৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
২৭ এপ্রিল, ১৯৪৯’এর অমর কাহিনি
মালিনী ভট্টাচার্য
‘‘আমি সেই মৃত্যুহীন মাতৃহারা ‘সাতাশে এপ্রিল’ ’’
- কনক মুখোপাধ্যায়
রেণু চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তখন শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ওপরেই নয়, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা ছিল (Communists in the Women’s Movement, 1980)। কনক মুখোপাধ্যায় অবশ্য ‘নারীমুক্তি আন্দোলন ও আমরা’ (১৯৯৩) বইটিতে বলছেন, সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ২৭ এপ্রিলের ঘটনার আরো পরে, ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে। কিন্তু তাঁরও মতে, কলকাতায় ও গ্রামাঞ্চলে মহিলা সমিতি তার কাজের মধ্য দিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের বিষনজর টেনেছিল অনেক আগে থেকেই। ‘ঘরে-বাইরে’সহ তার মুখপত্রগুলি আরো আগেই বেআইনি ঘোষিত হয়েছে এবং বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ১৯৪৯-১৯৫১ সালের মধ্যে শ্রমিক কৃষক শিক্ষিকা নার্স ছাত্রী গৃহিণীসহ মহিলা সমিতির শতাধিক কর্মী ও নেত্রী প্রেসিডেন্সি জেলে আটক থেকেছেন।
এমন এক কালপর্বে ১৯৪৯ সালের ২৭ এপ্রিল এই সংগঠন থেকে ভারতসভা হলে মেয়েদের সভা ডাকা এবং সেখান থেকে মিছিল নিয়ে বেরোনো হিম্মতের ব্যাপার ছিল তাতে সন্দেহ নেই। রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে তাঁদের মা-বোনেদের নিয়ে গঠিত ‘মায়েদের সমিতি’র সঙ্গে একত্রে ডাকা হয়েছিল এই সভা। অনেক মানুষ তখন বিনাবিচারে বন্দি ছিলেন, জেলের অভ্যন্তরে কয়েদিদের ন্যূনতম অধিকাররক্ষায় ও তাদের ওপর নানা অত্যাচার বন্ধ করার জন্য অনশন চালাচ্ছিলেন কমিউনিস্টরা। সভায় এই অনশনব্রতীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে প্রস্তাবগ্রহণ করা হয় ও শোভাযাত্রা বার করা হয়। এই শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন হাওড়া, হুগলি, ২৪পরগনার কৃষক মেয়েরা এবং কলকাতার বস্তিবাসী ও মধ্যবিত্ত নারী। সুতরাং সরকার ও পুলিশের গায়ে জ্বালা ধরার কারণ ছিল।
কিন্তু এসব জানার পরেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় এই ঘটনা যে, সদ্য স্বাধীনতা-পাওয়া দেশে দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাজপথে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র নারীদের এক মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে সরাসরি চারজন নারীকে খুন করল পুলিশ, রাস্তায় পাওয়া গেল গুলিতে নিহত এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের দেহ (পরে জানা যায় তাঁর নাম বিমান ব্যানার্জি), আরো কয়েকজন নারী ও পুরুষ এই ঘটনায় গুরুতর আহত হলেন। যে মেয়েরা শহিদ হলেন সেই লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত ও গীতা সরকার ছিলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রথম সারির কর্মী। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁদের কেউ কেউ অর্জন করছিলেন। রাজবন্দিদের মুক্তির ও তাঁদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানানোটাই ছিল তাঁদের একমাত্র অপরাধ! ২৭ এপ্রিল চার শহিদের রক্তে চিহ্নিত হয়ে আছে বলে আমরা এইদিনটিকে বিশেষভাবে মনে করি। কিন্তু এই তারিখের আগেপরে ১৯৪৮এর ২৬ মে এবং ১৯১৯এর ২৭ জুন মেয়েরা বন্দিমুক্তির দাবিতে আরো দুটি বিশাল মিছিল বের করেছিলেন বলেও হিসাব পাই আমরা (রেণু চক্রবর্তী; অমলেন্দু সেনগুপ্তঃ উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব, ১৯৮৯); পুলিশের লাঠি কাঁদানে গ্যাসের নিরেট বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সে মিছিলগুলিকেও।
একদা ব্রিটিশ সেনাপুলিশের অত্যাচারের শিকার-হওয়া সদ্য গণতন্ত্রের আলোয় আসা দেশে গণতান্ত্রিক দাবিতে সোচ্চার হতে গিয়ে মেয়েরা আক্রান্ত কেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে সে সময়ের প্রেক্ষাপটটির দিকে তাকাতে হবে আমাদের। আনন্দবাজার পত্রিকা এই মৃত্যুগুলিকে ‘শোচনীয় ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল, কিন্তু এর জন্য দায়ী করেছিল সম্পূর্ণভাবে কমিউনিস্টদেরই। পুলিশের আগাম ‘প্রতিষেধক’ ব্যবস্থাগ্রহণ না করার সমালোচনা করলেও কোনো নিন্দাই করা হয়নি গুলিচালনার। পত্রিকার বক্তব্য, ‘একটা হাঙ্গামা সৃষ্টি করিতে হইবে এই উদ্দেশ্য লইয়াই সুপরিকল্পিতভাবে প্রস্তুত হইয়া কমিউনিস্টদের দ্বারা এই মহিলা শোভাযাত্রা বাহির করান হইয়াছিল’ (অমলেন্দু সেনগুপ্ত)। সন্দেহ নেই ১৯৪৮এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে যে নতুন রাজনৈতিক লাইন গৃহীত হয়েছিল, যার কুড়িদিনের মধ্যে সরকার পার্টিকে নিষিদ্ধ করে এবং ১৯৫১ সালে পার্টি হঠকারিতার জন্য আত্মসমালোচনা করে নিজেই যে লাইন বর্জন করে, আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে তারই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের মিছিল যে একটি গণতান্ত্রিক দাবি নিয়েই, সেকথাটি চাপা দিয়ে কমিউনিস্টদের ‘হাঙ্গামা সৃষ্টির’ই এক উদাহরণ বলে তাকে তুলে ধরাটাই সম্পাদকীয়ের উদ্দেশ্য। ১৪৪ ধারার মধ্যে মিছিল তাঁরা কেন বার করল এটাই যেন গুলিচালনার অজুহাত! যেন বিনাবিচারে আটক এবং জেলের মধ্যেকার অত্যাচার নিয়ে চুপ থাকাই উচিত ছিল!
১৯৪৫-৪৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারাদেশের নানাপ্রান্তে যেসব অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানগুলি ঘটছিল, যার মেজাজ ছিল লিগ-কংগ্রেসের নেতাদের দরকষাকষির রাজনীতির একেবারে বিপরীত, যার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত অংশগ্রহণ করছিলেন, ১৯৪৭এর আগস্টে দেশভাগের রক্তসিক্ত স্বাধীনতা আসার পরে তার প্রেক্ষাপটটাই পালটিয়ে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানের তীব্রতা যেসময়ে হ্রাস পাচ্ছে, সেসময়েই কমিউনিস্টরা ভেবেছিলেন তার বিভিন্ন তরঙ্গের পুরোভাগে থেকে তাকে বেগবান করে পরাক্রান্ত বিপ্লবের স্রোতে তাকে মিলিয়ে দেওয়া যাবে, সঠিকভাবেই এটা পরে চিহ্নিত হয় ‘হঠকারিতা’র একটি লক্ষণ বলে।
কিন্তু গণ-আন্দোলনকে যেমন ওপর থেকে নির্দেশ দিয়ে শুরু করানো যায় না, তেমনই ইতিহাসের গতি উলটোদিকে ঘুরলেই যে তাকে সঙ্গে সঙ্গে মুলতবি করে দেওয়া যাবে এমনটাও হতে পারে না। বস্তুত ১৯৪৯-৫০ সালেও কমিউনিস্টদের ডাকা রেল ধর্মঘট সফল হল না ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে তখনও অনেক জায়গায় ট্রেড ইউনিয়নের লড়াই যেমন পুরোদমে চলছিল, তেমনই এইসময়েই তেলেঙ্গানাতে নেহরু-প্যাটেলের সেনাবাহিনী নিজামের রাজাকারদের জায়গায় সংগ্রামরত কৃষকদেরই আক্রমণ করছে দেখে শেষোক্তরা গেরিলালড়াই চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। বাংলার কয়েকটি অঞ্চলে জোতদারদের সঙ্গে মিলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তেভাগার লড়াইয়ে যুক্ত কৃষকদের ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার এই সময়েই চালাচ্ছিল স্বাধীন দেশের সেনাপুলিশ। এ আন্দোলনগুলির পুরোভাগে থেকে ক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত লক্ষ্যে তাদের নিয়ে যেতে পারবেন এটা ভাবা নিশ্চয়ই হঠকারিতা ছিল। কিন্তু কমিউনিস্টরা কি পারেন প্রতিরোধী মানুষকে পরিত্যাগ করতে? তাঁরা তা করেননি। সেটাই পুলিশ প্রশাসনের বুকে আতঙ্ক জাগিয়েছিল।
অমলেন্দু সেনগুপ্ত একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করেছেন চিত্ত মৈত্রের জবানিতে। ‘লতিকা-প্রতিভা যেদিন মারা গেল - সেদিন সন্ধ্যায় এক যাত্রার আসরে ঢুকে আমরা ক’জন আচমকা বক্তৃতা শুরু করি। লোকে প্রথমে বুঝতে পারে না। ভাবে এটাও বোধহয় যাত্রা। পরে বুঝতে পেরে আমাদের তাড়া করে। তারা তো যাত্রা শুনতে এসেছে’ (পৃঃ ৩৫৫)। এ যে ১৯৪৫এর নভেম্বরের বা ১৯৪৬এর ফেব্রুয়ারির কলকাতা নয়, এ তারই একটি ইঙ্গিত। কলকাতার বুকে চারজন মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী পুলিশের গুলিতে নিহত এটা জানাতে সংবাদমাধ্যম বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি সর্বসাধারণের মধ্যে তেমন তরঙ্গ তোলেনি। তেমনই গ্রামাঞ্চলে যে অত্যাচার এবং প্রতিরোধ তখনও ছাইচাপা আগুনের মতো জায়গায় জায়গায় ধূমায়িত হচ্ছিল, তা দাবানলের ব্যাপক চেহারা নেয়নি। এটাও যেমন বাস্তব, তেমনই বাস্তব সিকিউরিটি আইনের নামে নতুন সরকার যে গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করছে মানুষকে সেবিষয়ে জাগরূক করার জন্য কমিউনিস্টদের এবং তাদের নারীসংগঠনের আগুয়ান ভূমিকা নেবার দায়বদ্ধতা। জনসাধারণ বিষয়টি নিয়ে এখনই উত্তাল হতে রাজি নয়, একথা বলে কি চুপ করে বসে থাকাই তাদের উচিত হত?
রাষ্ট্র যে শ্রেণিশাসন বজায় রাখার যন্ত্র একথা তো কার্ল মার্কস বহুদিন আগেই বলে গেছেন। আজ ভারতে আমরা রাষ্ট্রের দণ্ডধারীদের যে সম্পূর্ণ উলঙ্গ স্বৈরাচারিতা দেখছি তার যেমন একটি বিশেষ প্রেক্ষাপট আছে, তেমনই একথা ভুললে চলবে না যে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই শাসক যদি মনে করে তার আসন বিপন্ন তাহলে সে তার গণতন্ত্রের মুখোশ ছেড়ে দাঁতনখ বার করবেই। রাষ্ট্রকে সে প্রতিরোধের বিরুদ্ধে এক ব্রহ্মাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবেই, অন্যসময়ে নিজের দক্ষিণমুখ যতোই সে বজায় রাখুক। সে ভালোই জানে তার আসন উলটে দিতে পারে কারা। এই কারণেই ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা যেসব জন-আন্দোলনের মধ্যে ছিল, সেগুলিকে সম্পূর্ণ উৎখাত করতে তারা এত উদ্যোগী হলেও সেই বছরেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালার মূর্তি বসানো ঠেকাতে তাদের ততো সচেষ্টতা ছিল না। ঠিক সেই বছরেই মহাচীনে কুয়োমিনটাং-এর বিপুল শক্তিকে ঝেঁটিয়ে পাশে সরিয়ে সেখানে কমিউনিস্ট জমানার প্রারম্ভ সূচিত হচ্ছিল। হয়তো শাসকশ্রেণির বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল ঘরের কাছে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনও।
২৭ এপ্রিলকে স্মরণ করার সময়ে এই কথাগুলি মনে রাখতে হবে এই কারণেই যে, অমিয়া-লতিকা-প্রতিভা-গীতার শহিদিকে যদি প্রকৃত সম্মান দেখাতে চাই তাহলে সেই সময় থেকেই একে কমিউনিস্টদের ‘হঠকারিতা’ এবং তাদের ‘হাঙ্গামা সৃষ্টি’র প্রবণতার প্রেক্ষাপটে দেখার যে শাসকপক্ষীয় বয়ান তৈরি করা হয়েছে তাকে খণ্ডন করা আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব। এশহিদি তো ক'টি মেয়ের রাজনীতির পুতুল বনার কাহিনি নয়, এ আমাদের পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থারই এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেপথে ভুলভ্রান্তির মাশুল যেমন দিতে হয়, তেমনই সংগ্রামী মানুষের ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রগতির যুক্তিকে আলোকিত করে তোলে, আজকের মৃত্যু নিজের গর্ভে ভবিষ্যতের জীবন্ত সম্ভাবনাকে বহন করে।