৫৮ বর্ষ ২৪তম সংখ্যা / ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ / ১৫ মাঘ, ১৪২৭
ত্রিপুরার চিঠি
বিজেপি শাসিত ত্রিপুরায় নজিরবিহীন বর্বরতা
হারাধন দেবনাথ
প্রতিশ্রুতি ছিল ক্ষমতায় এলে কোর্টের রায়ে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করবে। কিন্তু ৩৪ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার প্রতিশ্রুতি পুরণের পরিবর্তে আন্দোলন দাবিয়ে দিতে নৃশংস আক্রমণের পথ বেছে নিল। প্রশাসনের বর্বরতা লক্ষ করলেন ত্রিপুরাবাসী। ২৭ জানুয়ারি পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে নিজেদের যন্ত্রণার কথা, ৮৪ জন শিক্ষককে হারানোর কথা জানাতে গিয়েছিলেন ১০৩২৩ শিক্ষক। সরকারের আশ্চর্যজনক নীরবতায় মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন অভিযানের মতো কর্মসূচি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। টানা ৫১দিন শীত উপেক্ষা করে চলছিল গণঅবস্থান। আন্দোলনের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান সমর্থন-সহযোগিতা দেখে আতঙ্কিত শাসক ২৭ জানুয়ারির ভোরে অবস্থানস্থল গুঁড়িয়ে দেয়। অভুক্ত শিক্ষক ও তাদের পরিবারের কান্নার ভাষা, লড়াইয়ের ভাষা বুঝতে চায়নি উদ্ধত সরকার। পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন ত্রিপুরার মানুষ। সিপিআই(এম)সহ বিভিন্ন সংগঠন সরকারের বর্বরতার নিন্দা-ধিক্কার জানিয়েছে। আওয়াজ উঠেছে লড়াইয়ের ভাষাতেই বিজেপি সরকারকে জবাব দেওয়া হবে।
তখন সকাল সাড়ে দশটা। প্যারাডাইস চৌমুহনিতে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখানো শুরু হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। পুলিশ ব্যারিকেড গড়ে আন্দোলন ভাঙতে। এখানে ক্লান্ত বিধ্বস্ত দুই জন আন্দোলনকারী অসুস্থ হন। সহযোদ্ধারা তাঁদের আইজিএম হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর লেখা পর্যন্ত তাঁদের চিকিৎসা চলছে।
প্যারাডাইস চৌমুহনিতে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে স্রোতের মতো আন্দোলনকারীরা এগিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে। আইজিএম গেটের সামনে পুলিশ আবার ব্যারিকেড গড়ে। কয়েক মুহূর্তে সেটিও ভাঙে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীরা চলে যান মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার রাস্তার প্রবেশ দ্বারে। সেখানে আরেকটি ব্যারিকেড গড়ে পুলিশ। সেখানে বিক্ষোভ চলে।
সাড়ে ১১টা নাগাদ আইজি(আইনশৃঙ্খলা) অরিন্দম নাথ মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অবরোধস্থলে আসেন। কথা বলেন পদস্থ আধিকারিক এসপি, এসডিপিও-র সাথে। কথা বলেন টেলিফোনে। কিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যান। এরপরই জলকামান চালায় পুলিশ। তবুও আন্দোলনকারীদের টলাতে পারেনি। জলে ভিজেও চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা আওয়াজ তোলেন, ভাত দাও, নইলে বুলেট দাও। অবরোধস্থলে বিক্ষোভে অনড় থাকতে দেখে পুলিশ অনেক টিয়ার গ্যাস ফাটায়। টিয়ার গ্যাসের বিষক্রিয়ায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। সাংবাদিকরাও ঘটনাস্থল ছাড়তে বাধ্য হন। কিছুক্ষণ পর আবার একইস্থানে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। আগরতলা পুর নিগম এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলাশাসক। এরপর পুলিশ, সিআরপিএফ লাঠিচার্জ শুরু করে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আহত হন। আহতদের মধ্যে শিশু সন্তানও রয়েছে। শিক্ষিকাদের লাথি মারে পুলিশ। পথচলতি মানুষও আহত হন। আইজিএম হাসপাতালের ভেতর ঢুকে লাঠিচার্জ করা হয়। নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের দরজার গ্লাস ভাঙে। তিন জন আহত হন। এরপরেও চলে আন্দোলন। অনেককেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরিস্থিতি বুঝে মুখ্যমন্ত্রী সরকারি বাসভবনে ঢুকতে পেছনের দরজা খোঁজেন। আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলার সৌজন্য দেখাবার সাহস দেখাননি। মূল রাস্তা এড়িয়ে শিশুবিহার স্কুলের রাস্তা ধরে বাসভবনে আসেন। যতদূর খবর জানা গেছে, ঘটনার সময় মুখ্যমন্ত্রী বাসভবনে ছিলেন না। অবরোধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলে যান।
দুপুর দেড়টা নাগাদ পুলিশের গুঁড়িয়ে দেওয়া গণঅবস্থানস্থল সিটি সেন্টারের সামনে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে জলকামান ছুঁড়ে, টিয়ার গ্যাস ফাটায় এবং লাঠিচার্জ করে পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনী। বটতলা পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে যায় আন্দোলনকারীদের। পথচলতি মানুষ আতঙ্কে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। চালকরা অটোরিকশা অন্যান্য যানবাহন নিয়ে চলে যায়। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন দাবিয়ে দিতে এরকম পুলিশি বর্বরতা কবে দেখেছে ত্রিপুরাবাসী তা প্রবীণরাও মনে করতে পারছেন না। বিজেপি জোট সরকার আসার আগে একটানা ২৫ বছর মানুষের লড়াইয়ের পাশে ছিল বামফ্রন্ট সরকার। নিজেদের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকা দাবি পূরণ করেছে বামফ্রন্ট সরকার। একইসঙ্গে কেন্দ্রের অনিচ্ছুক হাত থেকে দাবি ছিনিয়ে আনতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই হয়েছে সেই সময়কালে। মানুষ বলাবলি করছেন, ২০১৭ সালে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর একই বাসভবন ঘেরাও করেছিলেন বিজেপি। আন্দোলনের নামে বিজেপি কর্মীরা প্ররোচনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। বড়মুড়ার খামতিংবাড়িতে বিজেপি-র শরিক আইপিএফটি তিপ্রাল্যান্ডের দাবিতে চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল। ওরা উলঙ্গ নৃত্য করেছিল। টানা ১১ দিন জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখলেও পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিল। পথ অবরোধ মুক্ত করতে আলোচনার পথই খোলা রেখেছিল। কোনো ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসনকে সেই আন্দোলন দমাতে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। দুই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক ফের স্পষ্ট হয়েছে ২৭ জানুয়ারির ঘটনায়।