৫৮ বর্ষ ২৪তম সংখ্যা / ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ / ১৫ মাঘ, ১৪২৭
দেশের আর্থিক বাজারে আজ কতটা বিপদ?
ঈশিতা মুখার্জি
২০২১ সালের আর্থিক বাজেট আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বরাবরের মতোই ফিনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট বা আর্থিক স্থায়িত্ব রিপোর্ট পেশ করল। এই রিপোর্টে দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব কত তার হাল হকিকত পেশ করা হলো প্রতি বছরের মতোই। এই রিপোর্টই এফএসআর রিপোর্ট নামে পরিচিত। এ বছরে এই রিপোর্ট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জানিয়েছে। ব্যাঙ্কের গভর্নরের ভালো ভালো কথার মোড়কে দেশের ঘনিয়ে-আসা আর্থিক বিপদের কথা এই রিপোর্টে প্রকাশিত হয়ে গেছে। দেশের সরকারের আগাগোড়াই দেশের অর্থনীতির মূল আর্থিক ভিত্তি নিয়ে যে আদৌ কোনো মাথাব্যথাই নেই, এই কথা আজ আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। আর্থিক স্থায়িত্ব বলতে আমরা কী বুঝি? আর্থিক স্থায়িত্ব বজায় রাখার এক বড়ো কাজ করে আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা। নয়া-উদারীকরণ এই জমানায় যখন কর্পোরেট লগ্নিপুঁজির হাত ধরে ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যায় তখন দেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক ভিত্তি বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে অনেক বদল হয়ে যায়। এমন বদল হয় যে, দেশের মানুষ বুঝতেই পারে না কোথায় সমস্যা আর তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথটাই বা কোথায়। আজ আমাদের দেশের ঠিক এরকমই অবস্থা।
কী জানা গেল এই এফএসআর রিপোর্টে? জানা গেল যে, দেশের ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোট ঋণের ১৩ শতাংশ থেকে ১৪.৮ শতাংশ হতে পারে। এর পরিমাণ গত এক বছর আগে ২০২০ সালে ছিল ৭.৫ শতাংশ। প্রায় দ্বিগুণ হবে এক বছরে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ। এটি বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানা যাচ্ছে। এই অনাদায়ী ঋণ বাড়ল কেন? ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার এক বড়ো দায়িত্ব হলো আমানতের নিরিখে বিনিয়োগ করার জন্য ঋণ দেওয়া। ব্যাঙ্ক যখন এই কাজ আর করতে পারে না তখন ব্যাঙ্ক ব্যাবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। বর্তমান সময়ে ঠিক এমনটাই হচ্ছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে করোনার সময়ে ঋণ নিয়েও উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি, তাই এত অনাদায়ী ঋণ থাকছে। কিন্তু ২০১৬, ২০১৭ সাল থেকেই তো এই সমস্যা রয়েছে। দেশে ক্রমাগতই বিনিয়োগ কমে এসেছে। ঋণ বেড়েছে কিন্তু বিনিয়োগ হয়নি, উৎপাদন হয়নি, ধীরে ধীরে মন্দা এসেছে দেশে। কিছু কিছু ঋণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু যে প্রকল্পের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছে সেই প্রকল্প কোনভাবেই দাঁড় করানো যায়নি। এরকম প্রকল্প আমাদের দেশে অনেক। অনেক সময় মনে করা হয় যে, একমাত্র ঋণই কোনো উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার সরকার বহুক্ষেত্রেই সেই পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করেনি। বিশেষকরে মোদী সরকারের আমলে সহযোগী সরকারি বিনিয়োগের অভাবে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের যে জনকল্যাণমুখী সরকারি ব্যয় করার কথা ছিল তা তো সরকার করেনি।
বেশ ক’দিন ধরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের যে বিপুল পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার উদ্দেশে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। সেই প্যাকেজের সবটাই ছিল ঋণদান প্রকল্প। মানুষ এই সময় আরও বেশি বেশি করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্রশিল্পের মানুষেরা। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে দেশের কৃষকেরা, তাই তারা আজ বিক্ষোভের পথে। এই ঋণ কিভাবে শোধ করা সম্ভব হবে যদি সরকার বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে জনকল্যাণমুখী খাতে খরচ করে দেশের উৎপাদনের চাহিদা তৈরি না করে, এই মন্দা থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ না নেয়। সরকার নেবে না, কারণ সরকার তা চায় না। সরকার ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকেই উলটে দিতে চায়। তাই ঘোষণা করা হলো খারাপ ব্যাঙ্ক আর অ-ব্যাঙ্ক বা যা আর ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করছে না। ব্যাঙ্ক ব্যাবস্থার বেসরকারিকরণ ঘটাতে ঘটাতে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকেই তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হলো। তাই অনাদায়ী ঋণ আর কমবে না, তা বেড়েই যাবে। আর একইসাথে একটি একটি করে ব্যাঙ্ক তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেল।
ব্যাঙ্ক মানুষের সহায়তা করবে, না মানুষের বিপদ ডেকে আনবে এই বেসরকারিকরণের মাধ্যমে তা মানুষ ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছে। অনাদায়ী ঋণের আর একটি বড়ো কারণ হলো কর্পোরেট লুঠ। একের পর এক বিজয় মাল্য, মেহুল চোকসি, নীরব মোদী নীরবে ব্যাঙ্কের সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গেছে। আজ তারা অপরাধী শনাক্ত হলেও, সেই টাকা কিন্তু ফেরত আসেনি। আদায় হয়নি দেশের সম্পদ। এই ক’টি নাম আমাদের জানা। কিন্তু এই হলো লুঠেরা কর্পোরেটের চরিত্র। এরকম আরও অনেকে আছে যাদের নাম আমাদের চোখের সামনে আসেনি। এই লুঠই দায়ী অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এই কালো দিনের সূচনা করার জন্য। সরকারের এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা বা নিয়ন্ত্রণ নেই, থাকবেও না। দেশের বিনিয়োগের পুঁজি আজ লুঠ হচ্ছে। আর এই রিপোর্ট জানাল যে, এই লুঠ চলতেই থাকবে। এর ফল হলো এই যে, ব্যাঙ্ক ব্যাবস্থা ভেঙে পড়বে, নোটবন্দির মতো ব্যাঙ্ক বাঁচাতে দেশের মানুষের উপর আরও আর্থিক চাপ নামিয়ে আনবে এই সরকার।
এই সরকারের পক্ষে এই নীতি গ্রহণ করা ছাড়া আর পথ নেই, কারণ তারা কর্পোরেটের কাছে দায়বদ্ধ, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নয়। এই বিপদ থেকে দেশের মানুষের পরিত্রাণ সম্ভব, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই ভবিষ্যদ্বাণী উলটানো সম্ভব একমাত্র যদি এই নীতির পরিবর্তন ঘটানো হয়। আগামী দিন বুঝিয়ে দেবে দেশের মানুষ এই বিষয়ে কী করেন - দেশের সরকার বদল করে অর্থাৎ নীতিবদলের দিকে এগিয়ে নিজের দেশ ও নিজেকে বাঁচাবেন, না কী না বুঝে কর্পোরেটের হাতে দেশের সম্পদ লুঠ করার ইজারা দেবেন। দেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।