৫৮ বর্ষ ২৪তম সংখ্যা / ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ / ১৫ মাঘ, ১৪২৭
শান্তিনিকেতনকে আগুনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন উপাচার্য
গৌতম রায়
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেই দেশের সংবিধান বদলের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। দেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা, যার সঙ্গে প্রবহমান ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রয়েছে, যে সংবিধানের নির্যাসে রবীন্দ্রনাথের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনা নিহিত রয়েছে - সেই সংবিধানের মূল কাঠামোর বদল, বিশ্বভারতীর উপাচার্যের আসনে বসামাত্রই দাবি করবার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শিক্ষাবিদের আবরণের ভিতর দিয়ে আসলে তিনি কোন্ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রতিনিধিত্ব করছেন।তাঁর সেই প্রতিনিধিত্বের আবরণহীন নগ্ন স্বরূপটা গত কয়েকবছরে ধীরে ধীরে যেভাবে বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সবার আগে বলতে হয়, উপাচার্য নিজের হাতে রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে গড়া শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে হত্যা করছেন।
বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কার্যকালের প্রায় শেষ প্রান্তে তাঁর সময়কালটির পর্যালোচনা করলে এটাই পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, শান্তিনিকেতনকে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্গত করাটাই তাঁর এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনোদিন কেন্দ্রে যে রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করেছে, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির বিস্তার ঘটানোর জন্যে শান্তিনিকেতনের মাটিকে ব্যবহার করা হয় নি। জরুরি অবস্থার সময়েও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বভারতীর আচার্য ছিলেন। সেই দুঃসময়ের দিনেও কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্যে একটিবারও শান্তিনিকেতনের মাটিকে ব্যবহার করা হয় নি। আর আজ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বিভাজনমূলক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে জনমত তৈরির উদ্দেশে বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু রাজ্যসভার বিজেপি’র সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে শান্তিনিকেতনে, বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসের ভিতরে এনআরসি’র পক্ষে প্রচার চালাতে সাহায্য করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ চিরদিন বিপক্ষ মতকে সম্মান দিয়েছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। আর বিশ্বভারতীতে আজ উপাচার্যের খামখেয়ালিপনার সামান্যতম বিরোধিতা যিনি করছেন, তিনি উপাচার্যের রোষানলের শিকার হচ্ছেন। এই রোষানল থেকে বিশ্বভারতীর প্রবীণ অধ্যাপক, কর্মী, ছাত্র এমন কী বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংস্রবহীন মানুষ, যিনি হয়তো সামান্য একটা ক্যান্টিন চালিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করেন, চা বেচে সংসার চালান, রবীন্দ্রনাথের ছবি-শিল্পকর্ম সাইকেল ভ্যানে করে বিক্রি করে জীবনধারণ করেন - এঁরা কেউই উপাচার্যের রোষানল থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না।
বিশ্বভারতীর উপাচার্য আজ ঠিক সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’র হীরক রাজের আদলে, তাঁর যুক্তিহীন খামখেয়ালিপনা, যার গভীরে লুকিয়ে আছে আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘হিন্দুত্বে’র নয়া গবেষণাগার হিসেবে বিশ্বভারতীকে পরিণত করবার কদর্য কৌশল - সেই অপকীর্তির সামান্যতম বিরোধিতা করলেই সেই ব্যক্তির উপর চাপিয়ে আনছেন যন্তরমন্তর ঘরের মস্তিষ্কপ্রক্ষালনের কৌশল। সেই কৌশলের প্রয়োগে অতিমারীতে শান্তিনিকেতন এখন কার্যত একটি কারাগার। গোটা বিশ্বভারতী জুড়ে জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল। শান্তিনিকেতনকে এখন দেখলে হঠাৎ করে একজন নতুন মানুষের পক্ষে জেলখানা বলে ধরে নেওয়াটা আশ্চর্যের কিছু বিষয় নয়।
কালীমোহন ঘোষ কুমিল্লার চাঁদপুর থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায়, দীনবন্ধু এনড্রুজ, পিয়ারসন, এলমহার্স্ট, বিধুশেখর শাস্ত্রী, নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী, নন্দলাল বসু প্রমুখের সাথে কালীমোহন ঘোষের অবদান ছিল ঐতিহাসিক। তাঁর পুত্র শান্তিদেব ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান এবং নৃত্যধারার কাণ্ডারী। সেই কালীমোহন-শান্তিদেবের অত্যন্ত সাদামাটা, মাটির বাড়িটিকে কেবল পাঁচিল দিয়ে জেলখানার আদলেই ঘেরেননি বর্তমান উপাচার্য, সেই মাটির বাড়ির মূল প্রবেশদ্বারের মুখে করেছেন বিশ্বভারতীর কার পার্কিং! সেবাপল্লীতে অন্নদাশঙ্করের বাড়ি ‘ইতি’র সীমান্তে পৌঁছে গেছে পাঁচিল। অচিরেই হয়তো সে বাড়িও সর্বসাধারণের চোখের আড়ালে চলে যাবে। বিশ্বআত্মার অনুসন্ধান ও চর্চার যে আদর্শ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, সেই আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে সার্বিকভাবে বিনষ্ট করাই হলো বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর একমাত্র লক্ষ্য। বহুত্ববাদের চর্চাকে বিনষ্ট করতেই বর্তমান উপচার্য কোভিড ১৯-এর সম্ভাবনার বহু আগেই শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যশালী পৌষমেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।লোকজ শিল্পধারার প্রচার, প্রসার এবং সেইসব শিল্পের স্রষ্টাদের আর্থিক স্বাবলম্বন ছিল রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশ্বভারতীর নিজস্ব উৎপাদনের বাইরে স্থানীয় শিল্পী, এমন কী বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীরাও যাতে কোনো অবস্থাতেই শান্তিনিকেতন সংলগ্ন অঞ্চলে তাঁদের সৃষ্টির কোনোরকম বিপণন না করতে পারেন, সেজন্যে নিজের সার্বিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করছেন বর্তমান উপাচার্য। আর্থিকভাবে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় থাকা, সামাজিক বিন্যাসেও পিছিয়ে পড়া এইসব শিল্পীর গোটা বিপণন ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিতে বর্তমান উপাচার্য যে বিদ্বেষমূলক আচরণ নিয়ে চলেছেন, তাঁর সেই মানসিকতাকে সফল করতে সবথেকে বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন পুলিশ। বিশ্বভারতীর নিজস্ব জায়গার থেকে অনেকদূরে ভুবননগর (যেটি ভুবনডাঙা নামেও পরিচিত) সন্নিহিত অঞ্চলে গরিব শিল্প সামগ্রীর বিক্রেতা থেকে শুরু করে, চায়ের দোকান, সাইকেল সারাইয়ের দোকান, মোবাইল রিচার্জের ছোট্ট গুমটি- কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না উপাচার্যের রোষানল থেকে। এই দোকানদারদের উপর উপাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ যৌথভাবে এতোটাই মানসিক অত্যাচার চালাচ্ছে যে, এঁরা যদি ভবিষ্যতে চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার দায়ে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজীবীদের মতো আত্মঘাতী হন, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। বহু ছোটো ছোটো দোকানদার ব্যাঙ্ক, সমবায় ইত্যাদি থেকে সামান্য ঋণ নিয়ে তাঁদের ওইসব ছোটো ব্যবসা চালাচ্ছেন। উপাচার্যের মানসিক অত্যাচারে তাঁরা ঠিক মতো ব্যবসা চালাতে পারছেন না। ফলে ঋণের কিস্তির টাকাও তাঁরা ঠিক মতো শোধ করতে পারছেন না। সেই কারণে ব্যাঙ্ক ইত্যাদি থেকে এঁদের উপরে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রদের উপর উপাচার্যের খামখেয়ালিপনার আড়ালে যে রাজনৈতিক চাপ, তার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সংকল্প হচ্ছে। কিন্তু এইসব লোকজ শিল্পী, অত্যন্ত ছোট ব্যবসা করেন এমন মানুষ - তাঁদের উপর উপাচার্য, পুলিশ এবং ব্যাঙ্কের যে ত্রিমুখী চাপ, তার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের বিষয়টি কিন্তু এখনো শান্তিনিকেতন চত্ত্বরে সেভাবে দানা বাঁধেনি।