৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
১লা মে - আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ও আমাদের কর্তব্য
দীপক দাশগুপ্ত
পুঁজিবাদ জন্মলগ্ন থেকেই শোষণমূলক এক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ শোষণ তীব্রতম করার জন্য শ্রমিকশ্রেণির ওপর সর্বোচ্চ শ্রম সময়ের কাজের বোঝা চাপিয়ে দিত - ফলে তারা তীব্রতমভাবে শোষিত হতো। ১২-১৪ থেকে ১৬-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হতো। উক্ত কাজে যুক্ত থাকার ফলে শ্রমিকরা শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হতো। দিনের শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরে আসত, তখন তাদের আর কিছু করার ক্ষমতা থাকত না। যন্ত্রের সঙ্গে সারাদিন থাকতে থাকতে শ্রমিকরাও যন্ত্রের মতোই যান্ত্রিক হয়ে যেত। এভাবে চলত বুর্জোয়াদের শোষণ। এর বিরুদ্ধে ইউরোপ, আমেরিকা মহাদেশের দেশে দেশে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিত। ওই অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তা ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে বিভিন্ন সময় ফেটে পড়েছিল। এর পরিণামে বুর্জোয়া মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে জনগণের সামনে এলো। উক্ত শ্রেণি সংগ্রামের শক্তিবৃদ্ধি ও ব্যাপক অংশের শ্রমজীবীদের জমায়েতের ফলে এবং পুঁজির মালিক ও বুর্জোয়া ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণির উক্ত সংগ্রামের তীব্রতা, জঙ্গিমত্ততা, দেখে ব্রিটিশ বুর্জোয়া সরকার শ্রম সময় হ্রাস করে ১০ ঘণ্টার আইন করতে বাধ্য হয়েছিল। এঘটনা শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছিল। কার্ল মার্কস ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণির এই বিপ্লবী ভূমিকা দেখে অত্যন্ত খুশি হয়ে তাদের বীর বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণি ও তাদের ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বিশ্বের প্রতিটি দেশের শ্রমিকশ্রেণিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে গড়ে উঠেছিল শ্রেণিগত চেতনা ও গড়ে উঠেছিল ঐক্য দৃঢ় আকারে। চেতনার বিকাশ ও ঐক্যের ফলে আন্দোলনের ক্রমবিকাশ হয়, বিশ্বের দেশে দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। শ্রেণি সংগ্রাম বিকশিত হয়। উক্ত শ্রেণি সংগ্রামের পরিণামে শ্রমিকশ্রেণির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শেষপর্ব পর্যন্ত শ্রমিকশ্রেণি শ্রম সময়ের হ্রাসের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে। উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন শ্রমিকশ্রেণি। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রম সময় হ্রাস করতে গড়ে ওঠা সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণি জয়ী হয়েছিল।
দুনিয়ার মজদুর এক হও!
১৮৪৭ সালে ‘কমিউনিস্ট লিগ’র কংগ্রেস থেকে ‘দুনিয়ার সকল মানুষ ভাই’ রণধ্বনির বদল ঘটিয়ে সেখানে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ রণধ্বনি দেওয়া হয়। উক্ত রণধ্বনি ছিল বস্তুনিষ্ঠ ও আদর্শনিষ্ঠ। এর পর থেকে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানে পরিণত হয়। এই রণধ্বনির দ্বারা সমগ্র শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়টিকে সামনে আনা হয়। শ্রমিক ঐক্য ভেঙে দেওয়ার জন্য শাসকশ্রেণি ও শাসকদলের পক্ষ থেকে, ফ্যাসিস্ত ও ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত শক্তির তরফ থেকে বহুবার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে, কিন্তু ওই সময় ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক, কৃষকসহ সমগ্র জনগণের পক্ষ থেকে রুখে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশে বর্তমানে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি-আরএসএস সরকার ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করতে সচেষ্ট। দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মোদি-অমিত শাহ হিন্দুত্বের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অহিন্দু ভারতীয়দের দেশ থেকে হটিয়ে দিতে চায়, এবং ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানাতে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের বাহিনী দিনরাত কাজ করে চলেছে। প্রতিক্রিয়াশীল ওই শক্তি মানুষকে কাল্পনিক, আজগুবি বক্তব্যের দ্বারা বিভ্রান্ত করে দেশকে বিপথে চালিত করছে। এবং দেশের শ্রমজীবী মানুষকে একই সঙ্গে বিভ্রান্ত করে তাদের অসত্যের পক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশের জন্য ও শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যের জন্য কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। বলাবাহুল্য শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ধর্মসম্প্রদায়গত, জাতপাত, বর্ণ, প্রভৃতি অংশগুলির মানুষকে শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া দরকার। উক্ত অংশের মানুষদের মধ্যে নীতির ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।
শ্রমিক সংহতি কর্মসূচি
নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি সমাজের নেতৃপদে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকে; এর প্রাথমিকপর্বে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অংশের জনগণের সমস্যা নিরসনে সংগ্রাম গড়ে তুলতে শ্রমিকশ্রেণির সহযোগিতামূলক হস্তক্ষেপ আবশ্যক। অন্যথায় শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব সমাজের অন্যান্য শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষেরা মানতে অস্বীকার করতে পারে।
ঠিক এই উদ্দেশ্যে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে জুরিখ কংগ্রেস (১৮৯৩) ১লা মে, মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ও ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে সংহতিমূলক আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে সংহতিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে দুনিয়াজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী কর্তৃত্ব উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর নানা ধরণের শোষণমূলক কর্মসূচি চালিয়ে দেশের সম্পদ লুঠ করা, কিউবা সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালানো, কিউবার ওপর ১৯৬০-৬১ সাল থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া, সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া, গণতান্ত্রিক কোরিয়াকে সন্ত্রাসবাদী দেশ হিসাবে আখ্যা দেওয়া, ও তার ওপর বহু জবরদস্তিমূলক কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া, চীনকে ঘিরে ফেলা প্রভৃতি ন্যক্কারজনক কাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা এবং যে সমস্ত দেশের জনগণ মার্কিন প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন - সেই লড়াকু জনগণ ও শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে সংহতিমূলক কর্মসূচি শ্রমিকশ্রেণির চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক কর্মসূচি হিসাবে থাকবে। আরএসএস-বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দেশে অর্থনৈতিক সংকটের অভূতপূর্ব তীব্রতা তৈরি হয়েছে, দেশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জুনিয়র পার্টনার বানানোর মহান রূপকার(!) নরেন্দ্র মোদির নীতি যা দেশ ও দেশের জনগণকে বিপন্ন করেছে। তার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণিকে সচেতনভাবে সংগ্রাম গড়ে তোলা আবশ্যক ও জরুরি। এর জন্য মে দিবস উদ্যাপনকালে অঙ্গীকার গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে মোদি-শাহ’র নেতৃত্বে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দেশকে বিপন্ন করা এবং দেশ ও দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা চলছে। দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে ও অহিন্দু জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করে থাকে আরএসএস-বিজেপি সরকার।
কর্পোরেট-কমিউনাল বিজেপি সরকার অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে দেশকে যেমন নিয়ে গেছে, দেশের যাবতীয় সম্পদ জলের দরে কর্পোরেটকে বিক্রি করে দিচ্ছে, তেমনি দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে বানাতে চাইছে। এবং বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জুনিয়র পার্টনার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শ্রমজীবী জনগণের আবশ্যিক কর্তব্য
মে দিবসে আমাদের শপথ নিতে হবে ভারতের স্বাধীন বিদেশ নীতি ফিরিয়ে আনার। বিশ্বের দরবারে ভারতের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে। আমাদের পার্টির ২২তম কংগ্রেসে রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, ‘প্রায় চার বছরে মোদি সরকার দেশে একটি দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। নয়া উদারনীতির রাজনীতির তীব্রতম অনুসরণ এবং তার ফলে শ্রমজীবী মানুষের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে কোণঠাসা করতে এবং আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি রূপায়ণে সংঘবদ্ধ প্রয়াস, সেই সঙ্গে মুসলিম ও দলিতদের আক্রমণ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ককে শক্তিশালী করে তার অধস্তন সঙ্গীর ভূমিকা পালন করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে ধ্বংস ও সংসদীয় গণতন্ত্রকে দমন করে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা হলো এই শাসনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।’ (অনুচ্ছেদ ২.১)
উপরোক্ত দক্ষিণপন্থী আক্রমণ এমন আরও তীব্র। সেই সঙ্গে আরও বেশি ভোট ও আসন নিয়ে ফিরে আসায় ফ্যাসিস্ত আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি আরও আগ্রাসী রূপ নিচ্ছে।
দেশ ও দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য আরএসএস এবং বিজেপি সরকারকে দেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। মে দিবসে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করার শপথ নিতে হবে। আর আমাদের রাজ্যে মোদির সহযোগী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল সরকারকে হটিয়ে, নৈরাজ্য দূর করে পশ্চিমবঙ্গকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।