৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
সঙ্গত কর্ম-দিবসের জন্য সংগ্রাম - ঐতিহাসিক মে দিবস
আবুবকর সেখ
কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত ‘পুঁজি’ গ্রন্থে স্বাভাবিক কর্ম-দিবসকে পুঁজির শোষণের তাগিদে কীভাবে প্রসারিত করা হয় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে ষষ্ঠ পরিচ্ছদে এবিষয়ে আলোচনা উত্থাপন করে মার্কস বলেনঃ ‘‘... অষ্টাদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে আধুনিক যন্ত্রশিল্পের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এলো এক প্রচণ্ড আক্রমণ - তীব্রতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে যা হিমানী-প্রপাতের মতো। নৈতিক ও প্রাকৃতিক বাধার অর্গল ভেঙে পড়ল, বয়স অথবা স্ত্রী-পুরুষের তারতম্য থাকল না, দিন ও রাত্রির পার্থক্য ঘুচে গেল। এমনকী দিন ও রাত্রের ধারণা পর্যন্ত যা পুরনো আইনগুলিতে সরলভাবে ব্যক্ত ছিল, এমনই গুলিয়ে গেল যে, ১৮৬০ সালেও একজন ইংরেজ বিচারককে ‘আইনগতভাবে’ দিন ও রাত্রি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল। পুঁজি তার তাণ্ডবনৃত্যে মত্ত হলো।’’ (পৃষ্ঠা-৩৪৪-৩৪৫) প্রথম দিকে এই নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার ঘনঘটায় কিছুটা স্তম্ভিত হলেও, পরে শ্রমিকশ্রেণি সংবিৎ ফিরে পান। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ সর্বপ্রথমে শুরু হয় যন্ত্রশিল্পের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে।
১৮৩৩ সালের কারখানা আইনে ঘোষণা করা হয় কর্ম-দিবস শুরু হবে সকাল সাড়ে পাঁচটায় এবং শেষ হবে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। অর্থাৎ কর্ম-দিবস চলত ১৫ ঘন্টা পর্যন্ত। তরুণদের কাজ করতে হতো ১২ ঘণ্টা। আর ৯-১৩ বছরের শিশুদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করানো হতো। এই বয়সের শিশুদের আবার পালা করে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত এবং বেলা দেড়টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা পর্যন্ত আরেক দল শিশুদের নিযুক্ত করা হতো। শুধু তাই নয় ১৩ বছরের কম বয়সের শিশুদের কারখানার নরককুণ্ডে সপ্তাহে ৭২ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো।
এই পরিস্থিতিতে ১৮৪৪-১৮৪৭ সালের ১২ ঘণ্টা কর্ম-দিবস কারখানা-আইন শিল্পের সকল শাখায় সাধারণ ও সমভাবে প্রযোজ্য হয়।
কিন্তু পুঁজিপতিরা নতুনভাবে এই আইন মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাগড়া দেয়। কার্ল মার্কস তার উল্লেখ করে বলেনঃ ‘‘কিন্তু কারখানার মালিকেরা ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছুটা ‘প্রতীপগতি’ না ঘটিয়ে এই ‘অগ্রগতি’ হতে দেয়নি। তাদের প্ররোচনায় কমন্সসভা শোষণযোগ্য শিশুদের নিম্নতম বয়স ৯ থেকে কমিয়ে ৮ করে যাতে কারখানায় শিশুদের সেই বাড়তি জোগানটা নিশ্চিত করা যায়, যেটা ঐশ্বরিক ও মানবিক বিধান অনুযায়ী পুঁজিপতিদের প্রাপ্য।’’ (পৃষ্ঠা-৩৫১)
কিন্তু কারখানার শ্রমিকরা সবটাই সহজে মেনে নিতে রাজি হলেন না। কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিতে তারা কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করতে থাকলেন। এই আন্দোলন প্রথমে ইংল্যান্ডে শুরু হলেও তা আমেরিকা হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মূল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকায়।
বিশ্ব-শ্রমিক আন্দোলনের কয়েকটি দাবির ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেই তার অর্থবহ উত্তরণ ঘটেছে। তার অন্যতম হলো দৈনিক শ্রম-ঘণ্টা কমানোর দাবিটি। তাই আমেরিকাতে প্রথম মে দিবসের আবির্ভাব ঘটলেও তা ছিল বিশ্ব-শ্রমিক আন্দোলনেরই পরিণতি, বিশ্ব-মেহনতিদের সংগ্রামের সাফল্য। পুঁজিবাদের যতই বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটেছে, ঢালের দিকে জলের গতির মতো মে দিবস অপ্রতিরোধ্যভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে।
কাজের সময়কে সংক্ষিপ্ত করতে সর্বহারার দাবি ও সংগ্রামের স্বতঃস্ফূর্ততার স্তর থেকে সংগঠিত সচেতনতায় উপনীত হবার মূহূর্তের নাম মে দিবস।
তাই ১৩৩তম মে দিবস আজও প্রোজ্জ্বল। মজুরি দাসত্বের অবসানের সংগ্রামে মে দিবস নিজের পতাকায় উৎকীর্ণ করে নিয়েছে সেই বজ্রবাণীকে - ‘‘সর্বহারাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, তাঁদের জয় করবার জন্য রয়েছে সারা দুনিয়া। দুনিয়ার মজদুর এক হও।’’
১ মে’র সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটিতে আমেরিকার প্রায় প্রত্যেকটি শিল্প-নগরীতে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের তুফান তুললেন আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণি।
সারা আমেরিকাতে প্রায় ১১,৫৬২ টি সংস্থার ৪০,০০০ শ্রমিক ধর্মঘট করেন। নিউ ইয়র্কে ৪৫,০০০ শ্রমিক ধর্মঘট করেন।
১ মে মিলিবিউতে ধর্মঘট করেন ১০,০০০ শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে।
১ মে, ১৮৮৬ তারিখে ধর্মঘটের নিট ফল হলোঃ যে সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক ওই দিন ধর্মঘট করছিলেন, তার মধ্যে ১,৮৫,০০০ শ্রমিক ওই দিনই বা ঠিক তারপরই ওই দাবি অর্জন করলেন।
মিলিবিউতে শ্রমিক ধর্মঘট চলতে থাকায় মালিক ও পুলিশ একযোগে উসকানি দেওয়া শুরু করল। ৩ মে মিছিলের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করল।
৩ মে তারিখে কারখানার অদূরে শ্রমিকরা এক সভা করে মালিকের সাথে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কেন্দ্রীয় লেবার ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছিলেন আগস্ট স্পাইস। তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন মালিক প্রায় ৫০০ পুলিশের সাহায্য নিয়ে ৩০০ দালালকে ফ্যাক্টরিতে ঢোকাবার চেষ্টা করে। শ্রমিকরা বাধা দিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ৬ জন নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়।
এই বর্বরোচিত ঘটনায় জ্বলে উঠল শ্রমিকরা। আগস্ট স্পাইস তাঁর ছাপাখানায় ফিরে গিয়ে ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় পোস্টার তৈরি করেন।
৪ মে, ১৮৮৬ সাল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে হে মার্কেটে জমায়েত শুরু হলো। পুরুষ মহিলা মিলে সাড়ে তিন হাজার মানুষের জমায়েত হলো। সভায় স্পাইস, পার্সনস ও স্যামুয়েল ফিলডেন পর পর বক্তৃতা করেন।
রাত প্রায় ১০টা। সভা শেষের দিকে। এমন সময় ২৮০ জনের পুলিশবাহিনী আসে এবং ক্যাপ্টেন জন বনফিল্ডের নির্দেশে ক্যাপ্টেন ওয়ার্ড সভা ভেঙে দেবার হুকুম করেন। এই সময় একটি বোমা বিস্ফোরণ হয় এবং একজন পুলিশ নিহত হন। ফলে পুলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালায়। বহু মানুষ নিহত হলেন এবং ২০০ জন আহত হলেন।
৪ মে, ১৮৮৬ সালের ঘটনায় যে শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁরা হলেন আগস্ট স্পাইস, স্যামুয়েল জে. ফিলডেন, ইউজিন সওয়াব, অ্যাডলফ ফিসার, জর্জ এঙ্গেল, লুইস লিংগ এবং অস্কার নিবি। পার্সনসকে পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ছ’সপ্তাহ পর তিনি নিজেই ধরা দিয়েছিলেন।
বিচারে সাতজনের ফাঁসির আদেশ হলো। অস্কার নিবিরের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হলো।
১১ নভেম্বর, ১৮৮৭ । সেই ব্ল্যাক ফ্রাইডে। সকাল ১১.৩০ মিনিটে শেরিফ ম্যাটসন ও জেলর কোলজ, চিকাগোর কুক কাউন্টি জেলখানার কুঠুরি থেকে পার্সনস, ফিসার, স্পাইস ও এঙ্গেলকে বের করে নিয়ে আসা হলো এবং সারিবদ্ধভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো।
১৩ নভেম্বর, ১৮৮৭ তারিখে পার্সনস, স্পাইস, এঙ্গেল ও ফিসারের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন চিকাগোর শ্রমিকশ্রেণি এক সুবিশাল সমাবেশের মধ্য দিয়ে। পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ শহরের রাস্তায় মিছিল করে, তাঁদের শেষ অভিবাদন জানালেন বীরদের উদ্দেশে।
যেহেতু ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সেন্ট লুই সম্মেলনে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’, ১৮৯০ সালের ১ মে তারিখে অনুরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত ইতিপূর্বে গ্রহণ করেছে, সেহেতু উক্ত তারিখটিকেই আন্তর্জাতিক বিক্ষোভের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়।
১৯২৩ সালের, ১ মে, মাদ্রাজ শহরে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার নেতৃত্বে এদেশে সর্বপ্রথম মে দিবস পালিত হয়। মে দিবস উপলক্ষে মাদ্রাজের দুটি স্থানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হাইকোর্টের বিপরীত দিকে সমুদ্র তীরের সভায় চেট্টিয়ার এবং ট্রিপ্লিকেন, সমুদ্র তটে অনুষ্ঠিত সভায় এম কৃষ্ণস্বামী শর্মা সভাপতিত্ব করেন।
ভারতের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। করোনা আবহে তা আরও বিদ্যুৎগতিতে তরান্বিত হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। প্রায় ২৫ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কেন্দ্রে আরএসএস পরিচালিত সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্তসুলভ বিজেপি সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছে। যে সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মনুবাদের উপর ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গীতা পড়ানো হচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরিধানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। একদিকে শ্রমিকদের মজুরি কমানো হচ্ছে অনদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্রুত গতিতে বাড়ানো হচ্ছে। পেট্রোল ও ডিজেলের দাম প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে মনিটাইজেশন পাইপলাইনের মাধ্যমে সরকার ৬ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে দেশের সর্বপ্রকার জাতীয় পরিকাঠামো মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ফলস্বরূপ ভারতের ১৪০ জন প্রথম শ্রেণির কোটিপতি তাদের আয় দ্বিগুণেরও বেশি করতে পেরেছে। পাশাপাশি রাজ্যে এক দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারী সরকার রাজ্যকে কাটমানি রাজে পরিণত করেছে। ক্ষমতা এবং অর্থের লোভে প্রতিনিয়ত তারা খুন, ধর্ষণ, পুড়িয়ে গণহত্যা ইত্যাদি অপকর্ম করে যাচ্ছে। শ্রমিক,কর্মচারী, ছাত্র যুব, মহিলা, কৃষকদের বেঁচে থাকার দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম পুলিশি অত্যাচারে দমন করা হচ্ছে। বর্তমানে তৃণমূল দল ও সরকার আরএসএস এবং বিজেপি’র স্বাভাবিক মিত্রে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই বিজেপি এবং তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি ও সমাজের অন্যান্য অংশের আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে। এই উভয় সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার দাবিকে জোরদার করে তোলাই হবে একমাত্র পথ।
দুনিয়ার মজদুর এক হও।