E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯

জাহাঙ্গিরপুরীর ধ্বংসকাণ্ড

অমিতাভ রায়


সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বেআইনী উচ্ছেদ রুখতে বুলডোজারের সামনে বৃন্দা কারাত ও অন্যান্য পার্টিনেতৃত্ব।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে জাহাঙ্গিরপুরী কত দূর? দূরত্বের হিসেবে উনিশ-বিশ কিলোমিটার। আর সময়ের নিরিখে, গাড়িতে পঁচিশ-তিরিশ মিনিট। যানজট হলে বেশি। আর লালবাতি লাগানো গাড়িতে আরও অনেক কম।

তবুও এপ্রিল মাসের কুড়ি তারিখে কী জানি কী কারণে সকাল এগারোটায় জারি করা সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ জাহাঙ্গিরপুরীর উচ্ছেদ অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে গেল। টিভি এবং সমাজমাধ্যমের দৌলতে তামাম ভারতবর্ষ সকাল এগারোটায় জারি করা স্থগিতাদেশ কয়েক মিনিটের মধ্যে জেনে গেল। পুলিশ অফিসারদের স্মার্টফোনের পর্দায়ও হয়তো খবরটা দেখা গিয়েছিল। তবুও তাঁদের এককথা - যতক্ষণ না আদালতের মোহর লাগানো কাগজ হাতে না আসছে ততক্ষণ অভিযান থামানো যাবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতের নির্দেশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেওয়ার অনেক আগে সেখানে পৌঁছে গেলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাত। আদালতের নির্দেশনামা হাতে নিয়ে চালু বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে স্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলেন, “আর এক ইঞ্চিও নয়।”

থমকে গেল সাত সাতটা বুলডোজার। তড়িঘড়ি ছুটে এলেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। সেদিনের মতো স্থগিত রইলো উচ্ছেদ অভিযান।

।। দুই ।।

জাহাঙ্গিরপুরীর সঙ্গে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের কোনো সম্পর্ক নেই। এখনকার দিল্লি হরিয়ানা সীমান্তের কাছাকাছি এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই সময় কোনো জনবসতি ছিল না। তার অনেক পরেও এই এলাকা ছিল নির্জন প্রান্তর। জরুরি অবস্থার সময় রাজধানীর অভিজাত এলাকার বস্তিবাসীদের উৎখাত করে এখানে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করা হয়। রীতিমতো অনুষ্ঠান করে জাহাঙ্গিরপুরীর শিলান্যাস করা হয়। পরিবার পিছু সাড়ে বাইশ বর্গ গজ অর্থাৎ সিকি কাঠা জমি দিল্লি প্রশাসনের তরফে বরাদ্দ করা হয়েছিল। নবনির্মিত বস্তির ভেতরকার রাস্তা, নর্দমা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদির বন্দোবস্ত প্রশাসনই করে দেয়। অর্থাৎ জাহাঙ্গিরপুরী অবৈধ আবাসিক এলাকা নয়। সরকারি বয়ানে এই জনপদের নাম - ঝুপড়ি ঝুগ্গি কলোনি। লোকে জে জে কলোনি বলতেই অভ্যস্ত। উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য থেকে আসা গরিব মানুষ যারা এতদিন অভিজাত দিল্লিতে সরকারি বাবুদের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবার কাজে কয়েক প্রজন্ম ধরে নিযুক্ত ছিল তাদের ঠাঁই হলো জাহাঙ্গিরপুরীতে। হারিয়ে গেল তাদের রুটিরুজির এতদিনের পুরোনো ব্যবস্থা। কাজেই খুঁজে নিতে হলো রোজগারের নতুন পন্থা।

কাছেই ছিল উত্তর দিল্লির জঞ্জাল জড়ো করার জায়গা। অনেকটা কলকাতার ধাপার মাঠের মতো। তবে আকারে আয়তনে অনেক বড়ো। সেই জঞ্জাল থেকে প্লাস্টিক, লোহার টুকরো, তামা-পিতল ভাঙা ইত্যাদি বাছাই করার পর বাজারে বিক্রি করে চলত প্রতিদিনের খাদ্যের সংস্থান। এবং বিষয়টি মোটেও সহজ ছিল না। কারণ সেই সময় যাতায়াতের ব্যবস্থা মোটেও সুগম ছিল না।

তবুও তারা টিকে ছিল। হারিয়ে যায়নি। ঘরে ঘরে যক্ষ্মা। প্রায় প্রত্যেকেই চর্ম রোগে আক্রান্ত। সারাদিন ধরে জঞ্জাল ঘাঁটলে চর্মরোগ না হওয়াই অস্বাভাবিক। তবে পরবর্তী প্রজন্ম গাড়ি মেরামত থেকে শুরু করে ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে আছে। মেট্রো রেলের প্রথম পর্যায়ের হলুদ লাইনের প্রান্তিক স্টেশন জাহাঙ্গিরপুরীতে নির্মিত হওয়ায় নতুন সহস্রাব্দে যাতায়াত সহজ হয়ে গেছে। উপার্জন বেড়েছে। বেড়েছে জনসংখ্যা। ২০০১-এ হয়েছে প্রথম আদমশুমারি। সিকি কাঠা জমির উপর গড়ে তুলতে হয়েছে দোতলা-তিনতলা। প্রায় প্রতি পাড়ায় নির্মিত হয়েছে মন্দির। মসজিদও আছে। মসজিদের আজান এবং মন্দিরের আরতিতে কোনও লড়াই নেই। রামনবমী, শিবরাত্রি, ইদ, হোলি, দেওয়ালি এখানে মিলেমিশেই উদ্‌যাপিত হয়। অন্তত ২০২২-এর ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত এমনটাই ছিল জাহাঙ্গিরপুরী।

গোলমাল শুরু হলো শনিবার, ১৬ এপ্রিল হনুমান জয়ন্তী উদ্‌যাপনের সময়। হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে সংগঠিত সশস্ত্র মিছিল আচমকাই মসজিদের সামনে প্ররোচনা সৃষ্টি করে। শুরু হয় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হাতাহাতি মারামারি ইট পাটকেল ছোঁড়া ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ নীরব দর্শক। দিনের শেষে ছয় পুলিশ কর্মী সহ দু’পক্ষেরই অনেকে আহত। নামের পরিচয়ে তারা হিন্দু অথবা মুসলমান হলেও আসলে দিন-আনি দিন-খাই ধরনের দরিদ্র পরিবারের সদস্য।

।। তিন ।।

এখানে ঘটনার সমাপ্তি হলে নিশ্চয়ই ভালো হতে পারত। কারণ এই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার অভিঘাত দিল্লির অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু বাস্তবে তা হতে না দিয়ে অন্য অজুহাতে আবার জাহাঙ্গিরপুরীতেই আক্রমণ হানা হয়েছে।

বিজেপি’র দিল্লির রাজ্য সভাপতি আদেশ গুপ্তা মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের (এনডিএমসি) মেয়রকে লেখা এক চিঠিতে দাবি করলেন যে জাহাঙ্গিরপুরীর অবৈধ নির্মাণকে অবিলম্বে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। মেয়র দেরি করেননি। তিনি তো সদ্য বিজেপি’র সদস্য হয়েই মেয়র হয়েছেন। তিনি দিল্লি পুলিশকে জানিয়ে দিলেন একটি “অধিগ্রহণ বিরোধী অভিযান”-এ সহায়তার জন্য জাহাঙ্গিরপুরীতে ৪০০ পুলিশ মোতায়েন করতে হবে।

বুধবার, ২০ এপ্রিল সকাল ৮টার আগে, জাহাঙ্গিরপুরীতে পুলিশ, সিআরপিএফ এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের একটি বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এসে যায় সাতটি বুলডোজার। পরে জানা যায় সেগুলি উত্তর প্রদেশের হরদোই থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। দিনে ৮ হাজার টাকা ভাড়া। ডিজেল-মোবিল ইত্যাদির খরচ আলাদা।

সকাল সোয়া দশটা নাগাদ শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। বাসিন্দারা কী ঘটছে তা দেখার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সাথে সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় লোকেদের সরু গলিতে আটকে রেখে নিজেরা ছাদে উঠে যায়। সংবাদে প্রকাশ, এক হাজারের বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল।

সকাল সোয়া দশটায় প্রথম বুলডোজারটি কুশল সিনেমা চকে প্রবেশ করে। পুলিশ ব্যারিকেড পেরিয়ে গিয়ে একটি খাবারের গাড়িকে দুমড়েমুচড়ে ভেঙে দিয়ে একটি বিড়ি-সিগারেট, কোল্ড ড্রিঙ্কসের কিয়স্কের কিছু অংশ ভেঙে দেয়। কোল্ড ড্রিঙ্কস ঠান্ডা রাখার জন্য ধার করে কিস্তিতে কিনে আনা তিনটি ফ্রিজের এই অবস্থা দেখে বিক্রেতা কান্নাকাটি শুরু করলে পুলিশ কর্মীরা বিক্রেতা ও তার পরিবারকে তাদের বািড়র ভিতরে নিয়ে যায় এবং বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে বলে, “যব খতম হোগা খুল দেঙ্গে (এটি শেষ হলে তালা খুলে দেব)”।

সাড়ে দশটা নাগাদ কাজ শুরু করে দ্বিতীয় বুলডোজার। ঘটনাস্থল সেই কুশল চক। আসলে কুশল চকের পাশেই রয়েছে জাহাঙ্গিরপুরীর সি-ব্লক। সেটাই সম্ভবত মূল লক্ষ্য। কারণ সি-ব্লক বাংলাভাষী মুসলমান অধ্যুষিত বলেই পরিচিত।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন যে যখন এনডিএমসি-র কর্মীরা আসে তখন একদিন আগে জানিয়ে দেয়। বাসিন্দারা আগাম সতর্কতা অনুযায়ী নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে সরিয়ে রাখে। এবার একেবারে সরাসরি আক্রমণ।

সকাল এগারোটায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ জারি হওয়া সত্ত্বেও দু’ঘন্টা ধরে চলে বুলডোজারের ধ্বংসকাণ্ড। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের খবর জাহাঙ্গিরপুরীতে ছড়িয়ে পড়লে অনেক মুসলিম বাসিন্দা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মসজিদ থেকে বুলডোজারগুলো পিছু হটছে বলে ধারণা করা হয়। বেরিয়ে যাওয়ার পথেও সারাদিনের কাজের শেষ ছোঁয়া হিসেবে বুলডোজারগুলো আরও কয়েকটি দোকান, বাড়ির সিঁড়ি এবং বারান্দা ভেঙে ফেলে। কিন্তু দুপুরে মসজিদের কাছে বুলডোজার ফিরে আসে। ভেঙে দেয় মসজিদের দরজা। টিভি ক্যামেরায় আরও পনেরো মিনিটের জন্য ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত ছিল।

মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী অবৈধ নির্মাণ সে স্থায়ী বা অস্থায়ী যাই হোক না কেন অপসারণের জন্য পাঁচ থেকে পনেরো দিনের নোটিশ দিতে হয়। এমনকী এমন নোটিশের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার আইনেই রয়েছে। শাসক কবেই বা আইন মেনে চলে!

ধ্বংসের কাজটি দুপুর দুটোয় শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অথচ কোনো অজ্ঞাত কারণে সকাল ন’টায় শুরু হয়ে যায়। জাহাঙ্গিরপুরীর জি-ব্লক, ডি-ব্লক ও অন্যান্য কয়েকটি ব্লকও অল্পবিস্তর ধ্বংসের শিকার। তবে সি-ব্লকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।

পরিকল্পিতভাবে জাহাঙ্গিরপুরীর ধ্বংসের ছক কাটা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশ, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বিরুদ্ধ জনমত ইত্যাদি সামাল দিতে বিজেপি এখন অন্য সুরে প্রচার শুরু করেছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উৎখাতের জন্য এই বুলডোজার আক্রমণ চালানো হয়। অথচ জাহাঙ্গিরপুরীতে যে বাংলাভাষী মানুষের বসবাস তারা মূলত মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া এবং মালদহের বাসিন্দা। নির্মাণ কাজেই এরা জড়িত।

প্রচারের এ এক অন্য মাত্রা হলেও এর ব্যাপ্তি অনেক সুদূরপ্রসারী। ২০১৪ থেকেই বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের উপর আস্তে ধীরে আক্রমণ শুরু হয়েছে। যেসব এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে বাঙালির বসবাস সেইসব এলাকার মাছের দোকানগুলো বিভিন্ন অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল। যেখানেই প্রতিবাদ হয়েছে সেখানে বিভিন্ন উৎসবের সময় করপোরেশনের নোটিশ জারি করে মাছ বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই বছরের নবরাত্রি উৎসবের সময় চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকার মাছের দোকানগুলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলে সর্বত্র প্রতিবাদ হয়। তবে নোটিশ ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। এবং বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষকে বাংলাদেশি বলার প্রবণতা কমেনি। বরং বেড়েই চলেছে।

জাহাঙ্গিরপুরীর সংগঠিত ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে। সিপিআই(এম) ছাড়া অন্য কোনো দল ঝাঁপিয়ে পড়েনি। একদল মৌলবাদী ধর্মান্ধ নিজেদের হিন্দুত্ববাদ প্রসারের জন্য মুসলিম ধর্মালম্বীদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ভয়ঙ্কর আধিপত্যবাদী আক্রমণ শুরু করেছে। একই সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলা বিদ্বেষ। আদালতে আইনি লড়াই চলছে। পাশাপাশি সিপিআই(এম) প্রদর্শিত পথে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন একমাত্র কর্তব্য।