৫৯ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ২৯ এপ্রিল, ২০২২ / ১৫ বৈশাখ, ১৪২৯
প্রয়াণদিনে কমরেড আব্দুল হালিম স্মরণে
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
১৯৬৬ সালের ২৯ এপ্রিল কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কমরেড আব্দুল হালিমের জীবনাবসান হয়। জন্ম বীরভূম জেলার নানুর থানার শরডাঙা গ্রামে। ১৯২২ সালে কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির পাঠাগারে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কাকাবাবুর। এই পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই আব্দুল হালিম কমিউনিস্ট পার্টিতে আসেন। কাকাবাবু লিখছেন, ‘‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রচারকে, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজকে জীবনের মহান কাজ বলে সে গ্রহণ করে নিল। আর কোনোদিন সে পেছনের দিকে ফিরে তাকায় নি। বিপদ ও কারাবরণ তাকে আপন বিপ্লবী কর্তব্য হতে কোনো দিন তো দূরে সরিয়ে নিতে পারেইনি, অনশন অর্ধাশনও তাকে দমাতে পারেনি।’’ (অরুণ চৌধুরী, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘জীবনের সংগ্রামে কমরেড আব্দুল হালিম’, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), হুগলি জেলা কমিটি, জুলাই ২০০২, পৃ-২০)। ১৯৩০-এর দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অজস্র বাধা বিপত্তি টপকে প্রবল ও প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন হালিম।
হালিমের একটা বিশেষ অবদান ছিল বন্দিশালার বন্দিদের মধ্যে থেকে অনেককে কমিউনিস্ট মতবাদে আকৃষ্ট করা। দুদিন অন্তর ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে জেলে ভরতো। ১২ বছর জেলে থেকেছেন। জেল জীবনটাকে তিনি বিপদ হিসাবে না নিয়ে সেটাকেও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার একটা ‘সুযোগ’ হিসাবে নিয়েছিলেন। জেলের ভিতর পার্টি গড়ে তোলার কাজটাকে তিনি সাফল্যের সাথে করেছিলেন কমিউনিস্ট কনসলিডেশন তৈরির মাধ্যমে। এই কনসলিডেশনে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে পার্টি জীবনে চলতে হতো। বন্দিশালাসমূহের কমিউনিস্ট সংহতিগুলি পার্টির সাংগঠনিক জীবনে কমরেড আব্দুল হালিমের একটা মহান অবদান বলে বিবেচনা করা হয়।
জীবনের মেয়াদ মাত্রই ৬৫, যদিও জীবনের শেষ ৪৫ বছর কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তোলার কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছিলেন, ‘‘৪৫ বছর ধরে সে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য তিলে তিলে আত্মদান করে গেছে, পার্টির বাইরে সে যে নিজের কোনো অস্তিত্ব রাখেনি - তার স্ত্রীকে সে পার্টিতে এনেছিল, তার সন্তানদেরও যে পার্টির বাইরে কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, এসব যদি আমাদের পার্টি সভ্যরা উপলব্ধি ক’রে থাকেন তবে অন্তত আমার মনে আর কোনো খেদ থাকবে না। আব্দুল হালিম কখনো আত্মপ্রচার করত না’’(পৃ-২৪)।
১৯২৪ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা আর ১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় মুজফ্ফর আহ্মদ গ্রেপ্তার হয়ে যান । ফলে পার্টির দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করে পার্টির অস্তিত্ব রক্ষা চরম বিপন্নতার সম্মুখীন হয়। এই কঠিন ও বিপন্ন সময়ে আব্দুল হালিম পার্টির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট আর বাঁধার মধ্যেও তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে একনিষ্ঠভাবে পার্টি গঠনের কাজ করে গেছেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ চালানো ছিল অতিশয় দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রিটিশরা এদেশের কমিউনিস্টদের গতিবিধির ওপরে চূড়ান্ত নজরদারি শুরু করে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের নজর এড়িয়ে সব কাজ করতে হতো। কর্মী কম, অর্থ নেই, এমনকী থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই - এই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েও হালিম দিবারাত্র পার্টির জন্যে পরিশ্রম করতেন। শুধু তাই না, একই সাথে পার্টিতে আসা কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষার দিকে হালিম লক্ষ রাখতেন। এই বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল - শুধু নিছক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। শ্রমিকদের সমাজতন্ত্রের মতবাদে আকর্ষণ করতে হবে। উপযুক্ত পদ্ধতিতে মার্কসবাদ শিক্ষা দিয়ে পার্টির ক্যাডার তৈরি করতে হবে। কৃষক সভার কাজ ও কৃষক আন্দোলনের ভেতর থেকেও কমিউনিস্ট কর্মী সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে নজর দেন। হালিম সবসময়ই গণসংগঠনের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতেন। গণ-আন্দোলনের মধ্যে সবসময়ই এগিয়ে যেতেন।
পত্রিকা ও পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচার ব্যতিরেকে মার্কসবাদী ভাবধারা জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যায় না - এই লেনিনবাদী নীতির প্রতি হালিমের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন সংগঠন গড়ে তোলার মোক্ষম হাতিয়ার হলো পত্রিকা। সে যুগে সাধারণ প্রকাশকেরা কমিউনিস্ট সাহিত্য প্রকাশ করতে চাইতেন না। প্রধান কারণ ছিল পুলিশের ঝামেলা। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও হালিম থমকে যাননি। গণবাণী, চাষী মজুর, দিনমজুর, লাঙ্গল, মার্কসবাদী, মার্কসপন্থী, আগে চলো, হিন্দিতে মজদুর, নয়া দুনিয়া, মজদুরো কা ডঙ্কা সহ অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশে যুক্ত ছিলেন। মুদ্রক, প্রকাশক ও সম্পাদক বা কর্মীদের গ্রেফতারের কারণে পত্রিকা প্রকাশ নিয়মিত সম্ভব হতো না। “তখন ছাপার জন্য প্রেস পাওয়াও খুব মুশকিল ছিল। বিভিন্ন নামে কাগজের ডিক্লারেশন নেওয়া, প্রেস জোগাড় করা, লেখা তৈরি করা, প্রুফ দেখা, গোপনে ছাপার কাগজ নেওয়ার ব্যবস্থা করা ও তাড়াতাড়ি বিভিন্ন স্থানে বিলি ও বিক্রয়ের জন্য প্রেরণ করার যাবতীয় ব্যবস্থা আব্দুল হালিমের উদ্যোগেই সম্পন্ন হতো”। ২/৩টি সংখ্যা প্রকাশের পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেকটা কাগজের কাছে এক থেকে তিন হাজার টাকা জামানত চাওয়া হতো। টাকা ছিল না, তাই নাম বদল করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকা তাঁর উদ্যোগে প্রকাশ করা হতো। এরকমভাবে চলতে চলতে একসময় সরোজ মুখার্জিকে সম্পাদক করে আব্দুল হালিমের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় গণশক্তি। পাশাপাশি পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র হিসেবে ইংরেজিতে সাইক্লো করা মাসিক পত্রিকা ‘দি কমিউনিস্ট' প্রকাশিত হতে থাকে। পুলিশের ঝামেলার ভয়ে প্রকাশক পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে, সেই অবস্থায় হালিম উদ্যোগ নিয়ে ‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউস’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত গণশক্তি পাবলিশিং হাউসের পক্ষ থেকেই মার্কসবাদী পুস্তিকা প্রকাশ করা হতো। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকার সময়ও তিনি ‘বলশেভিক’ নামে হাতে লেখা কাগজ বের করতেন ও বন্দিদের মধ্যে প্রচার করতেন। বিভিন্নভাবে চিঠিপত্র লিখে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা চালিয়ে তিনি অনেককে কমিউনিস্ট পার্টির দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন। এছাড়াও পরবর্তীতে পার্টির জনযুদ্ধ, মতামত, স্বাধীনতা, গণশক্তি, দেশহিতৈষী ইত্যাদি যেসব পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতো প্রত্যেকটিতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। সুধাংশু দাশগুপ্ত'র মতে, ‘‘মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো আর এক তরুণকে মার্কসবাদের আদর্শ প্রচারে এবং কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে বিশ্বস্ত সাথী হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর নাম হলো কমরেড আব্দুল হালিম; ...মার্কসবাদের আদর্শ প্রচারের জন্য একটার পর একটা মাসিক/ত্রৈমাসিক পত্রিকা তিনি বের করেছিলেন এবং ব্রিটিশ পুলিশ কর্তাদের নিষ্ঠুর অত্যাচার-উৎপীড়নের মধ্যেও ৪১ নং জাকারিয়া স্ট্রিটের একটি ছোট্ট কক্ষকে পার্টি কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ করে তুলেছিলেন। তখন তো পার্টিকে টিকিয়ে রাখাটাই ছিল প্রধান কাজ ’’(পৃ-৩৯)। সরোজ মুখার্জি লিখেছিলেন, “১৯৩০-৩৪ সালের যুগে কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর ও বাইরের মার্কসবাদ বিরোধী ঝোঁকগুলোর বিরুদ্ধে তিনি নির্মম সংগ্রাম চালাতেন” (পৃ-৩০)। এছাড়াও সেই সময় মার্কসবাদ সম্পর্কে প্রচারিত অনেক ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে হালিম সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখতেন। যেমন মার্কসপন্থী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, “কেহ সর্বহারা বিপ্লবী সাজিতেছে, কেহ সমাজতন্ত্র বিপ্লবী, কেহবা ছাত্রবিপ্লবী রূপে মজুরদের নেতৃত্ব করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছে”(পৃ-৩১)।
তাঁর চরিত্রের আর কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা না বললেই নয়। সুধাংশু দাশগুপ্তর মতে, “আদর্শের ক্ষেত্রে কোথাও তিনি আপস করেননি। তাঁর কাছে সহজে যাওয়া যেত এবং মতাদর্শ সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করা যেত। কমরেডদের সঠিক কাজের যেমন তিনি প্রশংসা করতেন, তেমনি কমরেডদের ভুল দেখিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য ছিল খুবই মধুর। অহমিকা বলে কোনো জিনিস তাঁর মধ্যে ছিল না... সাথী শব্দটির মর্যাদা দেওয়াটাই ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য’’ (পৃ-৪৩)। জ্যোতি বসুর কথায় বলতে হয়, ‘‘আব্দুল হালিমকে স্মরণ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে । বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবেন কত কষ্ট স্বীকার করে কত ধৈর্য নিয়ে এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোড়াপত্তন করতে হয়েছিল’’ (পৃ-৩৫)। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কমিউনিস্ট সংগঠনের ভিত্তিস্থাপন ও তারই উপর নির্মাণকর্মের মূল কৃতিত্ব কমরেড মুজফ্ফর এবং কমরেড হালিমের মতো মানুষের প্রাপ্য।... তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা অংশ ছিল লেখক আর স্বভাবে ছিল মানবিক গুণের প্রাচুর্য” (পৃ-৩৬)। আদর্শনিষ্ঠ এই মানুষটির ব্যবহার ছিল অনুকরণীয়। যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাকে ভালো না বেসে পারেননি। কমরেডদের তিনি নিজের ভাইয়ের মতো ভালবাসতেন। তাঁর নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, ধৈর্যশীলতা এবং মূলনীতির প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকার কথা উল্লেখ করতেই হয়।