E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৪তম সংখ্যা / ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ / ১৫ মাঘ, ১৪২৭

বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের উৎকট রূপ উন্মোচন করল অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট

অর্ণব ভট্টাচার্য


করোনা অতিমারীর সময়ে ভারতের ১১ জন সবথেকে ধনী ব্যক্তির যে পরিমাণ সম্পদ বেড়েছে তা দিয়ে আগামী ১০ বছর মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের কাজ চালানো সম্ভব। চাঞ্চল্যকর এই তথ্য জানিয়েছে অক্সফ্যামের সদ্যপ্রকাশিত রিপোর্ট ‘‘দ্য ইনিকুয়ালিটি ভাইরাস’’। বিশ্বের ৭৯টি দেশের ২৯৫ জন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ যাদের মধ্যে আমাদের দেশের জয়তী ঘোষ, মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাক্স, ফরাসি অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জাকম্যান প্রমুখ রয়েছেন তাদের তত্ত্বাবধানে এই ৮৩ পাতার যে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে একথা স্পষ্ট যে, এই অতিমারীর ফলে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হলেও ধনকুবেররা নিজেদের সম্পদ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই সম্পদ বৃদ্ধি যে এত বিপুল তা এই রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করতে পারতেন না। করোনা অতিমারীর জন্য সারা বিশ্বের গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষ যে চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার শিকার হয়েছেন সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে তাদের এক দশক সময় লাগতে পারে, অথচ বিশ্বের ধনকুবেররা মাত্র ন’মাসের মধ্যেই করোনা অতিমারীর আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাওয়ায় এই বিলিওনেয়াররা অতি দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। শেয়ার মার্কেটের ঊর্ধ্বগতি এই সময় লক্ষ করা গেছে যেখানে প্রকৃত অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিলিওনেয়ারের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৭-১৮ সালে প্রতি দুই ঘণ্টায় একজন করে বিলিওনেয়ার তৈরি হয়েছেন। আমজনতার আর্থিক অবনতির উল্টোদিকে বিলিয়নেয়ারদের এই অভাবনীয় শ্রীবৃদ্ধি এই সময়কালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সরকারগুলির কর্পোরেটমুখী নীতির দিকেই ইঙ্গিত করে।

অতিমারীর সময় বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশে ধনবৈষম্য কিভাবে আরও প্রকট হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

অতিমারীর সময়ে যখন এক দিকে কোটি কোটি মানুষ জীবিকা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন তখন ভারতের ধনকুবের বিলিওনেয়াররা তাদের আয় ৩৫ শতাংশ বাড়িয়েছেন। তাদের সম্মিলিত আয় এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালের সাথে তুলনা করলে বিলিওনেয়ারদের আয় ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। আমেরিকা, চীন, জার্মানি, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের পরে বিলিওনেয়ারদের সম্পদের নিরিখে ষষ্ঠ স্থানে ভারত। অক্সফামের এই রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম ধনী মুকেশ আম্বানির প্রতি ঘণ্টায় আয় ৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ভারতের ২৪ শতাংশ মানুষ মাসে ৩০০০ টাকা অর্থাৎ দৈনিক ১০০ টাকাও আয় করেন না। এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির নাম মুকেশ আম্বানি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনীব্যক্তিদের তালিকায় তার স্থান ষষ্ঠ। সরকারি বদান্যতায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুকেশ আম্বানির আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে প্রতি চারদিনে মুকেশ আম্বানির যে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটেছে তা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির ১,৯৫,০০০ কর্মীর সারা বছরের মোট আয়ের চেয়েও বেশি।

এই সময়কালে মুষ্ঠিমেয় মানুষ যখন সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে তখন ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অক্সফামের হিসেব অনুযায়ী বিগত বছরের শেষে প্রতিদিন ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ কেবলমাত্র ক্ষুধার্ত হয়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছেন। ভারত কিংবা ব্রাজিলের মতো দেশ তো বটেই ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হয়েছে আমেরিকার মতো উচ্চ আয়ের দেশের ১২ শতাংশের বেশি মানুষ। জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার প্রায় তিন কোটি মানুষ জানিয়েছিলেন যে, তারা বিগত এক সপ্তাহে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার খেতে পাননি।

অক্সফামের রিপোর্টে প্রকাশিত ক্রমবর্ধমান ও ভয়ঙ্কর আর্থিক বৈষম্য কেবল ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সমকালীন পরিস্থিতির সাথে তুলনীয়। সেই কতকাল আগে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস লিখে গিয়েছেন, “The executive of the modern State is but a committee for managing the common affairs of the whole bourgeoisie.” (আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সাধারণ বিষয়গুলি দেখভাল করবার কার্যকরী সমিতি মাত্র)। বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের মাঝে জনগণের সম্পদ হরণ করে কর্পোরেটের সম্পদের কুৎসিত বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রের এহেন চরিত্র আরও বেশি প্রকট হয়েছে। অধিকাংশ দেশের সরকার আমআদমির কথা মুখে বললেও আদতে প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্পোরেট সংস্থাগুলির খাস ভৃত্যের মতো আচরণ করেছে।

অক্সফ্যামের রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, আম্বানি একঘণ্টায় যা আয় করেন তা আয় করতে একজন অদক্ষ শ্রমিকের ১০ হাজার বছর লাগবে আর আম্বানির প্রতি সেকেন্ডের সমান আয় করতে তার তিন বছর সময় লাগবে। ধনী-দরিদ্রের আয়ের এরকম উৎকট বৈষম্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যখন আম্বানি,আদানি, বেদান্তর মতো কর্পোরেট সংস্থা মুনাফার পাহাড় তৈরি করছে সেই সময় এপ্রিল মাসে ভারতে প্রতিঘণ্টায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কেবল মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির যে বৃদ্ধি ঘটেছে তা দিয়ে এদেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৪০ কোটি শ্রমিককে পাঁচ মাস দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্ত রাখা যায়।

রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে যে, ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ এই অতিমারীর সময় সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই সময়কালে যে ১২ কোটিরও বেশি মানুষের কাজ গিয়েছে তার ৭৫ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী। বিশেষত মহিলারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং করোনা অতিমারীর আগে মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১৫ শতাংশ যা এই অতিমারীর পর বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে বেকারত্বের উচ্চহারের জন্য ভারতের জিডিপি আট শতাংশ কমে যাবে বলে মনে করছে এই রিপোর্ট।

এই সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান তখনই কাজে আসতে পারে যদি সরকার এর ভিত্তিতে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেয়। অক্সফামের রিপোর্টে এই চরম আর্থিক বৈষম্য লাঘব করা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শক্তিশালী করার জন্য ধনীদের ওপর সম্পত্তি কর আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। কেননা অর্থনীতিকে সতেজ করতে হলে,সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থিক দুর্দশা লাঘব করতে হলে সাধারণ মানুষের স্বার্থে করব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সঙ্কট ২০০৮ সালে নেমে এসেছিল তার পুরো বোঝাই সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হয়েছে। জনগণের স্বার্থে সরকারি ব্যয় এ সময়ে কমেছে আর অন্যদিকে ধনীদের কর ক্রমশ কমানো হয়েছে। ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ কর সংগৃহীত হয়েছে তার মধ্যে কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্সের অংশ মাত্র ১৩ শতাংশ এবং সম্পত্তি করের অংশ মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ করব্যবস্থা এমনভাবে বলবৎ করা হয়েছে যাতে করের চাপ পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর; আর কর্পোরেশনগুলি ক্রমাগত স্ফীতকায় হয়েছে। যে সমস্ত কর্পোরেট সংস্থা এই সঙ্কটকালে বিপুল মুনাফা করেছে সেইরকম সংস্থাগুলির উপর অন্তত সাময়িকভাবে হলেও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি কর আরোপ করার পক্ষপাতী অক্সফামের রিপোর্ট। এখানে হিসেব করে দেখানো হয়েছে যে, ৩২টি থেকে সবচেয়ে লাভবান কর্পোরেশনের কেবল বাড়তি লাভের উপর যদি ন্যূনতম সম্পত্তি কর বসানো হয় তাহলেই ১০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া যেতে পারে যা পৃথিবীর একটা বিপুল অংশের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে ব্যবহার করা যায়। রিপোর্টে বলা আছে যে, ভারতের ধনীদের অর্জিত সম্পদের ওপর ১ শতাংশ কর চাপালেই সরকারের জনৌষধি প্রকল্প বাবদ খরচ ১৪০ শতাংশ বাড়ানো যায়। এতে গরিব ও প্রান্তিক মানুষ সুলভে ওষুধ পেতে পারেন।

এহেন কাজ করা যে একেবারে অসম্ভব নয় সেটা আর্জেন্টিনার সরকার করে দেখিয়েছে। সে দেশে অত্যন্ত ধনীদের উপরে সাময়িকভাবে এই ধরনের কর বসানোর মাধ্যমে তিন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হয়েছে। যা করোনা অতিমারীর ভয়ঙ্কর প্রভাব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে সে দেশের সরকার। তবে এমন কোনো পদক্ষেপ আমাদের দেশে গৃহীত হবে এমন আশা করা বৃথা। অতিমারীর সময়েই আমরা দেখেছি যে, কিভাবে আমাদের দেশের রাজস্ব বিভাগের অফিসাররা ধনীদের ওপর সম্পত্তি কর বসানোর প্রস্তাব দেশের সরকারকে দেওয়ায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের এরকম প্রস্তাব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয় মোদী সরকার।

গত মার্চ মাস থেকে এখনো পর্যন্ত দেশের ১০০ জন বিলিওনেয়ারের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের ১৪ কোটি সবচেয়ে গরিব মানুষের মধ্যে এই বাড়তি আয় যদি বণ্টন করে দেওয়া যায় তাহলে প্রত্যেকে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা করে মাথাপিছু পাবেন। আমাদের দেশের ১১ জন সবচেয়ে বড়ো ধনী মিলিওনেয়ারের যে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তা দিয়ে আগামী দশ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য বাজেট হয়ে যাওয়া সম্ভব। অক্সফ্যামের হিসেব অনুযায়ী ভারতের ৯৫৪টি সবথেকে ধনী পরিবারের ওপর সম্পত্তি কর বসালেই জিডিপি’র ১ শতাংশ অর্থ উঠে আসা সম্ভব। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটতে রাজি নয় কেননা যে কোনো পরিস্থিতিতে কর্পোরেটের স্বার্থ সিদ্ধি করাই মোদী সরকারের প্রধানতম উদ্দেশ্য।

অক্সফ্যামের রিপোর্টে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্য নয় তার সাথে সাথে শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত এবং লিঙ্গ বৈষম্য যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। করোনা অতিমারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ভীষণ জরুরি। কিন্তু ভারতের ৫৯.৬ শতাংশ মানুষের জন্য একটি বা তার কম ঘর বরাদ্দ। সেক্ষেত্রে সংক্রমণ এড়ানো অত্যন্ত কঠিন। বাসস্থানের এই সঙ্কট এই করোনা অতিমারীর সময় স্বাস্থ্য সঙ্কটকে আরও গভীর করে তুলেছে।

গত নয় মাসে স্কুল বন্ধ থাকার জন্য ভারতের ৩২ কোটি ছাত্রছাত্রী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের ৮৪ শতাংশ সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করে এবং ৭০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে থাকে। আমাদের দেশে অক্সফ্যামের পক্ষে পাঁচটি রাজ্যে সমীক্ষা চালালে সরকারি স্কুলের ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা বলেছেন যে, অন্তত এক তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে ফিরে নাও আসতে পারে। পুরো দেশেই স্কুল ছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ নিয়ে দেশের সরকার আদৌ কোনো ভাবনা চিন্তা করছে কিনা তা জানা নেই। দলিত,আদিবাসী এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা বেশি পরিমাণে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে কারণ এই অংশের মানুষ আর্থিকভাবে বেশি অনগ্রসর। বালিকাদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট হবে কেননা তারা অসময়ে বিবাহ ও গর্ভধারণের মতো সমস্যার শিকার হতে পারেন বলে মনে করছে এই রিপোর্ট। বর্তমানে আমাদের দেশের যে অবস্থা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি তাতে এই সমস্ত আশঙ্কার একটিও অমূলক নয়।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেসের ভাষায় বলা যায় যে, কোভিড-১৯ সত্যিই একটি এক্সরে-র মতো যা আমাদের সমাজের ফাটলগুলোকে উন্মোচিত করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে যে ভ্রান্তি ও মিথ্যাচার সারা পৃথিবীতে চলেছে তাকে বেআব্রু করেছে। এই অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা সকলে এক নৌকার যাত্রী নই। বরং যখন কেউ কেউ বিলাসবহুল তরণীতে রয়েছে, বাকিরা খড়কুটো আঁকড়ে কোনমতে বাঁচবার চেষ্টা করছে। এই চূড়ান্ত অসাম্য এসেছে যে অর্থনীতির হাত ধরে তা নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি। অক্সফ্যামের রিপোর্টে খুব স্পষ্ট ভাষায় করোনা অতিমারীকালীন বিশ্বের যাবতীয় দুরবস্থার জন্য নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ উচ্চবিত্তদের হাতে চলে যাওয়াকে মূলত দায়ী করা হয়েছে। একে আরও ভয়ঙ্কর রূপ দিয়েছে পিতৃতান্ত্রিকতা ও শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের জন্যই সারা বিশ্ব ইতিমধ্যেই গভীর বৈষম্যের শিকার ছিল। সেই গভীরতাকে আরও ব্যাপক ও ভয়াবহ করে তুলেছে করোনা অতিমারী। আশির দশক থেকেই নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি যেভাবে অতীতের পুঁজিবাদী জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাকে বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তার জেরে সারা পৃথিবীতে সম্পদের কুৎসিত কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। গভীরতর শ্রেণিবৈষম্য সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য ও জাতিগত বৈষম্যকেও আরও প্রকট করে তুলেছে।

করোনার প্রকোপ চলার জন্য একদিকে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক উড়ান বন্ধ হয়েছিল, অন্যদিকে বেড়ে গিয়েছিল প্রাইভেট জেটের বিক্রি। এই বিশ্বের সুপাররিচ বিলিওনেয়াররা প্রাইভেট জেটে চেপে পাহাড়ি রিসর্টে যখন আমোদ আহ্লাদে মত্ত ছিলেন তখন বিশ্বের সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। করোনার আগে সবাই খুব সুখে ছিল এমনটা নয় কিন্তু করোনার জন্য আরও কুড়ি কোটি লোক নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হলো। হারালো কাজ, হারালো জীবনের ছন্দ। বাংলাদেশের কাপড় কলের শ্রমিক ফরিদা থেকে উত্তরপ্রদেশের ফরিদাবাদের শ্রমিক জয়প্রকাশ কিংবা আমেরিকার পোল্ট্রিফার্মের কর্মচারী জ্যঁ ব্যাপ্তিস্ত এমনই এক নির্দয় পৃথিবীর বাসিন্দা যেখানে অসাম্য আর অন্যায়কেই স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। অক্সফ্যামের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে যে, করোনার সময়ে যে চরম অসাম্য ও অনটন দেখা গেল বিশ্বজুড়ে তা অবশ্যম্ভাবী ছিলনা। রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে তা অবশ্যম্ভাবী হয়েছে। এই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। সম্প্রতি দাভোসে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের বৈঠক শুরু হয়েছে সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কিছু মেরামত প্রয়োজন। সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের তাগিদ যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চালিকাশক্তি তাকে মেরামত করা যে আদৌ সম্ভব নয় তা আইএমএফ বিশ্বব্যাঙ্কের কর্তারা জানেন। তবুও বিশ্বজুড়ে এই বার্তা দেওয়া হয় যাতে বিকল্পের জন্য সংগ্রাম তীব্রতা না পায় এবং পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ এসে হাজির না হয়। গোটা পৃথিবীর অর্থনীতিতে কর্পোরেশনগুলির ভয়ঙ্কর আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে এই শক্তি। জনমতকে কর্পোরেট মিডিয়া যেভাবে প্রভাবিত করছে তাতে গণতন্ত্রের পরিসর ক্রমশ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ছে। তাই কর্পোরেটের শ্রেণি-আধিপত্যকে চূর্ণ না করা গেলে কখনই সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়।

বিশ্বজোড়া মারাত্মক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে অক্সফ্যামের রিপোর্টে সব রাষ্ট্রের কাছে এই আবেদন করা হয়েছে যেন তারা কেবলমাত্র জিডিপি’র দিকে না তাকিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক সক্ষমতার মতো সামাজিক সূচকগুলি এবং পরিবেশের দিকে নজর দেয়। এই অতিমারীর সময় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, প্রত্যেকটি পরিবারের একটি ন্যূনতম নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষার। কিন্তু অধিকাংশ দেশের সরকার যে এই অভূতপুর্ব বিপর্যয়ের সময়েও জনসাধারণের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কাজ করেনি তা এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট। আমাদের দেশের সরকার শ্রমজীবী মানুষের কোনো দাবির প্রতি কর্ণপাত না করায় গত ২৬ নভেম্বর ২৫ কোটি মানুষ ঐতিহাসিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন। গত ন’মাসের অভিজ্ঞতা একথা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে, শাসকশ্রেণির টনক নড়ানোর জন্য এ মুহূর্তে গণসংগ্রাম ছাড়া আর কোনো বিকল্প রাস্তা পৃথিবীর মেহনতি মানুষের সামনে নেই।