভিন্নভাবে দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। এখন এইসব আইনশৃঙ্খলার ব্যাপার একেবারে প্রশাসনের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সামগ্রিকভাবে এইসব বিষয়ের উন্নতি নাহলে রাজ্যে শিল্পের ইতিবাচক পরিবেশ ফিরে আসবে না। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তৃণমূল সরকারের সে কাজ করার ক্ষমতা আর এখন নেই। একমাত্র এই সরকারের পরিবর্তনেই রাজ্যে শিল্পস্থাপনের অতীত পরিবেশ ফিরে আসতে পারে।