৫৮ বর্ষ ২৪তম সংখ্যা / ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ / ১৫ মাঘ, ১৪২৭
দুঃস্বপ্নের আতঙ্কে আজকের দিন
বনবাণী ভট্টাচার্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, ভারতও স্বাধীনতা লাভ করেছে - পার হয়ে এসেছে পঞ্চাশের মন্বন্তরও। সেই ভারতে সংবাদজগতের প্রখ্যাত এক ব্যক্তিত্ব ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের বিভীষিকা নিয়ে তাঁর এক প্রবন্ধ রচনা ফিরে দেখা বোধ হয় একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয়। সময় ১৯৬১ সাল। চারদিকে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষের আয়োজন। কিন্তু প্রাবন্ধিক, একটি অদ্ভুত বিষয় নিয়ে নিবন্ধ লিখতে চলেছেন, যে সম্পর্কে তাঁর চাক্ষুষ কেন, পরোক্ষ কোনো জ্ঞানের দাবিও তিনি করতে পারেন না। খুব দুর্ভাবনা মাথায় করে ঘুমোলেন। আর তারপরেই সেই ভয়াবহ স্বপ্ন।
স্বপ্নে তিনি দেখলেন, ‘‘এক দিগন্ত প্রসারিত বিরাট শ্মশান, যতদূর দৃষ্টি চলে তাহার সীমা নাই, শেষ নাই, চারিদিকে গভীর অন্ধকার।’’ তিনি শুনলেন এক অশরীরী বাণী - ‘‘ইহার নাম ভারত মহাশ্মশান।’’ প্রাবন্ধিক কতগুলি অস্বাভাবিক মূর্তি প্রথমে দেখলেন, তারপর আর একটি মূর্তি দেখলেন - ‘‘দেখিয়া মনে হয়, এককালে বোধহয় কান্তিশ্রী সবই ছিল। কিন্তু এখন ডিস্পেপসিয়া রোগগ্রস্ত অফিসের কেরানিবাবুদের মতো ইহার কঙ্কালসার দেহ, হাত পা গুলি সরু সরু। কোথা হইতে নর্দমার পাঁক তুলিয়া সর্বাঙ্গে লেপন করিয়াছে এবং বোধহয় তাহাতেই খুশি হইয়া পরমানন্দে নৃত্য করিতেছে। অশরীরী বাণী কহিল - ‘‘এই বাঙ্গলা সাহিত্য।’’ আমি কহিলাম, সে কী, ইহার মাথা নাই কেন? আর ইহার সঙ্গে নর্দমার পাঁকই বা কেন?’’
নিবন্ধকার উত্তর পাননি এবং নিজেও কোনো বিশ্লেষণ করেন নি। কিন্তু, সাহিত্য-রসিকরা তো বিলক্ষণ এর কারণ জানেন। যে ভাষায় একদিন মাইকেল-বঙ্কিম-নজরুল-সুকান্ত-সুভাষরা শব্দের মৌচাক বানিয়েছেন, যে ভাষায় কল্লোল একটা গোটা যুগকে কল্লোলিত করেছে, বিভূতিভূষণ ‘পথের পাঁচালী’ গেয়ে, তারাশঙ্কর ‘গণদেবতা’ জাগিয়ে সবাইয়ের সুস্থতার জন্যে ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ পৌঁছে দিয়েছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘হারানের নাতজামাই’দের দিয়ে বাঁচার পথের ‘চিহ্ন’ রেখে গেছেন, তার সাহিত্যের কান্তি সর্বাঙ্গ শ্রীময়। যে সাহিত্য ‘মধুবংশীর গলি’ চেনায় পরাণমাঝির হাঁক শোনায়, তার শরীর তো মজবুতই ছিল। শক্তি-সুনীল-বিমল কর সমরেশদের হাত, সে শরীরে দিয়েছে অনেক আধুনিকতার ছোঁয়া, তবুও তো ‘পথের দাবি’তে সোচ্চার কণ্ঠ সব। আর ‘বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনল মালা জগৎ জিনে’ যে, সে ভাষা, সে সাহিত্য তো কালান্তরের স্রোতে ভেসে চলেছেই। তবু সেই কালজয়ী সাহিত্যে, বাস্তবতা-আধুনিকতা আর শিল্প-সৌন্দর্যের খাতিরে, কাদা তো লেগেই চলেছে। ছুৎমার্গের প্রশ্ন নয়, কিন্তু নান্দনিকতার বদলে অশালীনতা যদি কালোত্তীর্ণ রসবোধ এবং মূল্যবোধকে আহত করে তার পঙ্কিলতা থেকে সাহিত্য রেহাই পায় কী করে? কী করে কাব্যহীনতাকে কাব্য-মূল্যে সমাদর করা সম্ভব? ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কাক, পাক, ঝুনঝুনি-টুনটুনি, রেললাইন-কডলাইন শব্দকে কবিতার সারিতে দাঁড় করালে বাংলা সাহিত্যের শ্রী, মর্যাদা, শক্তি আর থাকে কী করে? প্রকৃতপক্ষে ‘ক’ অক্ষর হিসেবে যাদের কাছে গোমাংস, যাদের বর্ণপরিচয় বা আদর্শলিপি-সহজপাঠ প্রভৃতি মকসো করলে লাভ হয়, তারা যদি কলম ধরলেই সাহিত্যিকের মর্যাদায় ভূষিত হন, বছর বছর নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশ হয় তাদের বইয়ের, তবে সে সাহিত্যের মাথা আর থাকে কী করে? শাসনদণ্ড হাতে সকলেই, ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’র লেখক, পণ্ডিত জহরলাল নেহরু হন না, কী উইনস্টন চার্চিলও হতে পারেন না। তার উপরে, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা যদি কলম ফেলে রাজা-রানিদের আসন-প্রসাধনে ব্যস্ত হয়ে নিজের জমিটুকু রক্ষা করতে মাটিতে মাথাটা ঠেকিয়ে ফেলেন, তবে মাথাটা যে মেরুদণ্ডের উপরে থাকে, সে মেরুদণ্ডটাই তো থাকে না, তবে আর মাথা থাকে কী করে - কন্ধ কাটাই হতে হয়। বাংলা সাহিত্যকে সেই কবন্ধে পরিণত করার চেষ্টা চলছে - তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও অবশ্যই চলছে।
প্রাবন্ধিকের স্বপ্ন দেখাও চলছে। স্বপ্নে দেখলেন আর এক কবন্ধ মূর্তি। ‘‘সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এই কবন্ধটির দক্ষিণ অঙ্গের সঙ্গে বাম অঙ্গের অনবরত লড়াই চলিতেছে। ...উলঙ্গ দেহ, ধূলাকাদা-মাখা মূর্তিটি কেবল লক্ষ্যহীনভাবে চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিতেছে। কিন্তু সম্মুখে এক পদও অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। অশরীরী বাণী ধীরে ধীরে কহিল - ‘এই বাংলার রাজনীতি’।’’
ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থীর সাথে বামপন্থীদের বিরোধ চিরন্তন, ১৯৬১’তেও ছিল। আজও আছে। নিবন্ধকার ১৯৬৭, ১৯৬৯ এবং ১৯৭৭ - ২০১১’র বাংলা যদি দেখেও থাকেন, তবু তো ১৯৬১ সালে, সেই রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বামেদের ভূমিকা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে তাঁর উত্তরসূরিরা জানেন নিশ্চয়ই, না - বাংলার রাজনীতি চক্রাকারে শুধু পরিভ্রমণই করেনি - যোজন যোজন মাইল এগিয়ে গেছে। যুক্তফ্রন্টের আমলে জমি দখলের লড়াই, বর্গা-রেকর্ডের প্রথম পর্যায়, বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনে ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ একর জমি গরিব কৃষক হাতে পেয়েছে। গান্ধীজির পঞ্চায়েতরাজের স্বপ্ন সফল করেছে বামেরা প্রতিবার নিয়মমত ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রেখে এবং গণতন্ত্রকে বিকেন্দ্রীকৃত করে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা - পরে পাঠ্যবই দান, শিক্ষকের বেতন ও মর্যাদা সুরক্ষিত করে অবসান করেছে শিক্ষাক্ষেত্রের নৈরাজ্য। মেয়েদের তেত্রিশ শতাংশ আসন সংরক্ষণ কার্যকরি করে, স্বায়ত্তশাসনে ৫০ শতাংশ আসনের সিদ্ধান্ত করে, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠনের মাধ্যমে একদিকে মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা অপরদিকে সমাজ গঠনে, সামাজিক উৎপাদনে তাদের ভূমিকাকে অবারিত করার চেষ্টায় ব্রতী থেকেছে বামেরা। সব থেকে বড়ো কথা, মেয়েদের অধিকার মর্যাদার সুরক্ষা যেমন সৃষ্টি করেছে তেমনি সুশাসনের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আর গণতান্ত্রিক ও সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করে রাজ্যবাসীর জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা সৃষ্টি করতে পেরেছে - পেরেছে রাজনীতিতে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতে।
স্বপ্ন দেখা চলছেই। ভয়ে নিবন্ধকার শ্মশানের মধ্য দিয়ে ছুটতে থাকছেন। ‘‘ছুটিতে ছুটিতে এক স্থানে একটা বীভৎস ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিয়া স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, ‘‘ছিন্নমস্তা’’ নিজের মুণ্ড নিজে কাটিয়া আপন রুধির আপনি পান করিতেছে। সর্বাঙ্গ রক্তধারায় রঞ্জিত। দুই পার্শ্বে - দুই বিকটাকার মূর্তি দাঁড়াইয়া তাহাই দেখিয়া অট্টহাস্য করিতেছে। ...অশরীরী বাণী গম্ভীর স্বরে কহিল, ‘‘এই বাঙ্গলাদেশ - ছিন্নমস্তারূপিণী, নিজের রুধির নিজে পান করিতেছে। আর ইহার একদিকে মামদোভূত, অন্যদিকে ব্রহ্মদৈত্য দাঁড়াইয়া অট্টহাস্য করিতেছে।’’
স্বপ্নদ্রষ্টা হয়তো, ১৯৫৪ সালে শিক্ষক-আন্দোলন স্তব্ধ করে শিক্ষকদের দাবি নস্যাৎ করে, শিক্ষার পায়ে বেড়ি দিয়ে রাজ্যের শিক্ষার গতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা দেখেছেন, হয়তো রাজ্যের অন্নদাতাদের ৮০ জনকে পুলিশের লাঠিপেটা করে ১৯৫৯ সালে শাসককে নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে দেখেছেন, কিন্তু ২০১১ সাল থেকে এ রাজ্যের প্রকৃত ‘ছিন্নমস্তাকে’ দেখার সৌভাগ্য (?) তাঁর হয়নি। তিনি দেখেননি তো দশ হাজার ছেলেমেয়ের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান এবং আনুষঙ্গিক কারণে আরও কয়েক হাজারের জীবিকার ব্যবস্থার ৯৫ শতাংশ হয়ে যাওয়া সিঙ্গুরের ন্যানো গাড়ির কারখানা বন্ধ করার আত্মঘাতী আন্দোলনে নিজের রুধির পানের পৈশাচিক দৃশ্য, দেখেননি নারী হয়েও তাপসী মালিকের সম্মান ও প্রাণের বিনিময়ে নিজের সিংহাসন ছিনিয়ে নেওয়ার কদর্যতা। দেখেননি, হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদের অন্যায় তোষণ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবার ঘৃণ্য কৌশল। দেখেননি সারদা-নারদার মতো অপরাধের মধ্য দিয়ে গরিব মানুষের টাকা আত্মসাৎ করে বাড়িতে এস্কেলেটর আর ছাদে সুইমিং পুল নির্মাণের মতো কুৎসিত লোক, দেখেননি নিজের দলের বাইরে কোনো দুর্নীতিবাজকে রাখতে। লুম্পেনবাহিনী দিয়ে গণধর্ষণ ও হত্যা, তোলাবাজদের দিয়ে মানুষের রক্ত জল করা পয়সার লুট, মানুষকে নিজের বাড়ি থেকে উৎখাত করানো, বিরুদ্ধ কথায় গ্রেপ্তার, মিথ্যে মামলায় জড়ানোর মতো অমানবিকতার চাষ করে মনুষ্যত্বহীন মানুষ তৈরির দানবীয় কারিগরের দেখা তিনি পাননি। আর এই মনুষ্যত্ব অবলুপ্তির সদশ্যুতায় সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম - সমস্ত ধ্বংসাত্মক কাজে ছিন্নমস্তার দু পাশে মাওবাদী কিষানজি এবং ব্রহ্মদৈত্যের মতন বিজেপি নেতৃত্ব থেকেছে। আজ শুরু হয়েছে সেই রুধির পানের রক্ত বমন।
স্বপ্নের শুরুতে প্রাবন্ধিককে অশরীরী ভারত মহাশ্মশান ও কতগুলি বীভৎস মূর্তি দেখিয়ে বলেছিলঃ ‘‘...ইহাদের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আছে, কেবল মাথা নাই, এবং সেই জন্যই ইহারা লক্ষ্যহীন পথে বিভ্রান্ত হইয়া ছুটিয়াছে! এই যে সম্মুখে - এর নাম হিন্দু সমাজ। এই বিরাট অতিকায় জীবটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সবগুলিই যেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন।... তাহার উপর উহার মাথা নাই, কাজেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি স্ব স্ব প্রধান হইবার চেষ্টা করিতেছে।’’
এ কথা তো ঠিকই খ্রিস্টান-ইসলাম-বৌদ্ধ-জৈনের মতো হিন্দুধর্মের তো কোনো পয়গম্বর বা মঁসিয়ে নেই। বিশ্বাস ও আচারের যুগযুগান্তরের এক বিবর্তিত রূপ হিন্দু ধর্মে আর্য আগমনের পর বৈদিক যুগের থেকে বেদ-উপনিষদ-সংহিতার মধ্য দিয়ে যার প্রাতিষ্ঠানিক রূপের প্রাপ্তি ঘটে। বৈদিক যুগের বর্ণাশ্রমে হিন্দু ধর্মের অনৈক্যের বীজ বপন করা হলো - ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপটে হিন্দুধর্মেরই নাভিশ্বাস দেখা দিল - বিপরীতে তাই জন্ম - বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের। শূদ্র-দলিত ঘৃণা কত মারাত্মক তার প্রমাণ - ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতি; নিম্নবর্ণের হওয়ার কারণে পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে সস্ত্রীক প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা। কোথাও একজন শঙ্করাচার্য - কোথাও একজন অদ্বৈত প্রধান হয়ে উঠেছেন। আর বিংশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্মকে রাজনীতির পণ্য করে ধর্ম হিসেবে নিকৃষ্ট স্তরে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে। হিন্দু মহাসভা - আরএসএস-জনসঙ্ঘ হয়ে রাজনৈতিক দল, বিজেপি’র রাজনীতির বেসাতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাকে। দেব-দেবীর আরাধনার বদলে, এই বিজেপি’র হাতে হিন্দুধর্ম এখন রাষ্ট্রের উপাসক। তাই শাসক বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। নানাভাবে তার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন, গণতন্ত্রের টুটি টেপা এবং সমস্ত ধর্মের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুর্বল হিন্দুধর্মকে এরা তার সঙ্কীর্ণতা দিয়ে ধর্ম হিসেবে করে তুলছে আরও হীনবল।
ধর্মীয় মেরুকরণ করে আসলে বিজেপি সরকার নিজের বাসভূমিকে খণ্ড-বিখণ্ড করছে, অশান্ত ও রক্তাক্ত করছে নিজেরই আশ্রয়কে। আর এই ব্রহ্মদৈত্যদের হাত ধরেছে বাংলার ছিন্নমস্তা। প্রেতের জগতের ক্ষমতার লড়াইয়ে এরা দৃশ্যত দা-কুমরো। তাই, স্বপ্নদ্রষ্টা প্রাবন্ধিক ১৯৬১’র রাজনীতিতে যা দেখেননি, তা দিব্যদৃষ্টিতে হয়তো এখন দেখতে পেতেন। দেখতে পেতেন যে, হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং বাংলার স্থানীয় শাসকদল ক্ষমতা দখলের জন্য কী জঘন্য যুদ্ধে নেমেছে, যেখানে দুদলেরই অস্ত্র কেবল অর্থ প্রলোভন আর সন্ত্রাস। তাই এই রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন উপলক্ষে নীতিহীন দুদলেরই নেতা-মন্ত্রী-কর্মীরা এবেলা-ওবেলা রঙ বদল করছে - জামা বদল করছে - পতাকা বদল করছে নির্লজ্জভাবে।
যে খেলাটা ওই ষাটের দশকে তেমন গুছিয়ে শুরু হয়নি - সেটাও প্রাবন্ধিক দেখতে পেতেন এই সময়ে - মিডিয়ার খেলা। সন্দেহ নেই ভোটের নিরিখে বামপন্থীদের শক্তি ক্ষয় হয়েছে - পুঁজির প্রভুদের কাছে যা চিরবাঞ্ছিত। সেই শক্তি নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে মিডিয়া বামফ্রন্টকে একেবারে মাঠের বাইরে রেখে দিচ্ছে। পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে, আতস-কাঁচ ফেলেও যাতে বামপন্থীদের দেখতে না পাওয়া যায় তারই উদ্যোগে আছে মিডিয়া। আর মিডিয়া এখন খবর সরবরাহ করার থেকেও দু দলের মক-ফাইট থেকে শুরু করে নেতা বা নেতা-মন্যদের ব্যক্তিগত জীবনের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, অসাধুতা, ব্যভিচার পরিবেশনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যে সমস্ত ব্যভিচারী, নীতিহীন কীটগুলোর নরকেও জায়গা পাবার যোগ্যতা নেই, তাদেরই সুবেশে, সুপরিবেশে মূল্যবান সামগ্রীর মতন মিডিয়া আম-দরবারে উপস্থিত করে রাজনীতির মানকে নিকৃষ্ট স্তরে নামিয়ে আনছে। অথচ মিডিয়া বাইরে রেখে দিলেও, আমফান-করোনা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক দুর্দশা - কৃষকের আন্দোলনে প্রতি মুহূর্তে মাঠে রয়েছে বামপন্থীরা। এই সত্যটাকে চাপা দিতেই মিডিয়া মরিয়া। আগামী নির্বাচনে বাংলার মানুষ বিজেপি এবং তৃণমূল দুই শত্রুকেই পরাস্ত করে বাম-কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতায় আনার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। মিডিয়ার শতচেষ্টা সত্ত্বেও, এই ছবিটাই দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মানুষের জীবনে বিজেপি না তৃণমূল, কে বড়ো শত্রু, মানুষ এই নিক্তি মাপা ওজনের ধার ধারে না। কিন্তু মিডিয়া দেশবন্ধু-নেতাজি-বিধান রায়-জ্যোতি বসু’র আদর্শ ও নীতি-নিষ্ঠ রাজনীতির অঙ্গনে, স্বার্থপর ব্যভিচারী, লোভী-প্রতারকদের আসন দিয়ে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যে কলঙ্কের পাঁকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে - উত্তরকাল কড়ায়-গণ্ডায় তার শোধ তুলবে।
নিবন্ধকার, এই বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখতে দেখতে যা মনে মনে ভাবছিলেন তা ব্যক্ত হয়েছেঃ ‘‘...প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীতে অনেক অতিকায় জীব ছিল দেখিতে ভয়ঙ্কর, অমিতশক্তিশালী। কিন্তু পৃথিবীর যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইহারা নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিল না, কাজেই ক্রমে ক্রমে ভূপৃষ্ঠ হইতে লুপ্ত হইয়া গেল।’’ প্রাবন্ধিক জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন, মানবসভ্যতার অত্যন্ত ক্ষতিকর এই দুই জীবের শোচনীয় অবলুপ্তি। দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক পার করে দেয় যে চিরসারথী, সেই জনগণেশের কাছে পরাভূত হবেই এই ভয়ঙ্কর মূর্তিধারী গণ-শত্রুরা।