৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
মায়াপুরের নবনির্মিত মন্দির ও কয়েকটি প্রশ্ন
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যানার ঝুলিয়ে এটা করা যায় না। এখনও আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে, ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।
ইসকন মন্দির কর্তৃপক্ষ তাদের সাইটে ২১শে আগস্ট, ২০১৯-এ লিখেছে -
“পশ্চিমবঙ্গ সরকারের (পূর্বে কমিউনিস্ট অধ্যুষিত) সঙ্গে এক দশকের দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে কিছু ভালো খবর আসছে।
শ্রীধাম মায়াপুরের ৭০০ একর জমি, বিভিন্ন ব্যক্তির শিরোনামে থাকা, শীঘ্রই একত্রিত হতে চলেছে যাতে ইসকন আনুষ্ঠানিকভাবে এর সমস্ত মালিকানা নিতে পারে। জমির মূল্য আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্ট্যাম্প শুল্ক, নিবন্ধন এবং অন্যান্য স্থানান্তর ফি, মোট প্রায় ৬০ লক্ষ ডলার, (অর্থাৎ ৪৫.৭ কোটি টাকা) মকুব করা হচ্ছে কারণ ইসকন একটি অলাভজনক সংস্থা।” [অনুবাদ লেখকের]
আসুন, গলা জড়িয়ে আনন্দে নেত্য করি।
এই মন্দিরের প্রশংসা শোনা গেল নিউটাউনের বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে ষষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে। শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র কী ঠিক জানি না, তবে দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সজ্জন জিন্দল এদিন রাজ্য সরকারকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন মায়াপুরের নবনির্মিত মন্দির প্রসঙ্গে। ইসকনের হাতে ৭০০ একর জমি তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। তাতেই নাকি খুশির হাওয়া বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে।
মন্দির তৈরি হচ্ছে সরকারি মদতে এক লপ্তে পাওয়া ৭০০ একর জমিতে। ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে মন্দির বিক্রি হচ্ছে।
সেক্যুলার দেশে শ্মশান-ব্রাহ্মণ বা মৌলবি ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে অপরিসীম অনিষ্ট সাধন হয়েছে। হয়ে চলেছে।
এইসব ক্ষতি একদিনে বোঝা যায় না, এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি।
মন্দিরের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি সরকারি হস্তক্ষেপে গ্রহণ আগে হয়নি। যারা ধর্ম প্রচার করেন, তারা মন্দির করবেন। এভাবেই তো চলেছে এই রাজ্যের মন্দির, মসজিদগুলো। অসুবিধা তো হয়নি।
যারা আরেকটা মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দির বা কাম্বোজের আঙ্কোর ওয়াট মন্দিরের খোয়াব দেখছেন, তাদের মনে করিয়ে দেই এসব হয়েছে মধ্য যুগে।
আজকে অগ্রাধিকার পালটে গেছে। আজকে ছেলেমেয়েরা শিখতে চায়, কাজ চায়।
যারা ধর্ম নিয়ে থাকতে চায় তাদের জন্য মন্দির কি কম পড়েছে!
এই মন্দির হচ্ছে ইসকন মায়াপুরে - এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। সেখানকার প্রেক্ষাপট অনেকের জানা - নবদ্বীপের ইতিহাস কীভাবে গায়েব হয়ে মায়াপুর হলো। সেই মায়াপুরে সরকারের বদান্যতায় ইসকন ৭০০ একর জমিতে মন্দির করছে।
কেন?
ওদের জমি দিলে আরও যত হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, আদিবাসী উপগোষ্ঠী আছে - তারা কেন পাবে না?
অন্যরা মোটা ভোট দিতে পারে না বলে?
যে রাজ্যে জমির জন্য শিল্প হয় না সেখানে মন্দিরের জন্য বিপুল জমি নেওয়া হবে! যে রাজ্যে গঙ্গা নদীর দু'পাড়ের সব জমি তিন ফসলি সেখানে হবে মন্দির।
সবচাইতে বড়ো কথা সরকারের কাজ কী? ধর্মের ভিত্তিতে জমি, ভাতা দেওয়া নাকি রাজ্যের মানুষের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন করা!
মায়াপুর বা দীঘায় মন্দিরের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও কলকাতা শহরে শ্মশান-ব্রাহ্মণদের ভাতা দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’র বিরুদ্ধে, হনুমান মূর্তি তৈরির সরকারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই চলে না।
ধর্ম দিয়ে ধর্মের লড়াই হয়েছে মধ্য যুগে, ক্রুসেডে।
কংগ্রেস এই নরম হিন্দুত্ব প্রচেষ্টা নিয়েছিল, হেরে ভুড্ডু হয়ে গেছে।
সে পথ পরিত্যক্ত।
একদিন এসব বড়ো বড়ো কথায় গাল ভরবে না, মন্দিরে অসন্তোষ প্রশমিত হবে না, ভাষার আবেগ কাজ করবে না।
অসম্মান, অত্যাচার, ভীতি প্রদর্শন, ধর্ষণ, ধর্ম ও বর্ণ ভিত্তিক বিভাজনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই দীর্ঘমেয়াদি।
তার জন্য দরকার ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ব্যতিরেকে মানুষকে একজোট করা, মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা।
দীর্ঘদিন বাদে দিল্লিতে একেবারে সব হারানোদের পাশে দাঁড়িয়ে বামেদের একত্রিত লড়াই দেখে আশাবাদী হলাম।
আগামীকাল আরও ঐক্যবদ্ধ হোক, দানা বাঁধুক এই লড়াই।