৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট
দরিদ্রশ্রেণির উচ্চশিক্ষার অধিকার কেড়ে নেবার হাতিয়ার
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
কোভিড অতিমারীজনিত সংকট-ঘন সামাজিক ও আর্থিক টালমাটাল সময়ের মাঝে সমস্ত সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে লঙ্ঘন করেই ২০২০ সালের ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাশ হয়ে যায় জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০। ১৯৮৬ সালের পূর্বতন জাতীয় শিক্ষানীতির আমূল ভোলবদল ঘটিয়ে শিক্ষায় রাজ্যের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অধিকারের তোয়াক্কা না করে, সংসদে ন্যূনতম বিতর্কের অবকাশ না রেখে সম্পূর্ণ একতরফাভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধনের এই পরিকল্পনা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। আর যত সময় যাচ্ছে, একথা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধা থাকছে না যে, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণকে সংকুচিত করে করপোরেট শ্রেণির লাভের মৃগয়াক্ষেত্র রূপে তাকে গড়ে তোলার দায়বদ্ধতা থেকেই মূলত নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কোভিডকালীন অস্থির সময়ের সুযোগ নিয়ে অতি-তৎপরতার সাথে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের এই উদ্যোগের পিছনে লুকিয়ে থাকা উদ্দেশ্যগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
শিক্ষায় পূর্ণমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ এবং সমাজের পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির শিক্ষার অধিকারকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতির অংশরূপেই অতি-সম্প্রতি ইউজিসি কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে স্নাতকস্তরে ভরতির জন্য কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট বা সিইউইটি গ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা। ইতিপূর্বে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভরতির জন্য সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কমন এন্ট্রান্স টেস্ট বা সিইউসিইটি-র সর্বভারতীয় স্তরে পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে সিইউইটি-র অধীনে ৪৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে এবং পাশাপাশি রাজ্যস্তরের সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ডিমড বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই পরীক্ষার মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীদের ভরতির সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ, ইউজিসি কর্তৃক সিইউইটি সংক্রান্ত নির্দেশিকার নিরিখে ৬ এপ্রিল, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি দ্বারা বর্তমান বছরে স্নাতকস্তরে ভরতির প্রবেশিকা পরীক্ষার [সিইউইটি(ইউজি)-২০২২] বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক স্তরে ভর্তির এই একমাত্র পরীক্ষায় বসতে গেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দিতে হবে ৬৫০ টাকা, আর্থিকভাবে অনগ্রসর ও অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির পড়ুয়াদের দিতে হবে ৬০০ টাকা; এমনকী তফশিলি জাতি, উপজাতি বা বিশেষভাবে সক্ষমদেরও দিতে হবে ৫৫০ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই আর্থ-সামাজিকভাবে এমন একটা বিপন্ন সময়ে এই পরীক্ষা আয়োজনের বাস্তবতা, গরিব, পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা সহ এই ধরনের অভিন্ন সর্বভারতীয় পরীক্ষার আয়োজনের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব সংক্রান্ত নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে বহু সঙ্গত প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উত্থাপিত হয়ে চলেছে।
১. কোভিড-উত্তর সময়ে দেশজুড়েই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের দুরাবস্থার নানান চিত্র বিবিধ সমীক্ষার হাত ধরে উঠে আসছে। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আমাদের দেশের নানা প্রান্তে স্কুল ড্রপ-আউট ছাত্রীদের বাল্যবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি, ছাত্রদের কায়িক শ্রমে যুক্ত হয়ে যাওয়া সহ শিক্ষাক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাবে ভয়াবহ মলিন ছবি উঠে এসেছে। বেকারি, দারিদ্র্যের হাত ধরে মূলত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার আওতাধীন একটা বড়ো অংশের ছেলেমেয়েরা কার্যত শিক্ষাক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গেছে। সাম্প্রতিক এক স্ট্যাটাস রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ওডিশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে ৮০ শতাংশের বেশি সরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লক-ডাউনের সময়কালে কোনোরকম শিক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতা পায়নি। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বহু ছাত্রছাত্রীই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। মাধ্যমিকের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে শিক্ষকরা অনুভব করতে পারছেন, সরকারি বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা বিগত সময়কালে ন্যূনতম পড়াশোনার সাথে সংযোগ রাখতে সক্ষম হয়নি।
আর্থ-সামাজিক ও সার্বিকভাবে এমন বিপর্যস্ত সময়ে দেশের সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত ছিল, শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আরও সহজ এবং সরল করে তোলা। উপযুক্ত আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে শিক্ষার মূলস্রোতে সকলকে ফিরিয়ে আনার মতো ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা। এমন বিপন্ন সময়কালে সমাজের সাধারণ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পাশে মানসিকভাবে থেকে তাদের উচ্চশিক্ষার পথকে প্রসারিত করাই ছিল রাষ্ট্রের নৈতিক দায়। ২০০৯ সালে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার আইনে সার্বিকভাবে সব শ্রণির শিক্ষায় অংশগ্রহণ ও অগ্রগতির পথে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার যে দিক নির্দেশিত হয়েছিল, আজ যেন আমরা সম্পূর্ণ তার বিপ্রতীপ অবস্থানে বিরাজমান। শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহমর্মিতার স্থানে তার উপস্থিতি আজ বেনিয়ার ভূমিকায়। কেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির প্রবেশাধিকার পেতে এমন বিপন্ন সময়েও এত টাকা দিয়ে একজন ছাত্রকে আবেদন করতে হবে? বর্তমান বছরেই ৪৫টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিইউইটি-র মতো সর্বভারতীয় স্তরের এই অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা আয়োজনের বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্তই এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, রাষ্ট্র যেন শিক্ষাক্ষেত্রে এই চরম বিভাজনমূলক অবস্থানের অপেক্ষাতেই ছিল। ‘জিডিটাল ডিভাইড’র ভয়াবহ প্রভাবে শিক্ষাব্যবস্থার টালমাটাল সময়কালেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবশ্যিকতা নিশ্চিতভাবেই এটা প্রমাণ করে যে, আজকের রাষ্ট্র সচেতনভাবেই চাইছে শিক্ষাব্যবস্থাতে আর্থিকভাবে সবলরাই সচল থাকুক। সিইউইটি-র এমন আয়োজনে আর্থিকভাবে সচ্ছল, শহুরে ছাত্রছাত্রীরাই যে কয়েক যোজন এগিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজের পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দরজা কার্যত বন্ধ করতে চাইছে এদেশের সরকার - এ বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
২. নানা রাজ্যে নানা বোর্ডের পরীক্ষার নম্বর প্রদানের পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়নের সমতা বিধানের লক্ষ্য থেইে এই কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আয়োজন বলে ইউজিসি-র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থা অসমতা দূর করতে আদৌ সহায়ক হবে? যে রাজ্যে কেন্দ্রের শাসকদলের সরকার রয়েছে, সেই রাজ্যগুলো তাদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির ক্ষেত্রে অচিরেই এই ব্যবস্থা মেনে নিতে চলেছে। ইতিমধ্যেই আসাম, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কর্ণাটক, গুজরাট, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো সিইউইটি-র মাধ্যমে স্নাতকস্তরে ছাত্র ভরতিতে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছে। আবার অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর এখনই এ পথে অগ্রসর না হবার সম্ভাবনাই প্রবল। অর্থাৎ শিক্ষানীতির প্রশ্নে সরাসরি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে এভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের বন্দোবস্ত করা হলো।
যে রাজ্য সরকার ইউজিসি-র সুপারিশ গ্রহণ করবে না, সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সিইউইটি-র পাশাপাশি আবার রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রবেশিকার জন্য পরীক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ দু’রকম ভিন্ন ধারার পরীক্ষার মুখোমুখি ছাত্রছাত্রীদের হতে হবে। আর্থ-সামাজিকভাবে কঠিন এ সময়ে যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ, সে সময়েই তাদের এভাবে বাড়তি চাপের মধ্যে ফেলে দেওয়া কতদূর যুক্তিসঙ্গত? আবার রাজ্যস্তরে এমন অভিন্ন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার দ্বারা স্নাতকস্তরে ভরতির ব্যবস্থা কায়েম করতে গেলে সিলেবাসেও তদনুযায়ী পরিবর্তন করতে হবে। সিইউইটি স্বাভাবিক নিয়মেই কেন্দ্রীয় বোর্ডের সিলেবাস অর্থাৎ এনসিইআরটি-র নির্ধারিত সিলেবাসকে মান্যতা দিয়েই হবে। প্রকৃতপক্ষে এমন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে রাজ্যগুলোর ওপর একটা প্রত্যক্ষ চাপ তৈরি করা হলো, যাতে সব রাজ্যই অদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ধাঁচে সিলেবাস তৈরি করতে বাধ্য হয়।
দেশের নানা প্রান্তের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষানীতি প্রণয়নের যে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে, এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই বৈচিত্র্য ও স্বতন্ত্র্যতার বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই সাংবিধানিকভাবে যুগ্ম তালিকায় ‘শিক্ষা’কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমন সিদ্ধান্তে সরাসরি শিক্ষায় রাজ্যগুলোর সাংবিধানিক অধিকারকেও অস্বীকার করা হলো। শুধুমাত্র অঙ্গরাজ্যগুলোর শিক্ষা বিষয়ক সাংবিধানিক অধিকারই নয়, এই ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বতন্ত্র মর্যাদা ও স্বাধিকারের প্রশ্নেও সরাসরি হস্তক্ষেপ। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তার ঐতিহ্য এবং শক্তি ও দুর্বলতার নিরিখে নিজস্ব মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রী চয়নের যে মৌলিক অধিকার এতদিন স্বীকৃত ছিল, এই ব্যবস্থাও সমূলে উৎপাটন করতে চায়। আজকের শাসকের ডিএনএ-তে যে-কোনো বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে কেন্দ্রীভূত শাসনের প্রতি, তার ‘এক দেশ - এক নীতি’ নামক ঢুলি আঁটা, একবগ্গা দর্শনের প্রতি যে আনুগত্য - এমন সিদ্ধান্ত যেন তার সাথে সাজুয্য রেখেই পরিকল্পিত ও রূপায়িত।
৩. সিইউইটি নামক এই অভিন্ন পরীক্ষাই স্নাতকস্তরে দেশজুড়ে সমস্ত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতির একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (১০+২) পরীক্ষা যে একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি ইউজিসি-র পক্ষ থেকে যতই দাবি করা হোক, এই পরীক্ষার জন্য আলাদা কোচিংয়ের আবশ্যিকতা থাকবে না, অদূর ভবিষ্যতে একে কেন্দ্র করে অবশ্যম্ভাবীভাবে দেশজুড়ে ফুলে-ফেঁপে উঠবে কোচিং ব্যবসা। এখনই নানা অন-লাইন সংস্থা দ্বারা এই পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য নানা বিজ্ঞাপন ফলাও করে প্রচার শুরু হয়ে গেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রক কর্তৃক ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের কোচিং সেন্টারগুলোর মোট ব্যবসার পরিধি প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী জেইই, এনইইটি, সিএটি, আইএএস, জিআরই, জিএমএটি প্রভৃতি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রবেশিকার প্রস্তুতির জন্য সারা ভারতে প্রায় ০.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যা ২০২৫ সালে হতে চলেছে প্রায় ১০.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণের হাত ধরে সিইউইটি-র মতো এমন অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতভাবেই আগামী দিনে এদেশে কোচিং ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করে তুলতে চলেছে। ভারতের শিক্ষাবাজারে পরিকাঠামোগত মূলধনী বিনিয়োগের পাশাপাশি করপোরেট পুঁজির হাত ধরে অন-লাইন শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিকল্প বাজারের সন্ধানে মরিয়া নানা সংস্থা। অ্যাসপায়ার সার্কেল নামের সামাজিক ক্ষেত্রের এক অ-লাভজনক সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে প্রায় ৩১৩ বিলিয়ন ইউএস ডলারের অন-লাইন শিক্ষার বাজার তৈরি হতে চলেছে। তথ্য বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে আমাদের দেশই অন-লাইন শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার। কোভিডের কল্যাণে অন-লাইন শিক্ষায় ২০১৯ সালের ৫৫৩ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এক বছরেই ২০২০ সালে পৌঁছে গেছে ২.২২ বিলিয়ন ডলারে। স্বাভাবিকভাবেই, কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট-এর নামে দেশজুড়ে আয়োজিত হতে চলা এই পরীক্ষা ব্যবস্থাও নিশ্চিতভাবেই এমন বিপুল বিনিয়োগের সাথে সাযুজ্য রেখেই নির্ধারিত।
একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় বদান্যতায় কার্যত স্নাতকস্তরের শিক্ষাব্যবস্থা আগামী দিনে অর্থনৈতিক মানদণ্ডের বিচারেই নির্ধারিত হতে চলেছে। দরিদ্র, পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির কাছে উচ্চশিক্ষাকে ব্রাত্য করে তোলার জন্যই এমন পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন ঘটানো হলো। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ (এনইপি-২০২০)-র বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল, এই নীতি মূলত শিক্ষায় করপোরেট পুঁজির বিনিয়োগকে আরও পুষ্ট করবে। সিইউইটি পরীক্ষা আয়োজনের এই পরিকল্পনা যেন তাকেই সিলমোহর দিলো। এ যেন সেই বর্ণাশ্রমভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরায় অন্য মোড়কে ফিরিয়ে আনার রাষ্ট্রীয় যোজনা। বৈদিক যুগে সমাজের উচ্চতর শ্রেণির জন্যই স্বীকৃত ছিল শিক্ষার অধিকার আর সমাজের নিম্নবর্ণের শূদ্রশ্রেণির মানুষ বংশানুক্রমে কায়িক শ্রমের পেশাগত কাজে যুক্ত থাকতে বাধ্য হতো। শিক্ষায় তাদের কোনো অধিকারই ছিল না। আজকের ভারতেও ব-কলমে সেই বন্দোবস্তই যেন পাকা করা হচ্ছে। শিক্ষার অধিকার, বিশেষত উচ্চশিক্ষার অধিকার কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা শ্রেণির হাতে। আর সমাজের খেটে-খাওয়া, দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য ততটুকু শিক্ষাই বরাদ্দ ঘাকবে, যাতে পুঁজিপতি শ্রেণির অর্ধশিক্ষিত, কম পয়সার মজুরের জোগান পাকাপাশি হয়। কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসাবিদ্যা সহ পেশাগত যে-কোনো বিষয়ের শিক্ষা ইতিমধ্যেই সাধারণ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুর্লভ হয়ে উঠেছে। সিইউইটি নামক এই পরীক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাধারণ উচ্চশিক্ষাও সমাজের দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির থেকে দূরে ঠেলে দেবার পাকাপাশি বন্দোবস্ত করা হলো।