৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯
রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় দুর্নীতি
গ্রেপ্তার পার্থ চ্যাটার্জি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২২ জুলাই থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিকে এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে ২৩ জুলাই মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট(ইডি)। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা বর্তমান শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জিকে এই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে ইডি। একই দিনে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়। এসএসকেএম হসপিটাল এবং ভুবনেশ্বর এইমস ঘুরে বর্তমানে তিনি ইডি হেফাজতে থাকবেন ৩ আগস্ট পর্যন্ত।
মুখ বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীসভা এবং দলের সমস্ত পদ থেকে পার্থ চ্যাটার্জিকে অপসারিত করলেও দায় তাঁর পিছু ছাড়ছে না।
তৃণমূল জমানায় এঘটনা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দলের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন নয়। এর আগেও সারদা-নারদা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক মন্ত্রীসহ সাংসদ নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তদন্তে মন্ত্রী ঘনিষ্ঠের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে আর টিভিসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় তার চটজলদি আপডেট এবং সচিত্র বিবরণ তীব্র আলোড়ন তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে। এখনও পর্যন্ত মাত্র দু’দফায় মন্ত্রী ঘনিষ্ঠের দু’টি ফ্ল্যাট তল্লাশিতে ৫০ কোটিরও বেশি নগদ টাকা সহ অলঙ্কার ইত্যাদি উদ্ধারের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই জনরোষ ক্রমশ বাড়ছে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি। রাজ্যজুড়ে বামপন্থী দল এবং ছাত্র-যুবদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল-মিটিংয়ে উত্তাল রাজপথ। সেখানে স্লোগান উঠেছে ‘চোর ধরো, জেল ভরো’। তীব্র শ্লেষ আর ক্ষোভ ঝরে পড়ছে ‘লুট হয়েছে কোটি কোটি, আসল চোর হাওয়াই চটি’ স্লোগানের উচ্চারণ, আর তাতে গলা মেলানোর জোশ থেকে। পুলিশি বাধাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দাহ করা হচ্ছে ধৃত পার্থ চ্যাটার্জির কুশপুতুল।
ঘটনা প্রবাহে রাজ্যের শাসকদলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চুরির কাঠামো একেবারে বেআব্রু হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অবশ্য শুরুতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা নীরবতা পালনের পর মুখ খুলেছেন ২৪ জুলাই একটি সরকারি অনুষ্ঠানে। ঘটনার সংস্রব এড়াতে সেখানে মুখ খুললেও আগাগোড়া নিজেকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা হিসেবে রক্ষণাত্মক বক্তব্য পেশ করেছেন, যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘যে অন্যায় করেছে তার বিরুদ্ধে আপনি যা পারেন করুন আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু আমার গা ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না’...। আবার একটি অপরীক্ষিত কিন্তু ইতিমধ্যে ভাইরাল ভিডিয়ো যেখানে পার্থ চ্যাটার্জি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সঙ্গে এক মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি একটা প্যান্ডেলে গিয়েছি পুজো উদ্বোধনে। আমি কী করে জানব কে আছে না আছে।...’ এ প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘সাধু সাজার চেষ্টা করছেন এখন? রাজ্যে দুর্নীতির মধ্যমণি মমতা ব্যানার্জি। তোলা আদায়, কাট মানি, সিন্ডিকেটের এই সিস্টেম উনি গড়ে তুলেছেন। রসুনের মতো এই সিস্টেম। রসুনের কোয়াগুলোর মতো সবাইকে বেঁধে রেখেছে দুর্নীতি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিচার চাই। যোগ্য যারা চাকরির পরীক্ষায় পাস করেছেন তাদের নিয়োগ চাই। চাই রাজ্য সরকার শূন্য পদের তালিকা প্রকাশ করুক’। উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরে ১৮ হাজার শূন্য পদের কথা। আরও বলেছেন আদালতের মামলার বাধায় তিনি সেই পদ পূরণ করতে পারছেন না।
তবে শুধুমাত্র মন্ত্রীর গ্রেপ্তারির ঘটনার জেরে সহজভাবে এই পদক্ষেপকে দেখার প্রশ্ন নেই। কারণ, এর আগে দুর্নীতির দায়ে তৃণমূলের বহু নেতা-মন্ত্রী-সাংসদের জেরা এবং গ্রেপ্তারি দেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, যেখানে তদন্ত প্রক্রিয়া থমকে গেছে। বিজেপি তৃণমূলের ভুয়ো দ্বৈরথের ছায়ায় একের পর এক মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। মন্ত্রী-সান্ত্রীরা জেল ফেরত ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহাল তবিয়তে, বুক ফুলিয়ে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীন ভূমিকার অভিযোগ সুবিদিত।
জুন মাসে ইডি’র দায়ের করা মামলার জেরে এই গ্রেপ্তারি অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ মামলার তদন্ত আদালতের নির্দেশে সক্রিয় হয়েছে, মোদি-শাহের কোনও প্রশাসনিক গরজের ছাপ এটা নয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক মহলের একাংশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মমতা ব্যানার্জি নতি স্বীকার করে আগেই বিবৃতি দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন, নিজেকে এবং কয়লা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ভাইপো সাংসদকে বাঁচানোর বাধ্যবাধকতায়। আর আসন্ন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজ্যসভায় বিজেপি’র ব্যালেন্স অক্ষুণ্ণ রাখতে তাঁর দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না বলে আর এক দফা আত্মসমর্পণ তাঁর রাজনৈতিক দ্বিচারিতার আরও একটা প্রমাণ। এই দ্বিচারিতায় তিতিবিরক্ত মানুষ ক্রমশ বিকল্পের প্রশ্নে বামপন্থীদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রীর অবশিষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতায় আরও কালি লাগুক এটা চায়নি তৃণমূল-বিজেপি। অতএব নতুন চিত্রনাট্য নির্মাণের তাগিদ থেকে এই ঘটনা পরম্পরার নির্মাণ। আর সেই নির্মাণে নয়া মোড় হিসেবে গুরুত্ব লঘু করতে পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে চর্চা শুরু করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। তাই সময়ের চাহিদাটা এই মুহুর্তে বহুমাত্রিক। প্রশ্ন তুলতে হবে রাজ্য সরকার আর তাঁর মুখ্যমন্ত্রী এতদিন কি করছিলেন। জানতাম না বলে ভাবের ঘরে চুরি করে দায় এড়াতে দেওয়া যাবে না তাঁকে। আর যোগ্য প্রার্থীরা, যারা চাকরি লুটের জেরে বঞ্চনার শিকার হয়ে ৫০০দিনের ওপর খোলা রাজপথে ধরনা দিচ্ছেন বিক্ষোভ অবস্থানে শামিল হয়ে, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই আন্দোলন গড়ে তোলা এবং নিয়োগ দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের দাবিভিত্তিক ধারাকে তৃণমূল-বিজেপি’র সরকারকে উৎখাত করার গণআন্দোলনে মিশিয়ে দেওয়াই এই সন্ধিক্ষণে পথের দিশা।