৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
দেশে অভূতপূর্ব মূল্যবৃদ্ধি
ঈশিতা মুখার্জি
দেশে রেকর্ড হারে মূল্যবৃদ্ধি। জিনিসপত্রের দাম বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। গত মার্চ মাসে দেশের পাইকারি মূল্যসূচক বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৫৫ শতাংশ হয়েছে। চার মাস ধরে ক্রমাগত ১০শতাংশের বেশি থাকার পর এই হার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছালো। সাত মাসের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি দেখা গেল খুচরো বাজারের ক্ষেত্রে । মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৯৫ শতাংশ। ২০২০ সাল থেকেই বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার বিগত বছরগুলির থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০২০ সালে বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার হয় ৬.৬২ শতাংশ। কিন্তু ২০১৭ সালে তা ছিল ৩.৩৩ শতাংশ। এই বৃদ্ধির হার মারাত্মক। চিত্র-১ থেকে এই মূল্যবৃদ্ধির মারাত্মক অবস্থার কিছু ধারণা করা যেতে পারে।
মার্কসবাদী আলোচনায় আমাদের ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় হলো কেন এই মূল্যবৃদ্ধি এবং এর মোকাবিলা কীভাবে করা হবে। তবে অবশ্যই এই মোকাবিলা করার নীতি নিয়ে বর্তমান রাষ্ট্রের সাথে মার্কসবাদীরা একমত হতে পারবেন না। এখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল দেশের বেশিরভাগ মানুষ। বিশেষকরে গরিব মেহনতি মানুষের অবস্থা সহ্যের সীমার বাইরে। এই মূল্যবৃদ্ধি কোনো সুস্থ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নয়। সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় যে মূল্যসূচক তা হলো ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক। এই মূল্যসূচক আর পাইকারি মূল্যসূচকের মধ্যে তফাৎ আছে। অর্থাৎ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যখন ভীষণভাবে বাড়তে থাকে, তখন মানুষের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব হয়ে যায়। এই দুই সূচকের মধ্যে সম্পর্ক চিত্র-এর সাহায্য বোঝা যায়। এ নিয়ে গ্রামে ও শহরে এবং বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। পেট্রোল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এই পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী হলেও পুরোটা নয়। যদি শ্রমিকের মজুরি আর করপোরেটের মুনাফা দেখি তাহলে স্পষ্ট যে, এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে আসলে মজুরি বা শ্রমজীবীর আয় যেভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, মুনাফা সেভাবে হয়নি। ২০২১ সাল পর্যন্ত মুনাফা বেড়েই গেছে আর মজুরি কমেই গেছে। এর মধ্যে কাজ হারিয়ে জনসংখ্যার অনেক অংশের আবার মজুরি শূন্য হয়ে গেছে। কিন্তু করোনার সময়েই করপোরেটগুলোর মুনাফা বেড়েছে। কাঁচামালের খরচের তুলনায় কত মুনাফা বেড়েছে চিত্র ৩-এর সাহায্যে বোঝা যায়।
তাহলে এ কথা ভাবা কী খুব অসম্ভব যে, মুনাফাকে বাড়ানোর জন্য উৎপাদনের খরচের একটা বড়ো অংশ ক্রেতার উপর চেপে বসছে এবং তারফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। পাইকারি মূল্য সূচক উৎপাদনের দামের কথা বলে। খুচরো পণ্যের মূল্য সূচক ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচক বোঝায়। উপরের চিত্র থেকে দেখা যায় যে, এই মুহূর্তে পাইকারি মূল্য সূচক খুচরো মূল্য সূচকের চেয়ে বেশি হলেও সব সময়েই খুচরো মূল্যসূচক বেশি থেকেছে। এই আপাতত কমটা কোনভাবেই থাকবে না। এখনই দেখা যাচ্ছে যে, খাদ্যপণ্য সহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কীভাবে বেড়েছে। মার্চ মাসে খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬৮ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২১ সালের মার্চ মাসে এই হার ছিল ৪.৮৭ শতাংশ। এটি ছয় মাসে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে গ্রামীণ মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশি শহরের থেকে। বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এই মূল্যবৃদ্ধির হার বিভিন্ন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চদের মধ্যেই পড়ছে। এই মূল্যবৃদ্ধির হার ৮.৭ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্যে কর কাঠামো আলাদা বলে এই তফাত হয়। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গবাসী বেশি দুর্ভোগে পড়বে বলে বলা যায়।
চিত্র ১: মূল্যবৃদ্ধির হার
সূত্রঃ বিশ্বব্যাঙ্ক
চিত্র ২
সূত্রঃ হিন্দুস্তান টাইম্স
চিত্র ৩: কাঁচামালের খরচের অনুপাতে মুনাফার পরিমাণ।
সূত্রঃ হিন্দুস্তান টাইম্স
কেন বর্তমানে এই মূল্যবৃদ্ধি? প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছিল যে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এর কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। দেশের সরকার যে রাজনৈতিক নীতি নিয়ে দেশ চালাচ্ছে, সেই নীতিই এর জন্য দায়ী। পেট্রোপণ্যের দাম নিয়েও বলতে গেলে দেখা যায় যে, কেন্দ্র তার করের বোঝা বছর বছর বাড়িয়ে চলেছে কয়েকগুণ হারে। কিন্তু এ ছাড়াও আছে পুঁজিপতিদের মুনাফা বজায় রাখা এবং বৃদ্ধি করার তাগিদ। এই তাগিদ থেকেই মূল্যবৃদ্ধি থেকে যাচ্ছে, বেড়েও যাচ্ছে। এই মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য একটি অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হচ্ছে - তা হলো বেকারি। বেকারি আর মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে কিছু সম্পর্ক আছে? পুঁজিবাদী অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্র সবসময় মূল্যবৃদ্ধির তথ্য যেভাবে নিখুঁতভাবে দেয়, বেকারির তথ্য কিন্তু ততটা নিখুঁতভাবে দেয় না। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এই রাষ্ট্রের অনেক মাথাব্যথাও থাকে, কিন্তু বেকারি নিয়ে থাকে না। সাধারণত বেকারি বাড়লে, মূল্যবৃদ্ধি কমে কারণ চাহিদা কমে, জোগানকেও সেই অনুযায়ী কমতে হয়। তাই এক্ষেত্রে চাহিদা বাড়ানোই জনমুখী নীতি হওয়া উচিত মূল্যবৃদ্ধি কমাতে। তা করতে হলে টাকার জোগান বৃদ্ধি করে, সুদের হার কমিয়েও করা যায় বা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যায় করের তারতম্য করে। সুদের হার কমানোর কথা এখন বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতির যা অবস্থা সুদের হার কমালে সঞ্চয় বাড়বে না রেকর্ড বেকারির জন্য। বিনিয়োগ তো এমনিতেই বাড়ছে না। তাই মানুষের স্বার্থে তাঁদের প্রকৃত আয় বাড়ানো প্রয়োজন। কর্মসংস্থান তো নিশ্চয়ই প্রয়োজন। এর সাথে প্রয়োজন অতিধনীদের কর বৃদ্ধি করা এবং পরোক্ষ কর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর থেকে যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া। পণ্য পরিষেবা কর কাঠামো পরিবর্তন করা। আরও প্রয়োজন হলো আয়কর দেন না এমন পরিবারগুলিকে মাসে অন্তত ৭৫০০ টাকা করে দেওয়া। এইভাবেই চাহিদা বাড়ানো সম্ভব, মানুষ বাঁচবে, বেকারি দূর হবে, মূল্যবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে। এদেশে বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধির একসাথেই সমাধান করতে হবে। কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এ পথে সাধারণত হাটে না, উগ্র দক্ষিণপন্থা তো নয়ই। তারা ধনী করপোরেটদের চোখ দিয়ে অর্থনীতিকে দেখে। তাই তারা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত কারণ উৎপাদনের খরচ বাড়বে বলে। বেকারি নিয়ে তারা আদৌ উদ্বিগ্ন নয়। এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক তারা দেখতে পায় না, বুঝবার চেষ্টাও করে না।
মানুষের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে মূল্যবৃদ্ধি না দেখলে উৎপাদনেরও ভবিষ্যৎ থাকে না, এই সহজ সত্যটি থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সবসময় মুখ ঘুরিয়ে রাখে। এর কারণ বোঝা সহজ। মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মাতামাতি থাকে। ওখানে বেকারির হার না বললেও হবে , মূল্যবৃদ্ধির হার জানাতে হয় সরকারকে। সংকট তো মানুষের সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতা। যদি মানুষজন এই দামে কিনতে সক্ষম হতেন, তাহলে তো এ বিষয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। দুশ্চিন্তার কারণ মানুষের হাতে টাকা নাই, কাজ নেই। সেই কারণেই যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে, এ বিষয়ে সরকার নিশ্চুপ। তাই বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির এই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বাদ দিয়ে এর প্রতিকারের কথা ভাবা যাবে না, কারণও বোঝা যাবে না।